রপ্তানিকারকদের একটি অংশ বলেছে, প্রণোদনা কমানোয় বিভিন্ন খাতের পণ্য রপ্তানিতে ধাক্কা আসবে। আপনার কী মত?
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: স্বল্পন্নোত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণের পর পণ্য রপ্তানি করতে শুল্ক দিতে হবে, ভর্তুকি রাখা যাবে না। রপ্তানিকারকেরা বলছেন, ‘ব্যবসায়ের খরচ বাড়ছে, আয়ও সংকুচিত হয়েছে। নতুন করে প্রণোদনা কমানোর সিদ্ধান্ত তাঁদের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে।’ তবে চাপ নেওয়ার বিষয়টি ব্যবসায়ে পরিপক্বতা, ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ ও উৎপাদনশীলতার ওপর নির্ভর করবে। সেটি বিবেচনায় নিলে তৈরি পোশাক খাত চাপটি নিতে পারবে। তা ছাড়া পোশাক খাতের ২১১টি পণ্যের মধ্যে মাত্র ৩১টি (আট ডিজিটের এইচএস কোড অনুযায়ী) রপ্তানি থেকে প্রণোদনা তুলে নেওয়া হয়েছে। অধিকাংশ পণ্য রপ্তানিতে প্রণোদনা রয়ে গেছে। সেগুলো ধাপে ধাপে তুলে নেওয়া হবে। আইনিভাবে এটি গুরুত্বপূর্ণ এবং বাস্তবসম্মতও। কারণ, ভর্তুকি অব্যাহত থাকলে (এলডিসি থেকে উত্তরণের পর) বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় (ডব্লিউটিও) কেউ অভিযোগ করলে আমরা কিন্তু বিপদে পড়ে যাব। ফলে আগে থেকেই প্রস্তুতি নেওয়ার অংশ হিসেবে এই উদ্যোগটি যৌক্তিক বলেই মনে করছি। প্রণোদনা কমানোর সিদ্ধান্তে তৈরি পোশাকের বাইরে অন্যান্য পণ্য রপ্তানিতে প্রভাব বেশি পড়তে পারে। তাদের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ভর্তুকির বাইরে অন্য সহায়তার পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। সব মিলিয়ে এই সিদ্ধান্তকে সব খাতের উদ্যোক্তাকে ভর্তুকি থেকে বেরিয়ে আসার প্রস্তুতিমূলক পদক্ষেপ হিসেবে দেখা উচিত।
অনেক ব্যবসায়ী নেতা বলছেন, হঠাৎ প্রণোদনা কমানোর সিদ্ধান্তটি নেওয়া ঠিক হয়নি। তাঁরা লোকসানে পড়বেন। কমপক্ষে ছয় মাস আগে জানিয়ে দেওয়া দরকার ছিল। কারণ, প্রণোদনাকে ভিত্তি করে রপ্তানির ক্রয়াদেশ নেন তাঁরা। আপনি কী মনে করেন সিদ্ধান্ত আরেকটু সময় দিয়ে তারপর বাস্তবায়ন করার সুযোগ ছিল?
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: আগেই বলেছি, উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হলে পণ্য রপ্তানিতে ভর্তুকি রাখা যাবে না। ব্যবসায়ী নেতা ও ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো বেশ আগে থেকে বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত। অনেক আলাপ-আলোচনাও হয়েছে। আমাদের দেশে এসব সিদ্ধান্ত আয়োজন করে নিতে গেলে বিভিন্ন দিক থেকে চাপ আসে। তাতে বাস্তবায়নে জটিলতা তৈরি হয়। তবে প্রণোদনা যেভাবে ধাপে ধাপে কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তাতে ব্যবসায়ীরা প্রস্তুতির সময় পাবেন। ফলে ব্যবসায়ীদের এ বিষয়ে সহমত প্রকাশ করা দরকার।
প্রণোদনা কমানোর কারণে ব্যবসায়ীদের লোকসান হবে না। কারণ, প্রণোদনার মাধ্যমে বাড়তি সুবিধা দেওয়া হতো। অন্যদিকে প্রণোদনা পাওয়ার জন্যও একটি চক্র গড়ে উঠেছিল। পণ্যের দামের সঙ্গে এটি যুক্ত হতো বলে আমাদের মনে হয় না। একধরনের মধ্যস্বত্বভোগী তৈরি হয়েছিল। প্রকৃত ব্যবসায়ীরা পুরো সুবিধাটা পেতেন না।
এখন ব্যবসায়ীদের উৎপাদনব্যবস্থায় অপচয় হ্রাস, ব্যয় সাশ্রয় ও দক্ষতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া উচিত। এ লক্ষ্যে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, পণ্য ও বাজার বৈচিত্র্য এবং বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে বিনিয়োগ বহুমুখীকরণের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। এতে ব্যবসায়ীরা পণ্যে আগের দামই বিদেশি ক্রেতাদের অফার করতে পারবেন। এত দিন ক্রেতারা এই প্রণোদনার অজুহাতে পণ্যের দাম কম দিত। তাই সামনের দিনগুলোতে দর–কষাকষিতে কৌশলী হওয়ার সুযোগ থাকবে।
রপ্তানিতে প্রণোদনা কমানোর কারণে সরকারের রাজস্ব বাঁচবে। পণ্য রপ্তানিতে সক্ষমতা বাড়াতে সেই অর্থ ব্যয়ের প্রয়োজন কি আছে?
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: সরকারের রাজস্ব ব্যয় ধাপে ধাপে কমবে। সেই অর্থ বিকল্প ব্যয়ের সুযোগ রয়েছে। তবে ভর্তুকি দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ভারত, চীন ও ভিয়েতনামের মতো অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশ ডব্লিউটিওর নিয়ম মেনে রপ্তানি খাতে কী ধরনের সহযোগিতা করে, সেসব বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে ভারতের রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল বা ভিয়েতনামের ‘ট্রেড পলিসি অ্যান্ড প্রমোশন প্রজেক্ট’–এর অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো যেতে পারে।
রপ্তানি প্রণোদনা থেকে বেঁচে যাওয়া অর্থ সামাজিক খাত কিংবা শ্রমিক ও কর্মপরিবেশের উন্নয়নে ব্যয় করা যেতে পারে।