কর্মীদের কার্যালয়ে ফেরানো নিয়ে যুক্তরাজ্য সরকার ও অ্যামাজনের মতভেদ

অ্যামাজনছবি: রয়টার্স

টেবিলে বসে যাঁরা কাজ করেন, সেই কর্মীরা কোথায় কাজ করলে সবচেয়ে বেশি ফলপ্রসূ হয়, তা নিয়ে অ্যামাজন ও যুক্তরাজ্য সরকারের মধ্যে মতভেদ দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ তাঁরা কি কার্যালয়ে এসে কাজ করবেন, নাকি ঘর থেকে কাজ করবেন, তা নিয়ে।

খুচরা বিক্রয়কারী কোম্পানি অ্যামাজন যুক্তরাজ্যের কর্মীদের কার্যালয়ে এসে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছে। তারা বলছে, এখন থেকে কর্মীদের সপ্তাহে পাঁচ দিন কার্যালয়ে এসে কাজ করতে হবে। যদিও যুক্তরাজ্য সরকার মনে করছে, এ ক্ষেত্রে কর্মীদের স্বাধীনতা থাকা দরকার, যেমন তাঁরা চাইলে ঘর থেকেও যেন কাজ করতে পারেন। যুক্তরাজ্য সরকার এই বিষয়টিতে জোর দিচ্ছে। খবর বিবিসির

অ্যামাজন মনে করছে, কর্মীরা অফিসে ফিরে এলে আরও সৃজনশীল হবেন; সেই সঙ্গে তাঁদের মধ্যে সহযোগিতা ও সংযোগ বাড়বে। তাদের মতে, কার্যালয়ে উপস্থিত থেকে দলীয় কাজের মধ্য দিয়ে কর্মীরা নতুন উদ্ভাবনে আরও দক্ষ হন এবং সংযোগের মাধ্যমে ব্যবসায়িক উন্নয়ন ঘটে।

যুক্তরাজ্যে সরকার আবার মনে করছে, উপস্থিতির ধরাবাঁধা নিয়ম থাকা ভালো নয়। বাড়ি থেকে কাজ করা কর্মীদের উৎপাদনশীলতা, কর্মক্ষেত্রের প্রতি আনুগত্য এবং কাজ ও ব্যক্তিগত জীবনের ভারসাম্য বৃদ্ধিতে সাহায্য করে বলে তাদের মত। যুক্তরাজ্য সরকার বিষয়টি আরও বৃহৎ পরিসরে দেখছে। তারা মনে করছে, কর্মীদের ঘর থেকে কাজের সুযোগ থাকলে শিশু বা বয়স্কদের যত্ন নেওয়ার অবকাশ সৃষ্টি হয়।

অ্যামাজনের প্রতিদ্বন্দ্বী মাইক্রোসফট কোভিড মহামারির সময় কর্মীদের নিয়ে একটি গবেষণা করেছিল। সে জন্য ২০২০ সালের প্রথম ছয় মাসে যুক্তরাষ্ট্রের ৬১ হাজার কর্মীর ই–মেইল, ক্যালেন্ডার, তাৎক্ষণিক বার্তা ও ফোন কল পরীক্ষা করা হয়েছিল। সেই গবেষণার প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল নেচার হিউম্যান বিহেভিয়র নামের এক সাময়িকীতে।

গবেষণায় দেখা যায়, কোভিড মহামারির সময় কর্মীরা চেনাজানা সহকর্মীদের সঙ্গে বেশি যোগাযোগ করেছেন; নতুন যোগাযোগ তৈরিতে তেমন একটা সময় দেননি। ফলে ওই সময় বিভিন্ন গোষ্ঠী ও নেটওয়ার্কের সঙ্গে তাঁদের তেমন একটা যোগাযোগ তৈরি হয়নি।

এ ছাড়া সশরীর কার্যালয়ে গেলে যে বাস্তব যোগাযোগ হয়, অনলাইনে তা অনেক কমে যায়। ওই সময় কর্মীরা বেশি বেশি ই–মেইল ও তাৎক্ষণিক বার্তা পাঠিয়েছেন। গবেষকেরা বলেন, এ পরিস্থিতিতে জটিল তথ্য আদান-প্রদানে সমস্যা হতে পারে।
মাইক্রোসফটের গবেষণার দোহাই দিয়ে অ্যামাজনের দাবি, কার্যালয়ে থাকলে কর্মীদের পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়বে। দূর থেকে কাজ করলে সংযোগ কমে যায়। কিন্তু যুক্তরাজ্যে সরকারের কথা হলো, কাজের স্থান নিয়ে ধরাবাঁধা নিয়ম না থাকলে কাজে ভারসাম্য আসে। এতে দীর্ঘ মেয়াদে কর্মীদের কর্মক্ষমতা ও সন্তুষ্টি বৃদ্ধি পায়।
তবে মাইক্রোসফটের সেই গবেষণা ছিল তথ্য-উপাত্তভিত্তিক। সেখানে মানবীয় অভিজ্ঞতা আমলে নেওয়া হয়নি।

২০২০ সালে চার্টার্ড ইনস্টিটিউট অব পারসোনেল অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট এক হাজার শীর্ষস্থানীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীর মধ্যে জরিপ চালায়। সেই জরিপে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বলেন, কর্মীদের মধ্যে যোগাযোগ ও সহযোগিতার পরিসর কমে গেছে। তবে ৪০ শতাংশের বেশি ব্যবস্থাপক বলেছেন, বাড়ি থেকে কাজ করার সময় কর্মীদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা বেশি ছিল। কর্মীদের পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি পাওয়া অবশ্যই ভালো; কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে সহযোগিতা থাকলেই উৎপাদনশীলতা বাড়বে।

এদিকে শুধু অ্যামাজন নয়, আরও বেশ কিছু কোম্পানি কর্মীদের পূর্ণকালীন কার্যালয়ে ফিরতে বলেছে। গোল্ডম্যান স্যাকসের প্রধান নির্বাহী ডেভিড সলোমন বাড়ি থেকে কাজকে ‘অস্বাভাবিক’ বলে অভিহিত করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের এই কোম্পানি ব্যাংকারদের সপ্তাহে পাঁচ দিন কার্যালয়ে আসতে বাধ্য করছে। ইলন মাস্কের প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্সও কর্মীদের কার্যালয়ে ফিরিয়ে এনেছে; কিন্তু এর ফলাফল ভালো হয়নি। এই নীতি চালুর পর স্পেসএক্সের ১৫ শতাংশ জ্যেষ্ঠ কর্মী কাজ ছেড়ে দেন।

এদিকে অনেক প্রতিবন্ধী কর্মী বিশ্বাস করেন, বাড়ি থেকে কাজ করলে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায়। ২০২৩ সালে ৪০০ জনের ওপর পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিবন্ধী কর্মীরা বাড়ি থেকে কাজ করলে স্বনিয়ন্ত্রণ থাকে। তাঁদের স্বাস্থ্য ও সুস্থতার ওপর নিয়ন্ত্রণ আসে। ৮৫ শতাংশ মানুষ নিজেদের বেশি উৎপাদনশীল বলে মনে করেন।

২০১০ সালে চীনের বৃহত্তম ট্রাভেল এজেন্সি গ্রুপ সি ট্রিপ ২৫০ কর্মীকে নিয়ে সমীক্ষা চালায়। সেই কর্মীদের মধ্যে অর্ধেক বাড়ি থেকে কাজ শুরু করেন এবং অন্যরা কার্যালয়ে থেকে যান। পরে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা জানান, বাড়িতে কাজ করা কর্মীদের উৎপাদনশীলতা ছিল ১৩ শতাংশ বেশি। কারণ হিসেবে বলা হয়, বাড়িতে থাকায় তাঁরা অধিকতর সুস্থ দেহ ও মন নিয়ে কাজ করতে পেরেছেন। কাজের মধ্যে বিরতিও বেশি নেননি; শান্ত পরিবেশে বেশি কল ধরতে পারতেন তাঁরা।

তবে সব গবেষণায় একই ফল পাওয়া যায় না। কিছু গবেষণায় বাড়ি থেকে কাজ করার ফলে শারীরিক স্বাস্থ্যের উন্নতি দেখা গেছে, আবার কিছু গবেষণায় তার উল্টো ফল মিলেছে। মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও একই রকম বিরোধ দেখা যায়।