ইন্টারনেট বন্ধ আর ‘প্রশ্নবিদ্ধ বিশ্বাসযোগ্যতা’, ইমেজ সংকটে বাংলাদেশের অর্থনীতি
বেশ কয়েক দিনের বিক্ষোভ, সহিংসতা আর ধ্বংসযজ্ঞ। পরিস্থিতি সামলাতে ইন্টারনেট বন্ধ আর কারফিউ জারির পর প্রায় এক সপ্তাহ ধরে অর্থনীতি পুরোপুরি স্থবির ছিল। কৃষি ছাড়া বাকি প্রায় সব উৎপাদন খাতের কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে যায়। সরবরাহব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। আমদানি-রপ্তানি প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। কারফিউ শিথিল আর ইন্টারনেট ফিরিয়ে দেওয়ার পর এখন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করছে বাংলাদেশের অর্থনীতি।
পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়েছে, তা বলার সময় এখনো আসেনি। শিল্প এলাকাগুলোতে কারখানা খুলেছে, শ্রমিকেরা কাজে ফিরেছেন। বন্দরে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমও শুরু হয়েছে। উৎপাদন এলাকা থেকে কৃষিপণ্য ঢাকার মতো বড় বাজারগুলোতে পাঠানো যাচ্ছে। কিন্তু তারপরও অর্থনীতি স্বাভাবিক গতিতে ফিরতে পারছে না। ফলে সর্বশেষ এই অস্থিরতা-সহিংসতা-সংঘাত ও তা দমনে নেওয়া সরকারি পদক্ষেপগুলো দীর্ঘ সময় ধরে সংকটে থাকা অর্থনীতির ওপর বড় ধরনের আঘাত হিসেবে এসেছে।
অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতি তৈরি হয় কোনো ঘোষণা ছাড়া হঠাৎ ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়ার পর। কর্তৃপক্ষ সম্ভবত ধারণা করতে পারেনি যে বাংলাদেশের অর্থনীতি ইতিমধ্যে ইন্টারনেটের ওপর কতটা নির্ভরশীল হয়ে গেছে। শুরুতে মোবাইল ইন্টারনেট এবং এরপর পুরো ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়ার ফলাফল অর্থনীতির জন্য ভয়াবহ হয়েছে। এর ফলে উৎপাদনব্যবস্থা যেমন থমকে যায়, তেমনি সরবরাহব্যবস্থা প্রায় পুরোটাই স্থবির হয়ে পড়ে। একই সঙ্গে ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্যও অচল হয়ে যায়।
অর্থনীতিতে ক্ষয়ক্ষতি কতটা হয়েছে, তা জানতে আরও খানিকটা সময় লাগবে। তবে এরই মধ্যে ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ আসতে শুরু করেছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সংগঠন এফআইসিসিআইয়ের প্রাথমিক হিসাবে, অর্থনীতিতে ক্ষতির পরিমাণ ১০ বিলিয়ন ডলার বা ১ হাজার কোটি ডলার হতে পারে। অর্থনীতিবিদদের হিসাবে, কারফিউ জারির আগের দুই দিনসহ সাধারণ ছুটির দিনগুলোতে প্রতিদিন অন্তত ১ বিলিয়ন ডলার বা ১০০ কোটি ডলারের ক্ষতি হয়েছে। রপ্তানি আদেশ কতটা অন্য দেশে চলে গেছে কিংবা প্রবাসী আয়ে কী ধরনের প্রভাব পড়তে চলেছে, তা এখনো জানা যাচ্ছে না।
ব্যাংকগুলো ইতিমধ্যেই ক্ষতির কিছুটা আঁচ পেতে শুরু করেছে। ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়ায় টানা ছয় দিন ধরে বাংলাদেশ বিচ্ছিন্ন ছিল সুইফট ব্যবস্থা থেকে। এই সময়ে বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের সব ধরনের আর্থিক লেনদেন কার্যত বন্ধ ছিল। অর্থ লেনদেন-সংক্রান্ত বার্তা আদান-প্রদানের বৈশ্বিক ব্যবস্থা হলো সুইফট। এই ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে কী ধরনের বিপদ হতে পারে, তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে রাশিয়া। বাংলাদেশে যেসব ব্যবসায়ী পণ্য আমদানি করেন, তাঁদের নির্দিষ্ট সময়ে তার দাম মেটাতে হয়। এ কাজেই দরকার সুইফট ব্যবস্থা। এখন নির্দিষ্ট সময়ে আমদানি দায় না মেটানোর কারণে বিদেশের ব্যাংক জরিমানা করছে স্থানীয় ব্যাংকগুলোকে।
তবে সবচেয়ে অসহায় অবস্থায় পড়েন ইন্টারনেট ব্যবহার করে যাঁরা ছোট-বড় ব্যবসা করেন, সেসব উদ্যোক্তা। ফেসবুকে পেজ খুলে হাজারো তরুণ-তরুণী নিজের ব্যবসা শুরু করেছিলেন, তাঁরা রীতিমতো বিপদে রয়েছেন। সংখ্যার বিবেচনায় ফেসবুকই বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় ইউজার প্ল্যাটফর্ম। ফেসবুকের লাখ লাখ ব্যবহারকারী শুধু পোস্ট দেন না বা ছবি-ভিডিও আপলোড করেন না। তাঁরা একই সঙ্গে ভোক্তা—পণ্য কেনেন, অর্থনীতি সচল রাখেন। এই ভোক্তাশ্রেণি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছেন উদ্যোক্তারা। অত্যন্ত ধীরগতির ইন্টারনেটের কারণে বিঘ্নিত হচ্ছে ওয়েবসাইটভিত্তিক ব্যবসাও। শিল্পপণ্যের উৎপাদকেরা দোকানে পণ্য পাঠাতে রীতিমতো গলদঘর্ম হচ্ছেন। কারণ, ক্রয়াদেশ দেওয়া আর নেওয়ার পুরো ব্যবস্থাই এখন ইন্টারনেটনির্ভর হয়ে গেছে।
একই অবস্থা হয়েছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও। পোশাকের ক্রয়াদেশ নেওয়া, কাঁচামাল কেনা বা বিদেশি ব্যাংকের সঙ্গে নথিপত্র লেনদেন করা—সবই বন্ধ হয়ে ছিল ইন্টারনেটের অভাবে। নারায়ণগঞ্জের একটি পোশাক কারখানা যেমনটা জানিয়েছে, প্রতিশ্রুত যেসব ক্রয়াদেশ তাদের পাওয়ার কথা ছিল, তার ৩০ শতাংশও পাওয়া যায়নি। সব ক্রয়াদেশ শেষ পর্যন্ত আসবে, এমন ভরসা করতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি। এমন পরিস্থিতি প্রায় সব রপ্তানিমুখী শিল্পেরই।
তবে কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলির সবচেয়ে বড় শিকার হয়েছে বিদেশে বাংলাদেশের ইমেজ বা ভাবমূর্তি। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এরই মধ্যে সতর্ক করে বলেছেন, নির্ভরযোগ্য একটি বিনিয়োগ গন্তব্য হিসেবে বাংলাদেশের বিশ্বাসযোগ্যতা এখন প্রশ্নবিদ্ধ। প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই যাতে শোভন একটি চাকরি পাওয়া যায়, সে লক্ষ্যেই শিক্ষার্থীদের আন্দোলন। কিন্তু কর্মসংস্থান বাড়াতে যত বিনিয়োগ করা প্রয়োজন, দেশে সেটা দীর্ঘদিন ধরেই হচ্ছে না। এরই মধ্যে বিদেশি বিনিয়োগ যদি আগের চেয়েও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে, সেটা অর্থনীতির জন্য হবে আরেকটি আঘাত।
অর্থনীতিবিদেরা আগে থেকেই সতর্ক করেছিলেন। এখন সরকারের কোনো কোনো মন্ত্রী স্বীকার করছেন যে পরিস্থিতি ‘সংকটময়’ এবং দেশের ‘ভামূর্তির সংকট’ হয়েছে। প্রযুক্তি খাতের সংগঠন বেসিসের সভাপতি রাসেল টি আহমেদ বলেছেন, ডেটা সেন্টার পুড়ে গিয়ে ইন্টারনেট–সেবা বন্ধ হয়েছে, এ কথা বিদেশি ক্রেতারা কেউ বিশ্বাস করছেন না। ‘এতে তাঁরা আমাদের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলছেন,’ বলেছেন তিনি। বাংলাদেশের অর্থনীতির সত্যিকার সংকট এই আস্থা হারানোতে। এ দেশের সঙ্গে নির্বিঘ্নে ব্যবসা করা যায়, এ আস্থা যদি বিদেশিরা রাখতে না পারেন, তাহলে সংকট কেবল বাড়তেই থাকবে।