দেশের বস্ত্র খাতের কারখানাগুলো চলতি অর্থবছরের প্রথম ৬ মাস, অর্থাৎ জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে ৯ লাখ ১১ হাজার টন তুলা আমদানি করেছে। তার আগের বছরের একই সময়ে আমদানি হয়েছিল ৯ লাখ ৪১ হাজার টন তুলা। তার মানে গত জুলাই-ডিসেম্বরে তুলা আমদানি কমেছে ৩ দশমিক ১৯ শতাংশ।
তুলার পাশাপাশি সুতা আমদানিও কমে গেছে। গত ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ৬ মাস (জুলাই-ডিসেম্বরে) ৬ লাখ ৪৭ হাজার টন সুতা আমদানি করা হয়েছিল। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে তা কমে দাঁড়ায় ৩ লাখ ৭৯ হাজার টনে। অর্থাৎ পরিসংখ্যান বলছে, ৬ মাসে সুতা আমদানি কমেছে ৪১ দশমিক ৪২ শতাংশ।
দেশের পণ্য রপ্তানি আয়ের শীর্ষ খাত তৈরি পোশাকশিল্পের সুতা ও কাপড়ের একটা বড় অংশ সরবরাহ করে টেক্সটাইল বা বস্ত্র খাত। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৭ মাসে ২ হাজার ৭৪১ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এই রপ্তানি আয় তার আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১৪ দশমিক ৩১ শতাংশ বেশি। পোশাক রপ্তানি বাড়লেও তুলা ও সুতা আমদানি কমেছে। এই বৈপরীত্য কিসের ইঙ্গিত দিচ্ছে?
এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে আরেকটি বিষয় পরিষ্কার হওয়া যাক। পরিমাণের দিক থেকে তুলা আমদানি কমলেও অর্থের হিসাবে অনেকটা বেড়েছে। ২০২১ সালের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে ৯ লাখ ৪১ হাজার টন তুলা আমদানিতে খরচ হয়েছিল ১৮ হাজার ১১৩ কোটি টাকা। আর ২০২২ সালের শেষ ৬ মাসে ৯ লাখ ১১ হাজার টন তুলা আমদানিতে ব্যয় হয় ২৬ হাজার ৬৬৪ কোটি টাকা। তার মানে গত জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬ মাসে অর্থের হিসাবে তুলা আমদানিতে খরচ বেড়েছে ৪৭ শতাংশ।
আগের চেয়ে কম পরিমাণ তুলা আমদানিতে বেশি অর্থ ব্যয়ের কারণ দুটি—বৈশ্বিক বাজারে তুলার মূল্যবৃদ্ধি ও ডলারের বিপরীতে টাকার বড় দরপতন। ২০২১ সালের জুলাইয়ে প্রতি পাউন্ড তুলার দাম ছিল ৮৮ সেন্ট। তারপর থেকে দাম ধারাবাহিকভাবে বাড়ে। গত বছরের জুনের মাঝামাঝিতে দাম ছিল ১ ডলার ৪৩ সেন্ট। তারপর দাম ওঠানামার মধ্যে ছিল। এখন প্রতি পাউন্ড তুলার দাম ৮৫ সেন্ট। তার সঙ্গে জাহাজভাড়াসহ অন্যান্য খরচ বাবদ যুক্ত হবে ২০-২৫ সেন্ট।
অন্যদিকে ২০২১ সালের জুলাইয়ে প্রতি ডলারের বিনিময়মূল্য ছিল ৮৪ টাকা। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর ভোগ্যপণ্য ও জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে গেলে ডলারের সংকট তৈরি হয়। ডলারের দাম ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকে। গত বছরের জুলাইয়ে প্রতি ডলারের দাম ছিল ৯৩ টাকা। বছরের শেষ দিকে তা ১০০ টাকা ছাড়িয়ে যায়।
এদিকে তৈরি পোশাক রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক ধারায় থাকলেও গত সপ্তাহে এক সংবাদ সম্মেলনে বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান জানান, তৈরি পোশাকের ক্রয়াদেশের বিপরীতে কাঁচামাল আমদানির জন্য ইউটিলাইজেশন ডিক্লারেশন (ইউডি) সনদ নেওয়া গত নভেম্বরে ২০ শতাংশ ও ডিসেম্বরে ২৬ শতাংশ কমেছে। যদিও আগের চেয়ে বেশি মূল্যের পোশাক উৎপাদন ও কাঁচামালের দাম বাড়তি থাকায় রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি আছে।
সুতা ও তুলা আমদানি কমে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে বস্ত্রকলমালিকদের সংগঠন বিটিএমএর সভাপতি মোহাম্মদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, করোনার পর যখন সবকিছু স্বাভাবিক হতে শুরু করে, তখন বৈশ্বিক বাজারে দাম বাড়তে থাকে। পাশাপাশি তুলা আনার জন্য জাহাজ পাওয়া কঠিন হয়ে যায়। যে তুলা ১ মাসে দেশের বন্দরে আনা যেত, জাহাজসংকটের কারণে তা আনতে ৯০ দিন লাগতে শুরু করে। তখন দেশের অনেক বস্ত্রকল তুলার আগাম বুকিং দিতে শুরু করে।
মোহাম্মদ আলী যোগ করেন, ‘গত বছর ডলার-সংকটের মধ্যে ঋণপত্র খোলা কমলেও তুলার কোনো সংকট হয়নি। যদিও কয়েক মাস ধরে ডলারের সংকটের কারণে প্রয়োজনীয় ঋণপত্র খোলা যাচ্ছে না। যেমন আমাদের কারখানায় ২ হাজার টন তুলার দরকার হলেও আমদানি করতে পারছি ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টন। আবার ঋণপত্র খোলা কঠিন হয়ে যাওয়ায় সুতার আমদানিও কমেছে।’
অপর এক প্রশ্নের জবাবে বিটিএমএ সভাপতি বলেন, বর্তমানে ওভেন পোশাকের ক্রয়াদেশ ভালো থাকলেও নিট পোশাকের ক্রয়াদেশ কিছুটা কম। অন্যদিকে গ্যাসের সংকটের কারণে বস্ত্রকলের উৎপাদনও কমেছে। হঠাৎ যদি পোশাক ক্রয়াদেশ বেড়ে যায়, তাহলে তুলার সংকটে পড়তে হবে। আবার ঋণপত্র খোলা গেলে দ্রুতই সংকট কাটানো যাবে। বর্তমানে জাহাজের কোনো সংকট নেই। এক মাসেই তুলা আনা যাচ্ছে।
বিটিএমএর তথ্যানুযায়ী, গত ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩৯ হাজার ৩১৮ কোটি টাকায় ১৮ লাখ ৩৩ হাজার টন তুলা আমদানি হয়েছে। একই সময়ে ৪৪ হাজার ৬২৮ কোটি টাকায় ১২ লাখ ৯৫ হাজার টন সুতা আমদানি হয়।
এদিকে ইউনাইটেড স্টেটস ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাগ্রিকালচারের (ইউএসডিএ) পূর্বাভাস অনুযায়ী, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১১ কোটি ৪৪ লাখ বেল (১ বেলা = ৪৮০ পাউন্ড) তুলা উৎপাদিত হবে। এই সময়ে বাংলাদেশ আমদানি করবে ৭৯ লাখ বেল। যদিও আগের অর্থবছর বাংলাদেশ ৮৫ লাখ ২০ হাজার বেল তুলা আমদানি করেছিল। সেই হিসাবে চলতি বছর তুলা আমদানি কমবে বাংলাদেশের।
তুলা আমদানি নিয়ে জটিলতার কথা বললেন লিটল স্টার স্পিনিং মিলের চেয়ারম্যান খোরশেদ আলম। তিনি বলেন, ‘গ্যাস–সংকটের কারণে আমার কারখানায় ভোট ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত উৎপাদন বন্ধ রাখতে হয়। উৎপাদন কমে যাওয়ায় আমার কারখানায় কয়েক মাসের তুলা মজুত রয়েছে। তারপরও আমাকে তুলা আমদানি করতে হবে। কারণ, বেশ কয়েক মাস আগে থেকে বিদেশি সরবরাহ প্রতিষ্ঠানকে তুলা বুকিং দিয়ে রাখতে হয়।’
খোরশেদ আলম বলেন, বুকিং অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ে তুলা আমদানির ঋণপত্র খুলতে হয়। না হলে আন্তর্জাতিক কটন অ্যাসোসিয়েশনের নিয়ম অনুযায়ী প্রতি মাস দেরির জন্য দেড় শতাংশ করে জরিমানা গুনতে হয়। ডলার-সংকটের কারণে ব্যাংকগুলো ঋণপত্র খুলছে কম। ফলে এখন জরিমানা গোনা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই।
নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম প্রথম আলোকে বলেন, ডলার–সংকটের কারণে অধিকাংশ ব্যাংকই তুলার ঋণপত্র খুলতে অপারগতা প্রকাশ করছে। সে জন্য তুলার আমদানি কমে গেছে।
মোহাম্মদ হাতেম মনে করেন, তুলা আমদানির এই পরিস্থিতি যদি অব্যাহত থাকে আর আগামী দু–এক মাসের মধ্যে পোশাকের ক্রয়াদেশ বাড়ে, তাহলে দেশে সুতার সংকট তৈরি হবে। সেটি হলে সুতার দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাবে।
তাই তুলা আমদানিতে বাধার সৃষ্টি করা যাবে না। অন্যথায় তৈরি পোশাক রপ্তানি বাধাপ্রাপ্ত হবে, যোগ করেন এই ব্যবসায়ী নেতা।