টেকনাফ স্থলবন্দর
দুই কারণে ব্যাহত আমদানি–রপ্তানি
িময়ানমার থেকে বাংলাদেশে হিমায়িত মাছ, সুপারি, আদা, বিভিন্ন প্রজাতির কাঠ, শুঁটকি, নারকেল, আচার ইত্যাদি পণ্য আমদানি হয়।
রপ্তানি পণ্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো আলু, প্লাস্টিক পণ্য, তৈরি পোশাক, বিস্কুট, চানাচুর, চিপস ও কোমল পানীয়।
ডলার–সংকট ও মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীর সঙ্গে আরাকান আর্মির (এএ) সংঘাতে টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য কমে গেছে। ফলে কয়েক মাস ধরে এ বন্দর থেকে রাজস্ব আয়ে ধস নেমেছে। তাতে বিপাকে পড়েছেন বন্দর–সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী, আমদানি-রপ্তানিকারকেরা।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, স্থানীয় দুটি ব্যাংক চাহিদা অনুযায়ী ফরেন ডিমান্ড ড্রাফট (এফডিডি) ইস্যু করতে না পারায় ব্যবসায়ীরা মিয়ানমার থেকে পণ্য আমদানি করতে পারছেন না। এ ছাড়া মিয়ানমারে যুদ্ধাবস্থার কারণে সেখান থেকে পণ্যভর্তি কার্গো ট্রলার ও জাহাজ আসতে পারছে না।
চলতি অর্থবছরের জুলাই–এপ্রিলে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৩৬০ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল ৬১৬ কোটি টাকা।
আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ায় রাজস্ব আদায় আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে বলে স্বীকার করেছেন টেকনাফ স্থলবন্দরে কাস্টমস শুল্ক কর্মকর্তা বি এম আবদুল্লাহ আল মাসুম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, চাহিদা অনুযায়ী এফডিডি না পাওয়ায় মিয়ানমার থেকে পণ্য আমদানি করতে পারছেন না আমদানিকারকেরা। আবার মিয়ানমারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সে দেশের বিদ্রোহীদের সংঘাতের কারণে পণ্যবোঝাই কার্গো ট্রলার ও জাহাজও আসতে পারছে না। এ জন্য রাজস্ব আদায়ের ওপর প্রভাব পড়েছে।
কাস্টমস সূত্র জানায়, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ৭৫৬ কোটি টাকার পণ্য আমদানি হয়েছে। তার বিপরীতে সরকার রাজস্ব পেয়েছে প্রায় ৩৬০ কোটি টাকা। অথচ আগের অর্থবছরে অর্থাৎ ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে আমদানি হয়েছিল প্রায় ১ হাজার ৪৬১ কোটি টাকার পণ্য। যার বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছিল ৬১৬ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে পণ্য আমদানি কমে প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছে। তার সঙ্গে রাজস্ব আদায়ও কমেছে প্রায় অর্ধেক।
আমদানির পাশাপাশি কমেছে রপ্তানির পরিমাণও। চলতি অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে রপ্তানি হয়েছে প্রায় আড়াই কোটি টাকার পণ্য। গত অর্থবছরের একই সময়ে রপ্তানির পরিমাণ ছিল প্রায় পাঁচ কোটি টাকার।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সীমান্ত চোরাচালানকে নিরুৎসাহিত করতে ১৯৯৫ সালে মিয়ানমারের সঙ্গে সীমান্ত বাণিজ্য চুক্তি হয়। ওই চুক্তি অনুযায়ী, এফডিডির মাধ্যমে ৩০ লাখ ও ৫০ লাখ টাকার সমমূল্যের পণ্য আমদানি-রপ্তানির বিধান চালু করা হয়। কিন্তু ডলার–সংকটের কারণে গত মার্চ থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ও এবি ব্যাংক এফডিডি প্রদান সীমিত করে দেয়। এই দুটি ব্যাংকই মিয়ানমারের সঙ্গে পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে এফডিডি সুবিধা দিয়ে থাকে।
স্থানীয় ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকেরা বলছেন, কয়েক মাস ধরে ব্যাংক দুটি চাহিদা অনুযায়ী এফডিডি সুবিধা দিতে পারছে না। ডলার-সংকটের কারণ দেখিয়ে ব্যাংকগুলো ব্যবসায়ীদের চাহিদা অনুযায়ী এফডিডি সুবিধা দিতে পারছে না। এ কারণে আমদানি কমে গেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন আমদানিকারক প্রথম আলোকে বলেন, স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন একজন ব্যবসায়ী তাঁর লাইসেন্সের বিপরীতে ৩০ লাখ ও ৫০ লাখ টাকার সমমূল্যের ডলারের ডিমান্ড ড্রাফট পেতেন। ডলার–সংকট শুরু হওয়ার পর এই সুবিধা ব্যবসায়ীরা পাচ্ছেন না।
সোনালী ব্যাংকের টেকনাফ শাখার ব্যবস্থাপক মঈনুল হাসান ও এবি ব্যাংকের টেকনাফ শাখার ব্যবস্থাপক মনজুরুল আলম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ার পর থেকে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের চাহিদামতো ব্যাংক ড্রাফট দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
আমদানিকারকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে যেসব পণ্য আমদানি হয়, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য—হিমায়িত মাছ, সুপারি, আদা, বিভিন্ন প্রজাতির কাঠ, শুঁটকি, নারকেল, আচার ইত্যাদি। আর রপ্তানি পণ্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো আলু, প্লাস্টিক পণ্য, তৈরি পোশাক, বিস্কুট, চানাচুর, চিপস ও কোমল পানীয়। আগে ওষুধ, সিমেন্ট, টিউবওয়েল রপ্তানি হলেও এখন তা কমে গেছে। এতে অস্বাভাবিকভাবে কমেছে রপ্তানিও।
টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে পণ্য আমদানি ও রপ্তানির সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ী মো. উমর ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৭ সালে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে চলে আসায় দেশটিতে বাংলাদেশি পণ্যের চাহিদা অনেক কমে যায়। অন্যদিকে, রোহিঙ্গারা যেসব পণ্য বেশি ব্যবহার করে, সেগুলোর আমদানি বেড়েছে। তার মধ্যে সুপারি, আদা, শুঁটকি উল্লেখযোগ্য।
টেকনাফ স্থলবন্দর সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আমিনুর রহমান বলেন, পণ্য আমদানির জন্য পর্যাপ্ত এফডিডি সুবিধা মিলছে না।
স্থলবন্দর পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড ল্যান্ড পোর্ট টেকনাফের মহাব্যবস্থাপক মো. জসিম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, আমদানি কমে যাওয়ায় টেকনাফ স্থলবন্দরের কর্মব্যস্ততাও কমে গেছে। কয়েক মাস আগেও এই বন্দর দিয়ে মিয়ানমার থেকে প্রতিদিন ৩০ থেকে ৩৫টি পণ্যবাহী কার্গো ট্রলার ও জাহাজ বাংলাদেশে আসত। সেই সংখ্যা কমে এখন দৈনিক দুই থেকে তিনটিতে নেমেছে। আর বাংলাদেশ থেকে পণ্য নিয়ে আগে ৮ থেকে ১০টি ট্রলার মিয়ানমার যেত। কিন্তু কয়েক মাস ধরে কোনো ট্রলার মিয়ানমার যাচ্ছে না।