চুক্তিতে পোশাক রপ্তানি বাড়ছে, ঝুঁকিও বাড়ছে
বর্তমানে প্রায় ৭০ শতাংশ তৈরি পোশাকের ক্রয়াদেশ ঋণপত্রের পরিবর্তে চুক্তিতে দেওয়া হচ্ছে। বাকিটা ঋণপত্রের মাধ্যমে সম্পন্ন হচ্ছে।
তৈরি পোশাকের ক্রয়াদেশের বিপরীতে ব্যাংকের ঋণপত্রের মাধ্যমে নিশ্চয়তা দেয় বিদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এ নিয়মে রপ্তানিকারকেরা একধরনের আইনি সুরক্ষাও পেতেন। তবে কয়েক বছর ধরে তৈরি পোশাকের ক্রয়াদেশের বিপরীতে ঋণপত্র আসা আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। ঋণপত্রের বদলে লিখিত চুক্তিপত্রের মাধ্যমে ক্রয়াদেশ দেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে বিদেশি ক্রেতাদের মধ্যে।
পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তা ও ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, খরচ কমাতে তৈরি পোশাকের বড় ব্র্যান্ড বা ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণপত্র দেওয়া বন্ধ করেছে। তাতে বর্তমানে পোশাক খাতের তিন-চতুর্থাংশ ক্রয়াদেশ চুক্তির মাধ্যমে আসছে। এর ফলে রপ্তানিকারকদের আইনি সুরক্ষার জায়গাটি ক্রমেই দুর্বল হচ্ছে। সার্বিকভাবে তৈরি পোশাক রপ্তানির অর্থ দেশে আসার ক্ষেত্রেও ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আইনি সুরক্ষা কীভাবে নিশ্চিত করা যায়, সে বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং বিজিএমইএ-বিকেএমইএর যৌথভাবে কাজ করা প্রয়োজন বলে মনে করেন তাঁরা।
এ বিষয়ে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, দেশে অনেক আগে থেকে চুক্তির মাধ্যমে ক্রয়াদেশ আসে। তবে এখন সেটি বেড়েছে। বহু বছরের ব্যবসায়িক সম্পর্ক আছে এমন সরবরাহকারীকে বর্তমানে বিদেশি ব্র্যান্ডগুলো চুক্তির মাধ্যমে কাজ দিচ্ছে। যদিও অনেক ক্ষেত্রে পণ্য জাহাজীকরণের আগে ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের ঋণপত্র চলে আসছে।
সৈয়দ মাহবুবুর রহমান আরও বলেন, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তৈরি পোশাকের মোট রপ্তানির ৭০ শতাংশ ঋণপত্র আর বাকিটা চুক্তির আওতায় হতো। বর্তমানে সেটি উল্টো হয়ে গেছে। মানে ৩০ শতাংশ ঋণপত্র আর বাকি ৭০ শতাংশ চুক্তির মাধ্যমে হচ্ছে। বড় ব্র্যান্ড বা ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান এবং দেশীয় শীর্ষস্থানীয় রপ্তানিকারকদের ক্ষেত্রে এতে হয়তো সমস্যা হচ্ছে না। যদিও ছোট ক্রেতা ও তুলনামূলক ক্ষুদ্র-মাঝারি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে চুক্তির বিপরীতে পোশাক রপ্তানিতে জালিয়াতির ঘটনা ঘটছে।
করোনাকাল ছাড়া বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি প্রতিবছরই বেড়েছে। আবার রপ্তানির অর্থ দেশে প্রত্যাবাসন না হওয়ার হারও বাড়ছে। এর কারণ হচ্ছে অর্থ পরিশোধে ক্রেতাদের বিলম্ব, ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের জাল-জালিয়াতি ইত্যাদি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, বিদায়ী ২২-২৩ অর্থবছরের অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত ২ হাজার ৪৯৭ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে। তার বিপরীতে ১ হাজার ৮৬৬ কোটি ডলার দেশে এসেছে। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছে ৪ হাজার ২৬১ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক। ওই বছর ৩ হাজার ২৬৯ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি আয় দেশে এসেছে। তার আগের বছরে রপ্তানি হয়েছিল ৩ হাজার ১৪৫ কোটি ডলারের পোশাক। যদিও সেবার পোশাকের রপ্তানি আয় দেশে এসেছিল ২ হাজার ৫০১ কোটি ডলার।
জানতে চাইলে নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম প্রথম আলোকে বলেন, ঋণপত্র না দিয়ে চুক্তিপত্রের মাধ্যমে ক্রয়াদেশ দেওয়ার প্রবণতা বন্ধ করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংককে এ বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। ঋণপত্র ছাড়া শুধু চুক্তিপত্রের মাধ্যমে তৈরি পোশাক রপ্তানি ঝুঁকিপূর্ণ। এতে পণ্য রপ্তানির পর অর্থ দেশে না আসা কিংবা ক্রেতাদের অন্যায্য মূল্যছাড় দাবি করার মতো ঘটনা ঘটার আশঙ্কা বেশি থাকে।
চুক্তির বিপদ করোনাকালে ভালোই টের পেয়েছেন উদ্যোক্তারা। করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে সংক্রমণ রোধে লকডাউন জারি করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের অনেক দেশ। দোকানপাটও বন্ধ হয়ে যায়। ২০২০ সালের মার্চ থেকে একের পর এক ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিতাদেশ হতে শুরু করে। ওই সময় সব মিলিয়ে ৩১৮ কোটি ডলারের ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত হয়। তাতে মালিকেরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। তখন দুর্বল চুক্তির কারণে বিদেশি ক্রেতারা ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত করলেও কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেননি এ দেশের উদ্যোক্তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিদেশে পণ্য আমদানির ঋণপত্র খুলতে চার্জ বা মাশুল দিতে হয়। মার্জিন হিসেবে মোটা অঙ্কের অর্থও দিতে হয়। এই অর্থ দীর্ঘ সময়ের জন্য আটকা থাকে। অন্যদিকে চুক্তি করতে কোনো অর্থ লাগে না। চুক্তি অনুযায়ী পণ্য পাঠানোর পর অর্থ পাঠিয়ে দেয় ক্রেতা প্রতিষ্ঠান। তবে এই ব্যবস্থায় কিছু জটিলতাও আছে। শুরুতে মাস্টার বা মূল ঋণপত্র না আসায় ব্যাংকগুলো ব্যাংক টু ব্যাংক ঋণপত্র খুলত না। এখন বড় ক্রেতা ও শীর্ষ রপ্তানিকারকদের ক্ষেত্রে এ বিষয়ে নমনীয় হয়েছে ব্যাংক। যদিও ছোট ও মাঝারি ক্রেতা-বিক্রেতারা এ সুবিধা পাচ্ছে না।
জানতে চাইলে প্লামি ফ্যাশনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুল হক প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্বজুড়েই ক্রয়াদেশের বিপরীতে ঋণপত্রের গ্যারান্টি দেওয়ার প্রবণতা উঠে যাচ্ছে। এতে আইনি ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে সত্য। কারণ, পণ্য জাহাজীকরণের পর কোনো ক্রেতা অর্থ না দিলে মামলা-মোকদ্দমার ক্ষেত্রে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান কিছুটা দুর্বল অবস্থায় থাকে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আইনি ব্যবস্থা কীভাবে শক্তিশালী করা যায়, সেটি নিয়ে চিন্তাভাবনা করা দরকার। তার আগে এ বিষয়ে কড়াকড়ি আরোপ করা ঠিক হবে না। কারণ, সে ক্ষেত্রে রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হবে। তিনি আরও বলেন, চুক্তিতে ক্রয়াদেশ নেওয়ার ক্ষেত্রে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানেরও দায়িত্ব রয়েছে। যাচাই–বাছাই না করে হুটহাট অপরিচিত কোনো বিদেশি প্রতিষ্ঠানের ক্রয়াদেশ নেওয়ার ক্ষেত্রে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানকে সতর্ক থাকতে হবে। তাহলেই ঝামেলা এড়ানো যাবে।