ছোট–মাঝারি ব্যবসার দিনকাল
সংকটে সক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে চশমার ব্যবসা
দেশে চশমা বিক্রির খুচরা দোকান আছে ১০ হাজারের বেশি। সব মিলিয়ে চশমার বার্ষিক বাজার প্রায় সাড়ে ৮০০ কোটি টাকার।
করোনার ধাক্কা কাটিয়ে গত বছরের শুরু থেকে দেশে চশমার বাজারে বেচাকেনা ভালোই বেড়েছিল। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর দেশে ডলার–সংকট দেখা দিলে চশমার ব্যবসা আবারও মার খায়। তাতে চশমার পাওয়ার বা কার্যক্ষমতার মতো ব্যবসার কার্যক্ষমতাও কমে গেছে। চশমা ব্যবসায়ীরা বলছেন, ঋণপত্র খুলতে না পারা ও আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসা কমে গেছে।
এ ছাড়া চলমান অর্থনৈতিক সংকটের কারণেও চাহিদা কমেছে চশমার। সব মিলিয়ে তাই এই খাতের ব্যবসায়ীরা পড়েছেন বিপাকে। খাত–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, গত এক বছরে দেশে চশমার আমদানি খরচ ২০ শতাংশের মতো বেড়েছে। আর বাজারে চশমার দামও ২০ থেকে ৩০ শতাংশ বেড়েছে। তার বিপরীতে চশমার বিক্রি কমেছে ১৫-২০ শতাংশ।
বর্তমানে কোনোরকমে ব্যবসায় টিকে আছি আমরা। বড় অঙ্কের কোনো ঋণপত্র খোলা যাচ্ছে না। ফলে আমদানি অনেক কমে গেছে। এ খাতের ব্যবসায়ীরা এখন আগে আমদানি করা পণ্য বিক্রি করে কোনো রকমে ব্যবসা ধরে রেখেছেন।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, ডলার–সংকটের কারণে গত বছরের মাঝামাঝি থেকে ব্যাংকগুলো ঋণপত্র খোলা কমিয়ে দিয়েছে। কয়েক মাস ধরে ছোট অঙ্কের আমদানি ঋণপত্র খোলা গেলেও ব্যাংকগুলো দায় পরিশোধে বাড়তি সময় নেওয়ায় পণ্য আমদানিতে বিলম্ব হচ্ছে। গত বছরের জুন থেকে প্রতিটি আমদানি চালান দেশে আনতে গড়ে তিন-চার মাস বেশি সময় লাগছে। পাশাপাশি ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে আমদানির পরিমাণও কমে গেছে।
বাংলাদেশ চশমাশিল্প ও বণিক সমিতির সাবেক সভাপতি ও বাংলাদেশ লেন্স সমিতির সভাপতি মো. ছানাউল্লাহ খান প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমানে কোনো রকমে ব্যবসায় টিকে আছি আমরা। বড় অঙ্কের কোনো ঋণপত্র খোলা যাচ্ছে না। ফলে আমদানি অনেক কমে গেছে। এ খাতের ব্যবসায়ীরা এখন আগে আমদানি করা পণ্য বিক্রি করে কোনো রকমে ব্যবসা ধরে রেখেছেন।
দেশে স্থানীয়ভাবে চশমা তৈরি শিল্পের তেমন বিকাশ ঘটেনি। হাতে গোনা কয়েকটি দেশীয় প্রতিষ্ঠান রয়েছে এ খাতে। আর রোদচশমা (সানগ্লাস), পাওয়ার লেন্স (চিকিৎসক নির্দেশিত), ফ্রেমসহ চশমার বিভিন্ন উপকরণের অধিকাংশই আমদানি হয়। সব মিলিয়ে চশমার বার্ষিক বাজার প্রায় সাড়ে ৮০০ কোটি টাকার।
চশমাশিল্প ও বণিক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, দেশে চশমা বিক্রির খুচরা দোকান আছে ১০ হাজারের বেশি। আর রাজধানীর পাটুয়াটুলী, মগবাজার, মিরপুরসহ কয়েকটি এলাকায় রয়েছে পাইকারি বাজার। প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে মিলিয়ে এই খাতে লক্ষাধিক লোক কাজ করেন।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, দেশে বছরে আনুমানিক ১ কোটি ৬০ লাখ পিস চশমার লেন্স বিক্রি হয়। আর ফ্রেম বিক্রি হয় লেন্সের তুলনায় অর্ধেক। এ ছাড়া বছরে ৩ লাখ ৬০ হাজার কন্ট্যাক্ট লেন্স বিক্রি হয়। আর বছরে আমদানি করা রোদচশমা বিক্রি হয় প্রায় ১৫ লাখ পিস।
তবে কয়েক মাস ধরে বেচাকেনা কম থাকায় চশমার দোকানের কর্মীরাও কষ্টে আছেন বলে জানান ব্যবসায়ী ছানাউল্লাহ খান। তিনি বলেন, ‘বাজারে সব ধরনের জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। কিন্তু বেচাকেনা কমে যাওয়ায় আমরা কর্মীদের বেতনও বাড়াতে পারছি না।’
বনশ্রী এলাকার চশমার দোকান রে-বন এক্সপ্রেস আগে নিজেরাই চশমা পণ্য আমদানি করত। ছয় মাস ধরে নতুন কোনো আমদানি করতে না পারায় স্থানীয় পাইকারি বাজার থেকে পণ্য কিনে বিক্রি করছে তারা।
প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী জাম্মাদ মো. মেজবাহ প্রথম আলোকে বলেন, আমদানি করতে না পারায় স্থানীয় পাইকারি বাজার থেকে বাড়তি দামে পণ্য কিনে ব্যবসা চালাতে হচ্ছে। নিজে আমদানি করলে যে পণ্য ১০০ টাকায় পেতাম, সেটা এখন ১৫০ টাকা হয়ে গেছে। আর বেচাকেনা নেমে এসেছে প্রায় অর্ধেকে। আগে মানুষ একটু বেশি দামের ফ্রেম ও লেন্স কিনত। এখন খুব প্রয়োজন ছাড়া তারা চশমাই কিনছেন না। যাঁরা কিনছেন, তাঁরাও কিনছেন সাধারণ দামের চশমা।
রাজধানীর পান্থপথের স্ট্যান্ডার্ড অপটিকসের বিক্রয়কর্মী আবুল কায়েস বলেন, মানুষ আগের চেয়ে চশমা ও তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পণ্য অনেক কম কিনছেন। গত তিন মাসে বেচাকেনা বলা যায় এক-তৃতীয়াংশ কমে গেছে।
গ্রাহকেরা অর্থনৈতিকভাবে চাপে থাকায় তার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে চশমার অনলাইন বেচাকেনায়ও। অনলাইনে চশমা বিক্রির ব্র্যান্ড লুনেটস আই ওয়্যারের ডিজিটাল মিডিয়া ম্যানেজার জাহিদ হাসান প্রথম আলোকে বলেন, সংখ্যার দিক থেকে বেচাকেনায় প্রভাব পড়েনি। তবে অনেকেই বেশি দামের পণ্য না কিনে সাশ্রয়ী মূল্যের চশমা কেনার প্রতি ঝুঁকছেন।
চশমার বাজার নিয়ে আশার কথা শোনালেন ফ্রান্সের চশমা ও লেন্স বিক্রয়কারী কোম্পানি এসিলরের এদেশীয় ব্যবস্থাপক কাজী মোস্তফা তাহমিন। তিন বললেন, চশমার বাজার বড় হচ্ছে। এ জন্য কয়েকটি বহুজাতিক কোম্পানি এ দেশে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, চশমাকে অত্যাবশ্যক পণ্য হিসেবে বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় শুল্ক-কর সুবিধা দেওয়া প্রয়োজন।