যেভাবে রাশিয়া আর যুক্তরাষ্ট্র দুই দেশেরই বন্ধু ভিয়েতনাম
উত্তর কোরিয়ার পর ভিয়েতনাম সফর করলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। আর এর মাধ্যমে ভিয়েতনাম দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার একমাত্র দেশ হিসেবে একটি অর্জনও করে ফেলেছে। গত এক বছরে দেশটি চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার শীর্ষ নেতাদের অতিথি হিসেবে পেয়েছে। বিশ্বে এই তিন দেশ এখন সবচেয়ে বড় সামরিক শক্তির অধিকারী।
নিকেই এশিয়া জানায়, গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় পুতিন ও ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট তো লাম হ্যানয়ে এক বৈঠক করেন। এরপর দুই নেতা শান্তির গুরুত্ব নিয়ে কথা বলেন। একই সঙ্গে দেশ দুটির পারস্পরিক সম্পর্ক যে একটি অগ্রাধিকারের জায়গা—সেটি জোর দিয়ে উল্লেখ করেন বলে ভিয়েতনামের রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম জানায়।
সফরের সময় ১১টি বিষয়ে সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এসবের মধ্যে রয়েছে শিক্ষা, পারমাণবিক প্রযুক্তিবিষয়ক গবেষণা, রোগনিয়ন্ত্রণ, তেল অনুসন্ধান ও ন্যায়বিচার। রুশ যেসব কোম্পানি এই সহযোগিতার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে, তাদের মধ্যে রয়েছে পারমাণবিক প্রযুক্তি কোম্পানি রসাটম, প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি নোভাটেক ও রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত তেল কোম্পানি জারুবেজনেফট।
রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধে ভিয়েতনামের ‘ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান’ ও অন্যের ব্যাপারে নাক না গলানোর নীতির প্রশংসা করেন পুতিন।
বিশ্লেষকেরা নিকেই এশিয়াকে বলেন, সেই ঠান্ডাযুদ্ধের সময় থেকে দুই দেশের মধ্যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে। দুই দেশই দেখাতে চায় যে নিরাপত্তা সহযোগিতার ক্ষেত্রে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বিকল্প রয়েছে। তবে ভিয়েতনাম একই সঙ্গে দেখাচ্ছে যে কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র ও গণতান্ত্রিক দেশের মধ্যে কীভাবে ভারসাম্য রক্ষা করে চলা যায়।
পুতিনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ক্রিমিনাল কোর্টের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে। সে কারণে তিনি খুব কম দেশই সফর করেন। সত্যিকার অর্থে ভিয়েতনাম রাশিয়ার এতই ঘনিষ্ঠ একটি রাষ্ট্র, যেটি পুতিনের বিরল একটি সফরের স্বাগতিক দেশ হতে পেরেছে। যুক্তরাষ্ট্রও পুতিনকে একঘরে করার জন্য দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করে চলেছে।
আবার যেসব দেশ ইউক্রেনকে সাহায্য দিচ্ছে ভিয়েতনাম তাদেরও ঘনিষ্ঠ। পশ্চিমা এসব দেশ রাশিয়ার ওপর যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, হ্যানয় তারও নিন্দা করেনি, যেমনটা বেইজিং করেছে।
ভিয়েতনাম ও যুক্তরাষ্ট্র
ভিয়েতনামের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটি ভিয়েতনামি পণ্যের সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার। গত সেপ্টেম্বরে হ্যানয় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক দুই ধাপ উঁচু করেছে। ওয়াশিংটনের সঙ্গে হ্যানয়ের সম্পর্ক এখন সর্বোচ্চ ধাপে রয়েছে।
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ভিয়েতনামের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। গতকাল শুক্রবার ও আজ শনিবার মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড্যানিয়েল ক্রিটেনব্রিঙ্কের হ্যানয় সফর করার কথা। অর্থাৎ ভ্লাদিমির পুতিনের সফরের পরপরই একজন শীর্ষস্থানীয় মার্কিন কর্মকর্তার সেখানে যাওয়ার কথা। রয়টার্স জানিয়েছে, এই সফর ভিয়েতনামের সঙ্গে অংশীদারত্ব ও একটি খোলামেলা ইন্দো–প্যাসিফিক অঞ্চলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গীকারকে প্রতিফলিত করছে।
ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপিং ইকোনমিকসের গবেষক ফুতাবা ইশিযুকা বলেন, ভিয়েতনামের বৈদেশিক নীতি নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর যে উদ্বেগ আছে, তা আরও জোরদার হতে পারে, এমন একটা ঝুঁকি রয়েছে।
ইউক্রেন নিয়ে ভিয়েতনামের অবস্থান হলো মস্কোর সঙ্গে আলোচনার সময় ‘যুদ্ধ’ শব্দটা এড়ানো। একই সঙ্গে নিজস্ব প্রতিরক্ষা চাহিদার জন্য ভিয়েতনাম রাশিয়ার অস্ত্রের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন যে ইউক্রেনে যুদ্ধ চালানোর কারণে মস্কো অস্ত্র বিক্রিতে কতটা সক্ষম, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। তবে আবার অনেকের মতে, রাশিয়ার অনেক অর্থের দরকার।
আইএসইএএস-ইউসোফ ইসহাক ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ ফেলো ইয়ান স্টোরি বলেন, আলোচনা মূল বিষয়টি হলো রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমা যে আর্থিক নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, তা এড়িয়ে ভিয়েতনাম কীভারে রাশিয়ার তৈরি অস্ত্রের দাম পরিশোধ করতে পারে।
রাশিয়ার ওপর দেওয়া বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা উত্তর কোরিয়া ও চীন ঠিকঠাক মতো মানছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ভিয়েতনাম এই দুই দেশের পর তৃতীয় দেশ হিসেবে ভ্লাদিমির পুতিনকে নিজ দেশে স্বাগত জানিয়েছে। এটি হয়েছে এমন সময়ে, যখন জি–৭ ভুক্ত দেশগুলো চীনের ওপর আরও নিষেধাজ্ঞা ও চাপ দেওয়ার চিন্তাভাবনা করছে।
কিন্তু ভিয়েতনাম রাশিয়া ও পশ্চিমা বিশ্ব–সমর্থিত ইউক্রেনের মধ্যে ‘বিদীর্ণ’ হচ্ছে। কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের জ্যেষ্ঠ ফেলো জশ কুরলানৎজিক বলেন, এই দুই দেশের সঙ্গেই ভিয়েতনামের গভীর সম্পর্ক রয়েছে সেই সোভিয়েত আমল থেকে।
ইউনিভার্সিটি অব মেলবোর্নের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের অধ্যাপক লান আন হোয়াং জানান, ১৯৫০-এর দশকে ভিয়েতনাম থেকে অনেক এতিম শিশু ও শিক্ষার্থী সোভিয়েত ইউনিয়নের অনেক অঞ্চলে গিয়েছিলেন। তাঁরা ১৯৯০-এর দশকে পেরেস্ত্রোইকা শীর্ষক সংস্কার কর্মসূচির সময় ব্যবসা করে অর্থ আয় করেছেন। তাঁদেরই কেউ কেউ পরে ভিন্ন গ্রুপ কিংবা ভিয়েতজেটের মতো প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন।
অর্থনৈতিক সহযোগিতা
রাশিয়ার পররাষ্ট্রনীতির বিশ্লেষক নিকোলা মিকোভিচ মনে করেন, ইউক্রেনের কারণে মস্কো ভিয়েতনামকে বড় ধরনের অস্ত্র সরবরাহ করার মতো অবস্থায় নেই। তিনি বলেন, পুতিনের সফর সামরিক সহযোগিতা নয়, বরং অর্থনৈতিক সহযোগিতা থেকে অনুপ্রাণিত। একই সঙ্গে দুই বছর যাবৎ রাশিয়া পূর্ব দিকে দৃষ্টি দিচ্ছে, গুরুত্বপূর্ণ সব অপশ্চিমা শক্তির সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াচ্ছে।
জশ কুরলানৎজিক মনে করেন, ভিয়েতনামে পুতিনের সফরের মাধ্যমে রাশিয়া একই সঙ্গে দেখাতে চাইছে যে তারা একঘরে হয়ে পড়েনি।