বেসরকারি খাতের যথাযথ স্বীকৃতি ও সমর্থন প্রয়োজন
কয়েক বছর ধরেই অর্থনীতি চাপে রয়েছে। ডলার-সংকট ও ডলারের মূল্যবৃদ্ধিতে বেড়েছে উৎপাদন খরচ। অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাটে ভঙ্গুর হয়ে পড়ে ব্যাংক খাত। এমন এক পরিস্থিতিতে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে সরকার বদল হয়েছে। তাতে বিভিন্ন শিল্পকারখানায় হামলার পাশাপাশি অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটেছে। আবার নতুন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার মাস না পেরোতেই সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুর, নরসিংদীসহ বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে শ্রমিক বিক্ষোভ দেখা দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশের শিল্পোদ্যোক্তাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। এ নিয়ে কথা বলেছেন এপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর।
বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট অজয় বাঙ্গা বলেছেন, এই দশকে বিশ্বব্যাপী ১২০ কোটি চাকরিপ্রার্থী থাকলেও মাত্র ৪২ কোটি তরুণের জন্য এ চাকরির সুযোগ থাকবে। এককভাবে বেসরকারি খাতই বৃহত্তম চাকরির বাজার এবং বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। তাই আমি বিশ্বাস করি, এই অন্তর্বর্তী সরকারসহ পরবর্তী সব সরকারের অগ্রাধিকারে থাকা উচিত বাংলাদেশে মানসম্পন্ন চাকরির বাজার ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সুযোগ সৃষ্টি করা। আমাদের সবাইকে একত্র হয়ে একটি গতিশীল, উদ্যোক্তাবান্ধব ও বিকাশমান বেসরকারি খাতকে স্বীকৃতি ও সমর্থন দিতে হবে। বাণিজ্য, আমদানি, মুনাফা, বিনিয়োগ, প্রবৃদ্ধি ও চাকরি—সবই পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। বাংলাদেশের বেশির ভাগ ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তা চান দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হোক, যাতে ব্যবসার খরচ ও পরিবেশ সহজ হয়।
ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য দেশে একটি পূর্বানুমানযোগ্য ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে হবে, যার মাধ্যমে বেসরকারি খাত ন্যায্য প্রতিযোগিতা করে বিকশিত হতে পারবে। আমরা দেখেছি, কিছুসংখ্যক মানুষ বেআইনিভাবে পুরো শিল্প খাতকে একচেটিয়া দখলের পাশাপাশি রাজনৈতিক সংযোগের মাধ্যমে ব্যাংকিং খাত দখল করে রেখেছিল।
আমরা দেখছি, প্রধান উপদেষ্টা নিয়মিতভাবে সচিবদের সঙ্গে বৈঠক করছেন। একইভাবে ব্যবসায়ীদের সঙ্গেও নিয়মিত আলাপ-আলোচনার ব্যবস্থা করা দরকারসৈয়দ নাসিম মঞ্জুর, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, এপেক্স ফুটওয়্যার
দেশের এমন এক পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো যথাযথ গুরুত্ব পাচ্ছে না বলে আমরা মনে করছি। সরকারের উচিত, বেসরকারি খাতের প্রতি আরও মনোযোগ দেওয়া এবং অর্থনীতির পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় তাদের অন্তর্ভুক্ত করা। এ জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে ৩০ দিনের করণীয়–বিষয়ক কিছু সুপারিশ তুলে ধরছি।
প্রথমত, এ মুহূর্তে শিল্প খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনাকে সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। আশুলিয়ায় বন্ধ কারখানা চালু, অস্থিরতার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ, প্রয়োজনে সামরিক বাহিনীকে ক্ষমতায়ন এবং নিয়োগকর্তাদের আইনি বাধ্যবাধকতা মেনে চলার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। এ বিষয়ে সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টা সম্প্রতি যেসব ঘোষণা দিয়েছেন, সেগুলোকে আমরা স্বাগত জানাই।
দ্বিতীয়ত, সমস্যা সমাধান করতে হবে দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত ব্যবস্থা ত্রিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা বা আইএলওর বিধান অনুযায়ী, শ্রমিক নিরাপত্তা, ন্যূনতম মজুরি, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে শ্রমিক, নিয়োগকর্তা ও সরকার—এই ত্রিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের এই প্রক্রিয়া দীর্ঘকাল ধরে চলছে। কারখানা বা রাস্তা বন্ধ বা অবরোধ করে নয়, বরং ত্রিপক্ষীয় আলোচনার প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে সরকারকে শিল্পের সমস্যা উত্থাপন ও সমাধানের পথ বের করতে হবে।
তৃতীয়ত, নীতিনির্ধারণ ও প্রশাসনে সঠিক ব্যক্তিদের নিয়োগ ও ক্ষমতায়ন করতে হবে। আমরা দেখছি, বাংলাদেশ ব্যাংকে একজন যোগ্য, অভিজ্ঞ ও সংস্কার পরিকল্পনায় জড়িত ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়ায় এরই মধ্যে ইতিবাচক ফল আসতে শুরু করেছে। তেমনি আমরা মনে করি, বর্তমান সরকারে একজন শ্রম বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়া দরকার, যাঁর শ্রম সমস্যা, আইএলও এবং বাংলাদেশের শিল্প খাত সম্পর্কে বহুমুখী অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। তিনি আমাদের শ্রমমান ও কর্মপরিবেশ উন্নত করাসহ প্রতিযোগিতামূলক ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও রক্ষায় নীতিনির্ধারকদের সাহায্য করবেন।
চতুর্থত, সরকারকে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। বিদ্যুৎ খাতে সরকারের ওপর বিশাল ঋণ পরিশোধের চাপ রয়েছে। এ অবস্থায় অন্তর্বর্তী সরকারকে তার উন্নয়ন সহযোগী ও বন্ধুত্বপূর্ণ দেশের সঙ্গে মিলে জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিতে সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে হবে। জ্বালানি আমদানির জন্য ঋণপত্র ও অর্থ প্রদানের নিশ্চয়তার বিধান করতে হবে। বর্তমানে কারখানা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে দিনের অধিকাংশ সময় বিদ্যুৎ থাকছে না। এ ছাড়া গ্যাস উত্তোলনের সক্ষমতা বাড়াতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিনিয়োগ করতে হবে।
এ ছাড়া যে ব্যবসায়ীরা দুর্নীতি ও অপরাধের সঙ্গে জড়িত নন, তাঁদের ব্যবসা পরিচালনায় অর্থের প্রয়োজন। বাংলাদেশ ব্যাংক যে ৯টি ব্যাংককে সমস্যাযুক্ত ব্যাংক হয়েছে চিহ্নিত করেছে, সেসব ব্যাংকে সাধারণ ব্যবসায়ীদের হিসাবও বন্ধ রয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে তাঁদের জন্য স্বল্পমেয়াদি ঋণের ব্যবস্থা করা দরকার। কারণ, হঠাৎ তাঁদের পক্ষে অন্য ব্যাংকে যাওয়া সম্ভব নয়। আমরা দেখছি, প্রধান উপদেষ্টা সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়ার পর তা বাস্তবায়নের অগ্রগতি যাচাইয়ে নিয়মিতভাবে সচিবদের সঙ্গে বৈঠক করছেন। একইভাবে ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের সঙ্গে নিয়মিত আলাপ-আলোচনার ব্যবস্থা করা হোক। অন্তর্বর্তী সরকার অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে যে কাজ করছে, দেশে-বিদেশে তার একটি ধারাবাহিক ও বিশ্বাসযোগ্য বার্তা পৌঁছানো দরকার।
লেখক–সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর
ব্যবস্থাপনা পরিচালক, এপেক্স ফুটওয়্যার