আগে প্রবৃদ্ধি ঠিক করা হয়, পরে হিসাব মেলানো হয়

গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির সাময়িক হিসাব দিয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। প্রবৃদ্ধির এই হিসাব বাস্তবের সঙ্গে মিলছে না বলে দাবি অর্থনীতিবিদ ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর। প্রশ্ন উঠেছে বিবিএসের সক্ষমতা নিয়েও। এ ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে বিবিএসের তথ্য-উপাত্ত ঘষামাজা করা নিয়ে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের অভিযোগও আছে। এসব নিয়ে কথা বলেছেন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সাবেক সচিব রীতি ইব্রাহীম। অনুলিখন করেছেন জাহাঙ্গীর শাহ
রীতি ইব্রাহীম
ছবি: সংগৃহীত

গত অর্থবছরের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) সাময়িক হিসাব দিয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। গত ৩১ মার্চ পর্যন্ত (অর্থবছরের প্রথম নয় মাস) পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এ হিসাব করা হয়েছে। ধরে নেওয়া যায়, এই সাময়িক হিসাবটি অন্য বছরের মতোই স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় দিয়েছে বিবিএস। কিন্তু করোনার কারণে অর্থবছরের শেষ তিন মাস (এপ্রিল-জুন) তো অর্থনীতির চাকাই ঘোরেনি। প্রবাসী আয় হয়তো বেড়েছে। কিন্তু সেখানেও দুঃখজনক খবর আছে। অনেকের চাকরি চলে গেছে, অনেককে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। এ অবস্থায় বিবিএস প্রবৃদ্ধির যে হিসাব দিয়েছে, পুরো অর্থবছরে অতটা জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে না। তাই বিবিএসের হিসাবকে অতিরিক্ত প্রাক্কলন বলা চলে।

আমি তরুণ বয়সে দেখেছি, জিডিপি কত হবে, তা আগে ঠিক করা হয়। পরে ‘ব্যাক ক্যালকুলেশন’ করে হিসাব ঠিক করা হয়। এটা আগে ছিল। তবে আমি যে কয়েক বছর দায়িত্বে ছিলাম, তখন আমি এই ধরনের কাজ করতে দিইনি। বিশেষ করে আদমশুমারির সময় আমি নির্দেশ দিয়েছি, কোনো ইরেজার (ঘষামাজা করতে ব্যবহৃত) ব্যবহার করা যাবে না। মাঠপর্যায়ে যেসব তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যাবে, তাই ব্যবহার করতে হবে। আমি বুঝি না, জিডিপি নিয়ে এত প্রভাব খাটানো হয় কেন? জিডিপিই সবকিছু নয়। নারীর ক্ষমতায়ন, স্বাস্থ্য—এসব সামাজিক খাতের উন্নয়নও বিবেচনায় আনতে হবে।

আরও পড়ুন

আমি বলছি না, বিবিএসের কোনো দুর্বলতা নেই। সংস্থাটির দুর্বলতা অবশ্যই আছে। সেখানে পরিসংখ্যান থেকে পাস করা লোক খুবই কম। সবচেয়ে বড় কথা, যাঁরা বিবিএসকে পরামর্শ (গাইড) দেবেন, সেই মানের পরিসংখ্যানবিদ নেই। পরামর্শদাতারা সবাই প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা। তাই বিবিএসকে পরামর্শ দেওয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট দুর্বলতা আছে। আবার মাঠপর্যায়ে তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতিতেও দুর্বলতা আছে। সবাই যেন বিবিএসের তথ্য-উপাত্তকে অবহেলা করেন। বিবিএসকে পরামর্শ দেওয়ার জন্য পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ করা হয়েছিল। এটি ভালো উদ্দেশ্যে করা হয়েছে। কিন্তু ভালো উদ্দেশ্য এখন সফল হচ্ছে না। বিবিএসে যাঁরা অনেক দিন কাজ করেছেন, তাঁরা পরিসংখ্যান নিয়ে অনেক কিছু জানেন। তাঁদের একসময় পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগে বদলি করা হয়। বিবিএসে নতুন কর্মকর্তা পাঠানো হয়, যাঁরা কিছুই জানেন না। আমার মতে, বিবিএসকে শক্তিশালী করতে উদ্যোগ নিতে হবে।

আমি তরুণ বয়সে দেখেছি, জিডিপি কত হবে, তা আগে ঠিক করা হয়। পরে ‘ব্যাক ক্যালকুলেশন’ করে হিসাব ঠিক করা হয়।
রীতি ইব্রাহীম, সাবেক সচিব

পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের এখন আর দরকার নেই। বিবিএসে অনেক পরিসংখ্যানবিদ নিয়োগ দিতে হবে, তাঁদের উচ্চতর প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তথ্য–উপাত্ত ব্যবস্থাপনাকে শক্তিশালী করতে একটি পরিসংখ্যান কমিশন গঠন করা উচিত। এ ছাড়া মাঠপর্যায় থেকে সততার সঙ্গে বিবিএস কর্মকর্তাদের তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রেও বিবিএসের ওপর রাজনৈতিক চাপ থাকে। এই চাপ সব সময় ছিল। আমি যখন বিবিএসে ছিলাম, তখন মাঠপর্যায়ে যা তথ্য পেতাম তাই প্রতিবেদনে দিতাম। সেটি করলে সরকারের সুনজরে থাকা যায় না। এ জন্য সংস্থাটির কর্মকর্তারা সরকারের কথা শোনেন। সরকার যা চায়, তাই করে দেন।

আরও পড়ুন