ঈদের কেনাকাটায় ইস্টার্ন প্লাজার জৌলুশ আর নেই

ইস্টার্ন প্লাজায় আগের সেই রমরমা ব্যবসা এখন আর নেই। আজ সোমবার তোলাছবি: প্রথম আলো

নব্বই দশকের শুরুতে রাজধানীর সবচেয়ে আধুনিক ও জনপ্রিয় মার্কেট ছিল ইস্টার্ন প্লাজা। পুরো মার্কেট ছিল আভিজাত্যে মোড়ানো এবং বিলাসবহুল পণ্যের সমাহার। ওই সময়ে এই ইস্টার্ন প্লাজায় চলন্ত সিঁড়ি (এস্কেলেটর) ও ক্যাপসুল লিফট ছিল। ঈদের সময় এই মার্কেটে ভিড় লেগেই থাকত। দেদার বেচাকেনাও চলত। তখনকার রাজধানীর সচ্ছল পরিবারের তরুণ-তরুণীদের কাছে ঈদের কেনাকাটায় প্রথম পছন্দ ছিল ইস্টার্ন প্লাজা। এমনকি তখন শুধু ঘোরাঘুরির জন্য ইস্টার্ন প্লাজায় আসতেন অনেক তরুণ-তরুণী। শুধু ঢাকাবাসী নয়; ঢাকার আশপাশের মানুষজনও এই মার্কেটে কেনাকাটার পাশাপাশি ঘুরতেও আসতেন।

কিন্তু ইস্টার্ন প্লাজার আগের জৌলুশ আর নেই। গত তিন দশকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বহুতল আধুনিক বিপণিবিতান নির্মাণ হয়েছে। রাজধানীবাসী সেসব মার্কেটে ঝুঁকছে। তবে ইস্টার্ন প্লাজার সেই জৌলুশ একেবারেই ম্লান হয়নি।

এখনো মার্কেটটি তার নিজ গুণে ক্রেতাদের আস্থা ধরে রেখেছে। ১৯৯২ সালে ৪৬২টি দোকান নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় মার্কেটটি। পুরো মার্কেটটি ৫৫ হাজার বর্গফুট। যেখানে প্রতিটি দোকানের ভাড়া জায়গা ও প্রকারভেদে ১০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকার মধ্যে।

মার্কেটটির ব্যবসায়ীরা বলছেন, নব্বইয়ের দশকজুড়ে জমজমাট ব্যবসা করেছে ইস্টার্ন প্লাজা। তবে পরে বসুন্ধরা শপিং মলসহ অন্যান্য মার্কেট হওয়ায় এই মার্কেটের চাহিদায় কিছুটা ভাটা পড়েছে। তাঁদের মতে, ২০১২ সাল পর্যন্ত রমরমা ব্যবসা করেছেন ইস্টার্ন প্লাজার ব্যবসায়ীরা। তবে এখনো পুরোপুরি জৌলুশ হারায়নি মার্কেটটি।

ইস্টার্ন প্লাজায় আগের সেই রমরমা ব্যবসা এখন আর নেই। আজ সোমবার তোলা
ছবি: প্রথম আলো

ইস্টার্ন প্লাজার শপ ওনার্স কো-অপারেটিভ সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক শাহীন মিয়াজী বলেন, প্রতিদিন এই মার্কেটে গড়ে ১ থেকে ৩ কোটি টাকার পণ্য বিক্রি হয়। তবে ঈদ মৌসুমে সেই বিক্রি প্রায় ৫ কোটি টাকা হয় বলে জানিয়েছেন তিনি। তিনি জানান, এই মার্কেটে মোট ৩ হাজার মানুষ কর্মরত আছেন। তিনি আরও জানান, ১৯৯৫ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত এই মার্কেটের জৌলুশ সর্বোচ্চ পর্যায়ে ছিল। তবে এখনো হারিয়ে যায়নি এই মার্কেট। এখনো প্রতিদিন এই মার্কেটে গড়ে ২ হাজার মানুষ কেনাকাটা করতে আসেন। ঈদের সময় সেই সংখ্যা ৫ হাজার ছাড়িয়ে বলে জানিয়েছেন তিনি।

ক্রেতা-বিক্রেতারা যা বলেন

বেসরকারি একটি ব্যাংকে কর্মরত রয়েছেন মুনিরা বেগম। তিনি বলেন, রাজধানীর প্রথম চলন্ত সিঁড়ি স্থাপন করা হয় এই ইস্টার্ন প্লাজায়। এ সিঁড়ি নিয়ে তখনকার আগতদের মাঝে ব্যাপক আগ্রহ ছিল। বিয়ে কিংবা ঈদের কেনাকাটার জন্য অনেকেই ইস্টার্ন প্লাজায় নির্ভরশীল ছিল। ২০০৫ সালে আমার বিয়ের সব কেনাকাটা এই মার্কেট থেকে করেছি। তবে এখন ঈদের সময় কিছুটা ভিড় থাকলেও অন্য সময়ে ক্রেতা দেখা যায় না।

মার্কেটের শুরু থেকে প্রসাধনী সামগ্রীর ব্যবসা করেন রফিকুল ইসলাম। আগে গাজীপুর ও টঙ্গী থেকেও তাঁর কাছে কেনাকাটা করতে আসত মানুষ। শুরুতে প্রসাধনী সামগ্রীর ব্যবসা করলেও এখন ব্যবসা করছেন খেলনাসামগ্রীর। তিনি জানান, দুই বছর আগেও দিনে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকার খেলনা বিক্রি করলেও এখন গড়ে ৪ থেকে ৮ হাজার টাকা দৈনিক বিক্রি হয়।

ইস্টার্ন প্লাজায় আগের সেই রমরমা ব্যবসা এখন আর নেই। আজ সোমবার তোলা
ছবি: প্রথম আলো

ছোট বেলা থেকেই বাবা–মায়ের সঙ্গে ইস্টার্ন প্লাজায় আসতেন রাজধানীর ইস্কাটনের বাসিন্দা বাবুল মৃধা। তিনি বলেন, ‘আমি যখন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়াশোনা করতাম, তখন বড় ভাইদের সঙ্গে এখানে চলন্ত সিঁড়ি দেখতে আসতাম। একবার ওপরে উঠতাম আবার নিচে নামতাম। এখনো ঈদের কেনাকাটা করতে আমার পরিবার নিয়ে এখানেই আসি। তাঁর মতে, এলাকাভিত্তিক অনেক বিপণিবিতান হওয়ায় এবং যানজট বেড়ে যাওয়ায় এখন আর অনেকে এখানে আসতে চান না।

২৭ বছর ধরে এই মার্কেটে ব্যবসা করেন সুপার নোভার স্বত্বাধিকারী মো. ওয়াহিদুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘করোনার আগে ঈদ মৌসুমে এক মাসে ৫০ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি করেছি। তবে বর্তমানে এক মাসে ২০ লাখ টাকাও বিক্রি হয় না।’

ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাজধানীর নিরাপত্তা শঙ্কার কারণে সন্ধ্যার পর ক্রেতা সমাগম আগের তুলনায় অনেকটা কমেছে। ব্যবসায়ীরা আরও বলছেন, করোনায় অনলাইনে বিক্রি বেড়ে যাওয়ায় আমাদের বিক্রিতে কিছুটা ভাটা পড়েছে।

মনরেখ শাড়ীজ-এর ব্যবস্থাপক শাহ আলম বলেন, আগে ঈদের সময় আমাদের এত ক্রেতা সমাগম হতো যে আমরা খাওয়ার সময় পেতাম না। তখন গড়ে প্রতিদিন ৪ থেকে ৫ লাখ টাকার বিক্রি করতাম। এখন প্রতিদিন ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা বিক্রি হয়।

ইস্টার্ন প্লাজায় আগের সেই রমরমা ব্যবসা এখন আর নেই। আজ সোমবার তোলা
ছবি: প্রথম আলো

এখন যা পাওয়া যায়

১০ তলাবিশিষ্ট ইস্টার্ন প্লাজার প্রথম তলায় পাওয়া যায় দেশি–বিদেশি প্রসাধনী সামগ্রী, ক্রোকারিজ পণ্য, বাচ্চাদের খেলনাসহ ইলেকট্রনিক আইটেমের দোকান। দ্বিতীয় তলায় মিলবে সব ধরনের কাপড়। যদিও মেয়েদের পোশাকের আধিক্য এখানে বেশি। বিয়ের শাড়ি, থানকাপড়, লেহেঙ্গা থেকে শুরু করা সাধারণ মানের সুতি সালোয়ার–কামিজও পাওয়া যায় দ্বিতীয় তলার দোকানগুলোতে। তৃতীয় তলায় রয়েছে শার্ট-প্যান্টসহ বাচ্চাদের জামাকাপড়। আরও আছে বাচ্চাদের নানা ধরনের খেলনা। চতুর্থ তলার পুরোটাজুড়ে গয়না ও সোনা–রুপার দোকানের পাশাপাশি জুতার দোকান আছে। এই তলার একেবারে পেছনে রয়েছে খাবারের দোকান। পঞ্চম তলায় এখন মোবাইল মার্কেট ও মোবাইল সার্ভিসিংয়ের দোকান। আর ৭ থেকে ১০ তলায় রয়েছে ডাক্তারের চেম্বার ও নানা ধরনের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান।