বাণিজ্য ঘাটতি নিয়ে ট্রাম্প কি পুরো সত্য বলছেন
রাজনীতিবিদেরা সাধারণত পুরো সত্য বলেন না। যেটুকু নিজের স্বার্থে কাজে আসে, সেটুকুই বলেন। এই বিষয়ক একটি রূপক ইংরেজিভাষী অঞ্চলে বহুল ব্যবহৃত। সেটা হলো ‘গ্লাস হাফ ফুল অর হাফ এম্পটি’। অর্থাৎ গ্লাসে অর্ধেক পানি থাকলে কেউ বলেন ‘গ্লাস হাফ ফুল’ আর কেউ বলেন ‘গ্লাস হাফ এম্পটি’। অর্থাৎ একই জিনিস দুজন দুভাবে বলেন। কেউ বলেন গ্লাসটা অর্ধেক ভরা, কেউ বলেন গ্লাসটা অর্ধেক খালি।
বাস্তবতা হলো, যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক সম্পর্কে ডোনাল্ড ট্রাম্প সেই নীতির আশ্রয় নিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সামগ্রিকভাবে বাণিজ্য ঘাটতি আছে সত্য। কিন্তু সেই ঘাটতি মূলত পণ্য বাণিজ্যে। সেবা বাণিজ্যে কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র অন্যদের থেকে যোজন যোজন এগিয়ে। সেখানে তাকে ধরাছোঁয়ার মতো কেউ নেই।
সিএনএনের তথ্যানুসারে, ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সেবা বাণিজ্যের উদ্বৃত্ত ২৯৩ বিলিয়ন বা ২৯ হাজার ৩০০ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে। ২০২৩ সালের তুলনায় এই উদ্বৃত্ত বেড়েছে ৫ শতাংশ এবং ২০২২ সালের তুলনায় বেড়েছে ২৫ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্রে এ তথ্য দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
মুডিস অ্যানালিটিকসের প্রধান অর্থনীতিবিদ মার্ক জান্ডি সিএনএনকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণ হলো সেবা ব্যবসা। এটাই মার্কিন অর্থনীতির গোপন সূত্র। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিপুল পরিমাণে সেবা রপ্তানি করে। যেসব দেশে এই সেবা রপ্তানি করা হয়, তারা আবার জানে, যুক্তরাষ্ট্র বেকায়দায় পড়লে তারা এসব আমাদের বিরুদ্ধেই ব্যবহার করতে পারবে, যেমন তারা বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা তৈরি থেকে এসব সেবা আমদানির ক্ষেত্রে নতুন মানদণ্ডের শর্ত দিতে পারে।
সামগ্রিকভাবে ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ৯১৮ দশমিক ৪ বিলিয়ন বা ৯১ হাজার ৮৪০ কোটি ডলার। ২০২৩ সালের তুলনায় এই ঘাটতি বেড়েছে ১৭ শতাংশ।
ঘাটতি মানেই খারাপ নয়।
এখন কথা হচ্ছে, কোনো দেশের বাণিজ্য ঘাটতি থাকলেই কি সেই দেশ লুজার বা পরাজিত? এ কথা মনে করার কারণ আছে কি? অর্থশাস্ত্র যাঁরা চর্চা করেন, তাঁরা কখনোই সে কথা বলেন না। এটা কাঠামোগত কারণে হয়ে থাকে। যদি এই ঘাটতি বিচক্ষণতার সঙ্গে এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে ব্যবহার করা হয়, তবে তা অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক হতে পারে। তবে দীর্ঘস্থায়ী ও অনিয়ন্ত্রিত বাণিজ্য ঘাটতি অবশ্যই উদ্বেগের কারণ হতে পারে।
এ ছাড়া যেকোনো দেশ উন্নতির বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন খাতনির্ভর থাকে। যেমন প্রথমে কৃষিনির্ভরতা; এরপর শিল্পনির্ভরতা; এরপর যখন সেই দেশ উন্নতির চরম শিখরে উঠে যায়, তখন সেবা বা প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে ওঠে। যুক্তরাষ্ট্রও সেই কালপর্ব পেরিয়ে এসেছে। পৃথিবীতে আজ যত প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়, তার সবই প্রায় তাদের তৈরি। এখন চীন সেই পথ ধরছে। ভারত কিছুটা আগেই সেবা বা প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে পড়েছে বলে অনেক অর্থনীতিবিদ অভিযোগ করেন। উৎপাদন খাতে বিকশিত হওয়ার আগেই তারা সেবা খাতের দিকে এগিয়েছে।
২ এপ্রিলকে ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। তাঁর ভাষায়, বিশ্বের প্রায় সব দেশ, তা সে যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু হোক বা শত্রু, সবাই যুক্তরাষ্ট্রকে গত ৫০ বছরে অর্থনৈতিকভাবে ছিঁড়েখুঁড়ে খেয়েছে। সে কারণে যুক্তরাষ্ট্রে কারখানা বন্ধ হয়েছে; মানুষের চাকরি গেছে; কিন্তু তিনি আর সেটা হতে দেবেন না। সে কারণে তাঁর পারস্পরিক শুল্ক।
কিন্তু বাস্তবতা তা নয়। সিএনএনের সাংবাদিক ফরিদ জাকারিয়া এক বিশ্লেষণে বলেছেন, বাস্তবতা হলো ট্রাম্পের দাবি মিথ্যা। বরং গত তিন দশকে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের অন্যান্য বৃহৎ বা তাদের গোত্রীয় অর্থনীতিকে ফেলে অনেক দূর এগিয়েছে। ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপি বা মোট দেশজ উৎপাদনের আকার ছিল ইউরোজোন বা ইউরো অঞ্চলের প্রায় সমান—যুক্তরাষ্ট্রের ছিল ১৪ দশমিক ৭৭ ট্রিলিয়ন বা ১৪ লাখ ৭৭ হাজার কোটি ডলার আর ইউরো অঞ্চলের ১৪ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন বা ১৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি ডলার। ২০২৩ সালে মার্কিন জিডিপি ইউরো অঞ্চলের প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে—২৭ দশমিক ৭২ ট্রিলিয়ন বা ২৭ লাখ ৭২ হাজার কোটি ডলার, যেখানে ইউরো অঞ্চলের ১৫ দশমিক ৭৮ ট্রিলিয়ন ১৫ লাখ ৭৮ হাজার কোটি ডলার।
১৯৯০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের গড় মজুরি ওইসিডিভুক্ত বা ধনী দেশগুলোর তুলনায় ছিল ২২ দশমিক ৩ শতাংশ বেশি। এখন সেই ব্যবধান বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৭ দশমিক ৬ শতাংশ। অন্যদিকে ১৯৯৫ সালে জাপানের মানুষের মাথাপিছু জিডিপি যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে ৫৪ শতাংশ বেশি ছিল। এখন তা এতখানি উল্টে গেছে যে কারও চোখ কপালে উঠতে পারে। ২০২৩ সালে মার্কিনদের মাথাপিছু জিডিপি জাপানিদের তুলনায় ছিল ১৪৫ শতাংশ বেশি। বাস্তবতা হলো, যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে দরিদ্র অঙ্গরাজ্য মিসিসিপির মাথাপিছু জিডিপি যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জাপানের চেয়ে বেশি। অর্থাৎ বিপুল পরিমাণ ঘাটতি নিয়েও যুক্তরাষ্ট্র খারাপ ছিল না।
ট্রাম্পের ভ্রম
ফরিদ জাকারিয়া বলছেন, এই চিত্তাকর্ষক তথ্য সত্ত্বেও ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ্বাস করেন, গত কয়েক দশকে যুক্তরাষ্ট্রের উল্টো পতন হয়েছে। ট্রাম্পের বিশ্ববীক্ষা এখনো ১৯৬০-এর দশকে আটকে আছে বলে মনে করেন ফরিদ জাকারিয়া। তখন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বড় উৎপাদনশীল শক্তি ছিল। একই সঙ্গে তিনি রাশিয়াকে বড় শক্তি মনে করেন। যে দেশের সঙ্গে তিনি অনেক চুক্তি করতে পারবেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই পাল্টা শুল্কে রাশিয়ার পণ্যে শুল্ক আরোপ করেননি ট্রাম্প।
যুক্তরাষ্ট্রের সেবা ও প্রযুক্তি ট্রাম্পের কাছে কিছুই মনে হয় না। এ কারণে তিনি বারবার উদাহরণ দেন, কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপিতে উৎপাদন খাতের হিস্যা কমেছে। পাল্টা শুল্কের হিসাবও করা হয়েছে পণ্য বাণিজ্যের ঘাটতির হিসেবে। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির প্রায় ৭৫ শতাংশই এই সেবা—সফটওয়্যার, সংগীত, চলচ্চিত্র, ব্যাংকিং, আইন ইত্যাদি।
যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যনীতি এমনিতেই সুরক্ষাবাদী ছিল। তাদের শুল্ক ও অশুল্ক বাধার পরিমাণ বিশ্বের ৬৮টি দেশের চেয়ে বেশি ছিল। নতুন এই শুল্কের মধ্য দিয়ে তাদের শুল্কহার ১৯৩০-এর দশকের স্মুট হাওলির শুল্ক হারের চেয়ে বেশি হয়ে গেল। এমনকি ট্রাম্প ১৯ শতকের শুল্ক যুগের স্মৃতিচারণা করেন। তখন আয়কর ছিল না, ছিল শুধু শুল্ক। সেই বাস্তবতায় ফিরে গেলে যুক্তরাষ্ট্র তখনকার মতো দরিদ্র ও দুর্নীতিপ্রবণ দেশে পরিণতি হতে পারে বলে মনে করেন ফারিদ জাকারিয়া।
এই যখন বাস্তবতা, তখন যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ ও টেকসই উন্নয়নের পুরোধা ব্যক্তিত্ব জেফরি ডি স্যাক্স মনে করেন, এসব কিছুর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পতন ত্বরান্বিত হবে। মার্কিন সাংবাদিক গ্লেন ডিজেনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, পৃথিবী যেমন বহুপক্ষীয় ব্যবস্থার দিকে এগোচ্ছে, ঠিক তেমনি একাধিক মুদ্রাকেন্দ্রিক ব্যবস্থার দিকেও এগোচ্ছে। আগামী ১০ বছরের মধ্যে ডলারের শক্তি আরও কমবে। এবার ট্রাম্পের এই শুল্ক যুদ্ধের কারণে পরিস্থিতির আরও দ্রুত অবনতি হবে বলেই তিনি মনে করেন। কেননা মার্কিন অর্থনীতি ও রাজনীতির ওপর মানুষের আস্থা কমে যাচ্ছে।
সামগ্রিকভাবে ট্রাম্প একধরনের ভ্রমের মধ্যে আছেন বলে মনে করেন জেফরি ডি স্যাক্স। এমনকি ট্রাম্প প্রশাসনের মৌলিক বোঝাপড়ায়ও ঘাটতি আছে বলে তাঁর মত। সে কারণে যুক্তরাষ্ট্রকে ১৯ শতকে ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি পরিসংখ্যানে জানা যায়, সেবা খাত অনেক আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি। সেই ১৯৩৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অকৃষি খাতের ৫৭ শতাংশ কর্মসংস্থান হতো সেবা খাতে, বর্তমানে যা ৮৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।
পোস্ট ট্রুথের যুগ
অনেক রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এখন ‘পোস্ট–ট্রুথ’ বা সত্যোত্তর যুগ চলছে। সহজ ভাষায় বলতে গেলে, পোস্ট-ট্রুথ যুগে মানুষ কোনো ঘটনা বা তথ্যের সত্যতা যাচাই না করে বরং আবেগ, অনুভূতি ও ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে তা গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান করে। এখানে তথ্য বা যুক্তির চেয়ে ব্যক্তিগত আবেগ ও বিশ্বাস মুখ্য হয়ে ওঠে। ট্রাম্প এই পোস্ট–ট্রুথের অন্যতম সেরা কারিগর। ফলে মানুষকে তিনি বিশ্বাস করাতে পেরেছেন, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বায়নের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে উদারবাদী বিশ্বব্যবস্থার অনেক সমস্যা আছে। সেগুলো ঠিকঠাক আমলে না নেওয়ার কারণে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন অনেকে।