চামড়ার হ্যাটট্রিক বিপর্যয়, নাকি সংকট উত্তরণ
করোনাকালের আগের বছর, মানে ২০১৯ সালে দেশে কোরবানি পশুর চামড়া নিয়ে হযবরল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। দাম না পেয়ে ১০-১৫ শতাংশ গরুর চামড়া সড়কে ফেলে এবং মাটিতে পুঁতে দেওয়ার ঘটনা ঘটে। আবার সময়মতো লবণ না দেওয়া, বৃষ্টি ও গরমের কারণেও ২০ শতাংশ গরুর চামড়া নষ্ট হয়ে যায়। নষ্ট হওয়া চামড়ার আর্থিক মূল্য ছিল কমপক্ষে ২৪২ কোটি টাকা।
ওই বছর ঢাকায় লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল ৪৫-৫০ টাকা। অথচ ঈদের দিন বিকেলে ঢাকায় ৩০০ থেকে ৮০০ টাকায় গরুর চামড়া বিক্রি হয়। আবার পরদিন পুরান ঢাকার পোস্তার চামড়ার আড়তে বিক্রি হয় ১৫০-২০০ টাকায়। ঢাকার বাইরের চিত্র ছিল আরও ভয়াবহ। দাম না পেয়ে অনেক মৌসুমি ব্যবসায়ী পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হন।
চামড়া নিয়ে নৈরাজ্যের পর ওই বছরের ২৮ আগস্ট সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছিলেন, ‘চামড়া নিয়ে এবার আমার শিক্ষা হয়েছে। এবারের অভিজ্ঞতা বিবেচনায় রেখে একটি পরিকল্পনা নিতে যাচ্ছি। যে পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে ভবিষ্যতে কাঁচা চামড়া সংগ্রহে বড় ধরনের কোনো সংকট তৈরি হবে না।’
কিন্তু ২০১৯ সালের শিক্ষা কাজে লাগাতে পারেননি বাণিজ্যমন্ত্রী। তাই গতবারও কোরবানির পশুর চামড়ার দামে বিপর্যয় নামে। ঈদের দিন পুরান ঢাকার চামড়া আড়ত পোস্তায় গরুর চামড়া আকারভেদে ১৫০ থেকে ৬০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ছাগলের চামড়ার দাম ছিল ২ থেকে ১০ টাকা। বিনা পয়সায়ও ছাগলের চামড়া আড়তে রেখেও গেছেন কেউ কেউ। চট্টগ্রামে গরুর চামড়া আকারভেদে ১৫০ থেকে ৪০০ টাকা বিক্রি হয়। সব মিলিয়ে অনেকটা পানির দরেই বিক্রি হয়েছে কোরবানির পশুর চামড়া। দাম না পেয়ে চামড়া নষ্টের ঘটনাও ঘটেছে।
দুবার পোড় খাওয়ার পর আবারও চামড়া নিয়ে বড় পরীক্ষার মুখোমুখি হতে চলেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী। বিপর্যয় রোধে এবার আগেভাগে বেশ কিছু ব্যবস্থা নিয়েছে তাঁর মন্ত্রণালয়। কোরবানির পর ৪৮ ঘণ্টার আগে জেলা শহর থেকে ঢাকায় যেন চামড়া ঢুকতে না পারে, সে ব্যবস্থা নিতে জননিরাপত্তা বিভাগের সহায়তা চেয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
দুবার পোড় খাওয়ার পর আবারও চামড়া নিয়ে বড় পরীক্ষার মুখোমুখি হতে চলেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী। এবারও কি চামড়া নিয়ে বিপর্যয়ের হ্যাটট্রিক হবে, নাকি বিপর্যয় রোধ করবেন, সেই চ্যালেঞ্জ মন্ত্রীর সামনে। যদিও বিপর্যয় রোধে এবার আগেভাগে বেশ কিছু ব্যবস্থা নিয়েছে তাঁর মন্ত্রণালয়। গতবারের চেয়ে প্রতি বর্গফুটের গরুর চামড়া ৫ টাকা ও ছাগলের চামড়ার দাম ২ টাকা বাড়িয়ে ধরা হয়েছে। কোরবানি ঈদ সামনে রেখে চামড়া খাতে ৫৮৩ কোটি টাকা ঋণ বিতরণের লক্ষ্য ধরা হয়েছে। কোরবানির পর ৪৮ ঘণ্টার আগে জেলা শহর থেকে ঢাকায় যেন চামড়া ঢুকতে না পারে, সে ব্যবস্থা নিতে জননিরাপত্তা বিভাগের সহায়তা চেয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ৩০ বছর পর ওয়েট ব্লু চামড়া রপ্তানির সুযোগ দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে পাঁচটি প্রতিষ্ঠান মোট এক কোটি বর্গফুট ওয়েট ব্লু চামড়া রপ্তানির অনুমতি পেয়েছে। এ ছাড়া কোরবানির চামড়ার ক্রয়-বিক্রয় তদারকির জন্য প্রতিটি বিভাগের জন্য আলাদা বিভাগীয় কমিটি করা হয়েছে। সাভার, পোস্তা, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এবং নাটোর জেলার জন্য আছে তদারকি দল।
গতবারও চামড়ার দরপতন ঠেকাতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের শেষ মুহূর্তে কাঁচা চামড়ার রপ্তানির অনুমতি ও হটলাইন চালু করেছিল। সেগুলো চামড়ার দাম বিপর্যয় ঠেকাতে কোনো কাজে দেয়নি। আড়তদার ও ট্যানারির মালিকেরা কৌশল করে চামড়ার দাম কমিয়ে দিয়েছেন।
অনেকগুলো উদ্যোগের কারণে সরকারের প্রস্তুতি খারাপ বলা যাবে না। তারপরও কি গত দুই বছরের বাজে অভিজ্ঞতা পুনরাবৃত্তি বন্ধ করা যাবে? প্রশ্নটির উত্তর কাল ঈদের দিন দুপুর থেকেই পাওয়া যাবে। তবে তার আগে কয়েকটি বিষয়ে নজর দেওয়া যাক। চলতি বছরের মতো না হলেও গতবারও চামড়ার দরপতন ঠেকাতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের শেষ মুহূর্তে কাঁচা চামড়ার রপ্তানির অনুমতি ও হটলাইন চালু করেছিল। সেগুলো চামড়ার দাম বিপর্যয় ঠেকাতে কোনো কাজে দেয়নি। আড়তদার ও ট্যানারির মালিকেরা কৌশল করে চামড়ার দাম কমিয়ে দিয়েছেন।
ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট রুখতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কী ব্যবস্থা নিচ্ছে, সেটি পরিষ্কার নয়। দাম সিন্ডিকেটে হাত দিতে না পারলে চামড়া দামের বিপর্যয় পুরোপুরি ঠেকানো যাবে না।
পানির দরে চামড়া বিক্রির জন্য গতবার আড়তদার ও ট্যানারির মালিকেরা একে অপরকে দোষারোপ করেন। আড়তদারেরা বলেছিলেন, অধিকাংশ ট্যানারির মালিক ঈদের আগে বকেয়া অর্থ দেননি। তাই অর্থাভাবে আড়তদারেরা বেশি দামে চামড়া কিনতে পারেননি। অন্যদিকে ট্যানারির মালিকদের পাল্টা অভিযোগ ছিল, আড়তদারদের কাছে তাঁদের বকেয়া নেই। আবার ঢাকার বাইরের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছিলেন, করোনায় চামড়া ও চামড়াপণ্যের রপ্তানি কমে যাওয়ার পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণ মজুতের কারণে আড়তদার ও ট্যানারির মালিকেরা যত কম দামে কেনা যায়, সেই পরামর্শ দিয়েছেন। ব্যবসায়ীদের এই সিন্ডিকেট রুখতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কী ব্যবস্থা নিচ্ছে, সেটি পরিষ্কার নয়। দাম সিন্ডিকেটে হাত দিতে না পারলে চামড়া দামের বিপর্যয় পুরোপুরি ঠেকানো যাবে না।
হাজারীবাগের মতোই হেমায়েতপুরের নদী, মাটি ও পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। পরিবেশদূষণ বন্ধ না করতে পারায় ইউরোপ-আমেরিকার ক্রেতারা সরাসরি বাংলাদেশের চামড়া কিনছে না। ফলে বাংলাদেশি চামড়ার বড় ক্রেতা হয়ে উঠেছে চীনারা। এতে করে চামড়ার দাম তুলনামূলক কম মিলছে।
করোনার মধ্যেও সদ্য বিদায়ী ২০২০–২১ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি বেড়েছে ১৮ শতাংশের মতো। বিদায়ী অর্থবছরে ৯৪ কোটি ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে। গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৭৯ কোটি ডলার। ফলে গত অর্থবছর চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি অনেকটাই ঘুরে দাঁড়িয়েছে বলা যায়।
অবশ্য ২০১৬-১৭ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি ১২৩ কোটি ডলারে পৌঁছেছিল। তারপর থেকেই চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানিতে ধস নামে। অবশ্য এ জন্য চামড়া খাতের ব্যবসায়ীরা বরাবরই সরকারকে, বিশেষ করে বিসিককে দোষ দেন। সাভারের চামড়াশিল্প নগরী পুরোপুরি প্রস্তত না করেই হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি স্থানান্তর করা হয়। ফলে হাজারীবাগের মতোই হেমায়েতপুরের নদী, মাটি ও পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। পরিবেশদূষণ বন্ধ না করতে পারায় ইউরোপ-আমেরিকার ক্রেতারা সরাসরি বাংলাদেশের চামড়া কিনছে না। ফলে বাংলাদেশি চামড়ার বড় ক্রেতা হয়ে উঠেছে চীনারা। এতে করে চামড়ার দাম তুলনামূলক কম মিলছে।
গত ১৯ বছরেও হেমায়েতপুরের চামড়াশিল্প নগরের কাজ শেষ হয়নি। কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) পুরোপুরি কার্যকর নয়। কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা শুরু থেকেই সমস্যা। ক্রোম রিকভারি ইউনিট নিয়েও আছে জটিলতা। এমন সব সমস্যা নিয়ে ধুঁকছে আধুনিক এই শিল্পনগর। কোরবানির পশুর চামড়ার দরপতনের পেছনে হেমায়েতপুরের চামড়াশিল্প নগরী পুরোপুরি প্রস্তুত না হওয়াটাও অনেকাংশে দায়ী। কারণ, হেমায়েতপুরের কারণে রপ্তানি কমেছে, সেটি মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত। সে কারণে ঈদের আগে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠকে চামড়া দাম কমানোর দাবি জোরালোভাবে তুলে ধরার সুযোগ পান ব্যবসায়ীরা। ২০১৩ সালে প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল ৮৫-৯০ টাকা, আর চলতি বছর ৪০-৪৫ টাকা।
চামড়ার বেশি দাম পেতে ইউরোপ-আমেরিকার বড় ব্র্যান্ডের কাছে সরাসরি চামড়া বেচতে হবে। সে জন্য হেমায়েতপুর চামড়াশিল্প নগরীকে আগে পরিবেশবান্ধব হতে হবে। তারপর চামড়া খাতের বৈশ্বিক সংগঠন লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ বা এলডব্লিউজির মান সনদ নিতে হবে। গত ১৯ বছরেও বিসিক সেই কাজটি করতে না পারলেও বাংলাদেশেরই তিনটি প্রতিষ্ঠান এলডব্লিউজি মানসনদ অর্জন করেছে। তাহলে এলডব্লিউজি সনদ কীভাবে পাওয়া যেতে পারে, সে জন্য নিশ্চয় বিদেশ সফরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই বিসিকের কর্মকর্তাদের।
চলতি বছর চামড়ার দামে বিপর্যয় হবে কি না, সেটি সময়ই বলে দেবে। সরকার চামড়ার যে দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে, তাতে ৩০-৩৫ বর্গফুটের বড় আকারের গরুর চামড়ার দাম হওয়ার কথা ১ হাজার ২৭৫ থেকে দেড় হাজার টাকা, আর ১৫ থেকে ২৫ বর্গফুটের ছোট ও মাঝারি আকারের গরুর চামড়ার দাম ৬৩৮ থেকে ১ হাজার ৬৩ টাকা হওয়ার কথা রয়েছে।
চামড়া খাতের ব্যবসায়ীরা যেটি জানালেন, বাংলাদেশি চামড়ার প্রধান ক্রেতা বর্তমানে চীনারা। দুই সপ্তাহ আগে তারা লকডাউন মুক্ত হয়েছে। পণ্যের জন্য তারা দেশের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছে। চাহিদা বাড়তে থাকায় ইতিমধ্যে ট্যানারির মালিকেরা প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া ৪৮ টাকায় কিনছেন। ভালো চামড়া হলে ৫৫ টাকাও দিতে রাজি আছেন। ফলে বিপর্যয়ের আশঙ্কা চলতি বছর কিছুটা কম।
ব্যবসায়ীদের এই কথা শুনলে বাণিজ্যমন্ত্রী আপাতত স্বস্তি পেতে পারেন। তবে কাল আসল পরীক্ষা। দুই বছর আগে মন্ত্রী কী শিক্ষা নিলেন, সেটাই দেখার অপেক্ষায় সবাই।