ইইউতে বাংলাদেশের রপ্তানি কমতে পারে ২১.২%: র্যাপিড
বাংলাদেশ এখন স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে পরবর্তী ধাপে উত্তরণের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। এ রকম অবস্থায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সঙ্গে ভিয়েতনাম মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি সই করেছে। এই দুটি ঘটনার সম্মিলিত প্রভাবে ইইউর বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি ২১ দশমিক ২ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে। আবার এই রপ্তানি কমার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ১ শতাংশ কমার আশঙ্কা রয়েছে। রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র্যাপিড) এক গবেষণায় এমন তথ্যই উঠে এসেছে।
আজ বুধবার রাজধানীর শেরাটন হোটেলে ‘ইউরোপীয় ইউনিয়ন-ভিয়েতনাম মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি: বাংলাদেশের রপ্তানি প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় প্রভাব’ শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে গবেষণার তথ্য প্রকাশ করে র্যাপিড। এ নিয়ে অনুষ্ঠানে একটি উপস্থাপনা দেন র্যাপিডের চেয়ারম্যান এম এ রাজ্জাক।
এম এ রাজ্জাক ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ভিয়েতনামের মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) এবং বাংলাদেশের এলডিসি উত্তরণের বাস্তবতায় রপ্তানি খাতে কী প্রভাব পড়তে পারে, তার ওপর আলোকপাত করেন। তিনি বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সঙ্গে এফটিএর ফলে ভিয়েতনামে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) প্রবাহ বেড়েছে। এটা আরও বাড়বে বলে তারা আশা করছে। সে ক্ষেত্রে সবচেয়ে লাভবান হবে তাদের বস্ত্র ও তৈরি পোশাক খাত, সেটাই বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় সংকট। কারণ, বাংলাদেশের মোট রপ্তানির প্রায় ৮৫ শতাংশ তৈরি পোশাক।
আব্দুর রাজ্জাক আরও বলেন, একদিকে এফটিএর কারণে ইইউতে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে ভিয়েতনামের ওপর থেকে ধারাবাহিকভাবে শুল্ক উঠে যাচ্ছে, আরেক দিকে এলডিসি উত্তরণের কারণে বাংলাদেশের পণ্যে শুল্ক বাড়বে। ২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় যুক্ত হলেও পরের তিন বছর ইইউর বাজারে এই সুবিধা থাকবে। তারপর কিন্তু শুল্ক দিতে হবে। এই দুটি বাস্তবতাই উদ্বেগজনক এ কারণে যে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের ৪৮ শতাংশের গন্তব্য ইইউ। এই পরিপ্রেক্ষিতে ইইউ বাংলাদেশকে এলডিসি উত্তরণ–পরবর্তী আরও কয়েক বছর সুবিধা দিতে পারে। তবে সেটি পেতে বাংলাদেশকে উদ্যোগী হতে হবে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব মো. শাহরিয়ার কাদের সিদ্দিকী। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন জার্মান উন্নয়ন সংস্থা ফ্রেডরিক-ইবার্ট-স্টিফটাংগের (এফইএস) আবাসিক প্রতিনিধি ফেলিক্স গার্ডস। বক্তব্য দেন পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এম মাশরুর রিয়াজ, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের গবেষণা ও সক্ষমতা উন্নয়নবিষয়ক পরিচালক শামিমা নাসরিন প্রমুখ। অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন র্যাপিডের নির্বাহী পরিচালক মো. আবু ইউসুফ।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছ থেকে অতিরিক্ত সময় নেওয়া প্রসঙ্গে ফেলিক্স গার্ডস বলেন, বাংলাদেশের ক্ষতি হোক, ইউরোপীয় ইউনিয়ন তা চায় না। এসব সুবিধা দেওয়া-নেওয়ার বিষয় দ্বিপক্ষীয়। বিষয়টি রাজনৈতিক। বাংলাদেশ আলোচনার উদ্যোগ নিতে পারে।
নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট ফজলে শামীম এহসান বলেন, এলডিসি উত্তরণ ও ইইউ-ভিয়েতনাম এফটিএর প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের রপ্তানিতে। অর্থাৎ রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি কমবে। তবে তার মানে এই নয় যে বাংলাদেশের রপ্তানি ধসে যাবে। নিয়মনীতির বাইরেও বাস্তবতা আছে। সেটা হলো, ভিয়েতনামের মানুষের জীবনমানের উন্নতি হয়েছে। শিক্ষার মান বেড়েছে। ফলে সেখানকার মানুষ এখন আর তৈরি পোশাক খাতে কাজ করতে চায় না; তাঁদের পছন্দ উচ্চ প্রযুক্তি খাত। এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা থাকবে।
এই বাস্তবতায় দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ উন্নয়নে জোর দেন ফজলে শামীম। তিনি বলেন, ঋণের সুদ বেড়ে যাওয়ায় দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের খরচ বেড়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে খেলাপি ঋণের নিয়মে পরিবর্তন আনা হচ্ছে। এতে ব্যবসায়ীরা চাপে পড়বেন।
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, নীতিগত সুবিধা পেলেই যেকোনো দেশ তার সদ্ব্যবহার করতে পারে, তা নয়। ভিয়েতনাম তা পেরেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে তারা মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করেছে। সেই সঙ্গে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, ব্যবসা-বাণিজ্য সহজ করতে পেরেছে তারা। ফলে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) আকর্ষণীয় গন্তব্য হয়ে উঠেছে দেশটি। চীনের সঙ্গে তাদের সম্পর্কও আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ভিয়েতনামের রপ্তানি বাড়বে
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, ২০০৬ সাল পর্যন্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামের রপ্তানির পরিমাণ কাছাকাছি ছিল। কিন্তু এরপর ভিয়েতনামের রপ্তানি অনেকটা বেড়ে গেছে। ২০২৩ সালে যেখানে ইইউতে ভিয়েতনামের রপ্তানি ছিল ৫০ দশমিক ৭ বিলিয়ন বা ৫ হাজার ৭০ কোটি মার্কিন ডলার, সেখানে বাংলাদেশের রপ্তানি ছিল মাত্র ২০ বিলিয়ন বা ২ হাজার কোটি ডলার। কিন্তু এর মধ্যে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ ভালো অবস্থায় আছে। ইইউ বহির্ভূত দেশগুলো থেকে ইইউ যত পোশাক আমদানি করে, তার ২১ দশমিক ৭ শতাংশ করে বাংলাদেশ থেকে।
এলডিসি উত্তরণ ও ইইউ-ভিয়েতনাম মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির জেরে ভিয়েতনামের তৈরি পোশাক রপ্তানি বাড়লে তা বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগজনক হবে বলে মনে করে র্যাপিড।
এ ছাড়া ইইউতে সামগ্রিকভাবে ভিয়েতনামের রপ্তানি অনেকটা বাড়বে বলেই মনে করছে র্যাপিড। তারা দেখিয়েছে, পণ্যের উৎস বিধি কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা হলে ইইউতে ভিয়েতনামের রপ্তানি বাড়তে পারে ৪৭ শতাংশ। তা না করা হলে রপ্তানি বাড়তে পারে ৮২ শতাংশ।
ইআরডি সচিব মো. শাহরিয়ার কাদের সিদ্দিকী ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ উন্নয়নে জোর দেন। বলেন, প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সরকারি নীতির ধারাবাহিকতার পাশাপাশি ব্যবসার খরচ যৌক্তিকীকরণ করা দরকার। সেই সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য বহুমুখীকরণে জোর দিতে হবে, যেটা এখন বাংলাদেশের নেই।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণের পর চীনা পণ্য আমদানিতে শুল্ক বাড়ানোর হুমকি দিয়েছেন। এতে বাংলাদেশের জন্য নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি হতে পারে বলে মন্তব্য করেন শাহরিয়ার কাদের সিদ্দিকি। যদিও শেষমেশ কতটা কী হবে, তা আপাতত নিশ্চিত নয়।
বাংলাদেশ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির (এফটিএ) উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানান অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এফটিএ শাখার অতিরিক্ত সচিব আয়েশা কবির। তিনি বলেন, বাংলাদেশ শিগগিরই চীনের নেতৃত্বাধীন আরসিইপি জোটে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব দেবে। নেপালের সঙ্গে কয়েক দফা আলোচনা হয়েছে। সিঙ্গাপুরের সঙ্গেও আলোচনা শুরু হবে। ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে আগে আলোচনা হয়েছে। সম্প্রতি তারা আবারও আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
অন্যান্য খাতে প্রণোদনা
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে বিভিন্ন সময় অনেক প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। এতে পোশাক খাতের বিকাশ ঘটেছে। এখন অন্যান্য খাতে প্রণোদনা দেওয়ার সময় এসেছে। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি (এসএমই) খাতের রপ্তানি বৃদ্ধি করা গেলে দেশের রপ্তানি খাতে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে পারে বলে মনে করেন অনুষ্ঠানের আরেক বিশেষ অতিথি ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) ভাইস চেয়ারম্যান মো. আনোয়ার হোসেন।
আসবাব খাত প্রসঙ্গে আনোয়ার হোসেন বলেন, ভিয়েতনাম ও বাংলাদেশের আসবাব খাতের দেশীয় বাজার প্রায় সমান। কিন্তু রপ্তানির ক্ষেত্রে দেখা যায়, ভিয়েতনামের আসবাব রপ্তানি বাংলাদেশের কয়েক শ গুণ। যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হলে এই খাতের রপ্তানি অনেকটাই বাড়ানো সম্ভব।
এই বাস্তবতায় র্যাপিডের প্রস্তাব, ইইউর সঙ্গে আলোচনা করে সহজ শর্তে রপ্তানির দ্বার উন্মুক্ত রাখার ব্যবস্থা নেওয়া। সেই সঙ্গে জিএসপি প্লাস অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ; ইইউর সঙ্গে এফটিএ ও বিনিয়োগ চুক্তি এবং সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তি (সেপা) স্বাক্ষরের উদ্যোগ নেওয়া এবং শ্রম পরিবেশের উন্নতি ঘটানো ইত্যাদি।
অনুষ্ঠানে র্যাপিডের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ইইউ-ভিয়েতনাম মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি ও বাংলাদেশের এলডিসি উত্তরণের প্রভাব বিভিন্ন অর্থনৈতিক মডেল ব্যবহার করে প্রভাবের আনুমানিক হিসাব দেওয়া হয়েছে। বাস্তবে তা কমবেশি হতে পারে।