রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ঋণের প্রধান মাপকাঠি
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান বলেছেন, দেশের একশ্রেণির মানুষ রাষ্ট্রকে শুধু দখল করেননি, তাঁরা নিজেরাই রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছেন। তাঁদের নিয়ে কিছু করাও কঠিন। কারণ, আমলাতন্ত্রের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন তাঁরা।
রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ঋণ দেওয়ার প্রধান মাপকাঠি হয়ে উঠেছে বলেও মন্তব্য করেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান। তিনি বলেন, রাজনৈতিকভাবে পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত কোনো গোষ্ঠীকে ঋণ দেওয়া হলে, সেই পৃষ্ঠপোষকতা তখন একটি রাজনৈতিক সম্পদে পরিণত হয়। ওই রাজনৈতিক সম্পদই তখন ঋণের অর্থ ফেরত না দেওয়ার ব্যাপারে কাজ করে। একবার যখন ঘটনাটি ঘটে, সেই গোষ্ঠী তখন আরও ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে।
রাজনৈতিকভাবে পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত কোনো গোষ্ঠীকে ঋণ দেওয়া হলে, সেই পৃষ্ঠপোষকতা তখন একটি রাজনৈতিক সম্পদে পরিণত হয়
সমাজ গবেষণা কেন্দ্রের উদ্যোগে গতকাল রোববার রাতে ‘বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের রাজনৈতিক অর্থনীতি’ শীর্ষক ভার্চ্যুয়াল আলোচনা সভায় অংশ নিয়ে রেহমান সোবহান এসব কথা বলেন। সমাজ গবেষণা কেন্দ্রের সভাপতি তাজুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় সঞ্চালক ছিলেন এশীয় প্রবৃদ্ধি গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। নির্ধারিত আলোচক ছিলেন সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান ও পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাশরুর রিয়াজ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অর্থনৈতিক গবেষণা ব্যুরোর চেয়ারম্যান অধ্যাপক এম এম আকাশ এবং যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্কের অধ্যাপক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ বিরূপাক্ষ পাল এতে দুটি আলাদা প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। ব্যক্তি খাতের ব্যাংকগুলোতেও খেলাপি ঋণের সমস্যা, ৬ ও ৯ শতাংশ সুদহার নীতির উদ্ভবের কারণ ও অভিজ্ঞতা, ব্যাংক একত্রীকরণ নীতির উদ্ভবের কারণ ও অভিজ্ঞতা এবং বাজেটঘাটতি মেটাতে ব্যাংক খাত থেকে নেওয়া সরকারের বিপুল পরিমাণ ঋণ নেওয়ার প্রতিফল—এই চার বিষয় বিবেচনায় নিয়ে আলোচনাটি হয়।
রেহমান সোবহান বলেন, রাজনৈতিক অর্থনীতির কাঠামোগত সমস্যা রয়েছে দেশে। আছে অদক্ষতা ও অবিচার। স্বল্প সময়ের জন্য আমানত নিয়ে দীর্ঘ সময়ের জন্য ঋণ দিচ্ছে ব্যাংকগুলো। এ পদ্ধতিতেই গলদ আছে। কেউ যখন ২ থেকে ৫ বছরের জন্য ঋণ নিয়ে ১০ থেকে ১৫ বছর পর ফেরত দেন, তখন সুদের কার্যকর হার কমে যায়। আর এর পেছনে আছে খেলাপি সংস্কৃতি।
ঋণখেলাপিরা নির্বাচনে অংশ নিতে না পারলেও সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান নিয়মটি সহজ করে দিয়েছিলেন বলে মন্তব্য করেন রেহমান সোবহান। তিনি বলেন, নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য ঋণ পুনঃ তফসিল করার সুযোগটি প্রথম তিনিই তৈরি করেছিলেন।
সরকারি ব্যাংকের পাশাপাশি ব্যক্তি খাতের ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের হার বাড়ছে। এটা তো হওয়ার কথা ছিল না
অসৎ ব্যবসায়ী, আমলা ও রাজনীতিবিদ
এম এম আকাশের প্রবন্ধে বলা হয়, সরকারি তথ্য অনুযায়ী ১ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকা এখন খেলাপি ঋণ। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) তথ্য অনুযায়ী তা ৪ লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি হবে। আর প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশেই খেলাপি ঋণের হার সবচেয়ে বেশি। এ হার ১১ দশমিক ৪৮ শতাংশ।
প্রবন্ধে আরও বলা হয়, দেশে ঋণ অবলোপন শুরু হয় ২০০২ সালে। পরে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ সরকারের ১০ বছরেই (২০০৯-১৯) এ ঋণ অবলোপন বেড়েছে ৩১৭ শতাংশের বেশি। ২০০৯ সালে অবলোপন করা ঋণের পরিমাণ ছিল যেখানে ১৫ হাজার ৬৬৭ কোটি টাকা, ২০১৯ সালে তা ৪৯ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকায় উন্নীত হয়।
জাতীয় সংসদে ব্যবসায়ীদের অংশগ্রহণ কীভাবে বাড়ছে, তার একটি চিত্রও তুলে ধরেন এম এম আকাশ। তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালের সংসদ নির্বাচনে ব্যবসায়ী ছিলেন ১৮ শতাংশ। ১৯৯০ সালের সংসদে তা বেড়ে হয় ৩৮ শতাংশ আর ১৯৯৬ সালে ৪৩ শতাংশে। ২০০১ সালে তা একলাফে ৫৮ শতাংশে পৌঁছায়। ২০০৮ সালের তা ১ শতাংশ কমে ৫৭ শতাংশ হলেও ২০১৪ সালে দাঁড়ায় ৫৯ শতাংশ এবং ২০১৮ সালে দাঁড়ায় ৬১ শতাংশে।
এম এম আকাশ বলেন, অসৎ ব্যবসায়ী, আমলা ও দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ—এই তিনে মিলে গোটা রাষ্ট্রকে কবজা করে ফেলেছে। শাসকশ্রেণি ও ঋণগ্রহীতারা যদি ব্যবসায়ী হন, তাহলে ইচ্ছা থাকলেও প্রতিষ্ঠানগুলোকে দায়িত্বশীল হওয়ার ব্যাপারে সক্রিয় করতে পারবে না রাষ্ট্র।
অসৎ ব্যবসায়ী, অসৎ আমলা ও দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ—এ তিনে মিলে গোটা রাষ্ট্রকে কবজা করে ফেলেছে
সমস্যার পেছনে নয়–ছয় সুদনীতি
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ বিরূপাক্ষ পাল বলেন, বিনিয়োগের প্রতি দরদ দেখানোর কথা বলে সুদের হার ৯ শতাংশ ও আমানতের হার ৬ শতাংশ করা হয়েছিল। বাস্তবে ব্যবসায়ীরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে গিয়ে বলেছেন, সুদের হার কমালে বিনিয়োগ বাড়বে। এটা ছিল মূলত অজুহাত। বিনিয়োগ বাড়েনি।
দেশের কোনো অর্থনীতিবিদ সুদের হার ৯ ও ৬ শতাংশের ব্যাপারে একমত হতে পারেননি বলে মন্তব্য করেন বিরূপাক্ষ পাল। তিনি বলেন, বিশ্ব যখন উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে জর্জরিত হয়ে সুদের হার বাড়াচ্ছিল, বাংলাদেশ ছিল তখন ব্যতিক্রম। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক সুদের হার বাড়ায়নি। এটা ছিল একধরনের যথাযথ নীতি পদক্ষেপ না নেওয়ার দম্ভ (পলিসি অ্যারোগেন্স)। আইএমএফ বলার পর বাংলাদেশ ব্যাংক এমন সময়ে সুদের হার বাড়িয়েছে, যখন বিশ্বের অন্য দেশগুলো তা কমাতে শুরু করে।
ব্যাংকের ৯ ও ৬ শতাংশ সুদের হারের নীতির পরই বাংলাদেশে অনেক সমস্যা শুরু হয়ে যায় বলে মনে করেন বিরূপাক্ষ পাল। তাঁর মতে, ওই নীতির পর থেকেই রিজার্ভে টান পড়ে। এতে সংকুচিত করতে হয় আমদানি। ফাঁকে এমন কিছু নীতি পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে, যাতে আবার স্থির থাকতে পারেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সাংবাদিকদের ঢোকার পথ রুদ্ধ করে তথ্যপ্রবাহের গতি বন্ধ করে দেওয়ার কোনো যুক্তি নেই বলে মনে করেন বিরূপাক্ষ পাল। তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্ষদে কী আলোচনা হয়, তা উন্মুক্ত করতে হবে। সেখানে তো ব্যক্তিগত আলাপ হয় না। ফেডের (যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ বোর্ড) যুক্তি দেওয়া হয়েছে। ফেড বললেই ফেড হওয়া যায় না, আরও কিছু গুণাবলি থাকা চাই।
এশীয় প্রবৃদ্ধি গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ব্যক্তি খাতের ব্যাংকগুলোকে যখন লাইসেন্স দেওয়া হলো, তখন যুক্তি ছিল—ব্যাংক খাতে প্রতিযোগিতা বাড়বে এবং এ খাত ভালো হবে। কিন্তু পরে দেখা গেল, সরকারি ব্যাংকের পাশাপাশি ব্যক্তি খাতের ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের হার বাড়ছে। এটা তো হওয়ার কথা ছিল না। সমাধানে বহু প্রস্তাবের কথা শোনা গেছে, যার শেষটি হচ্ছে ব্যাংক একত্রীকরণ (মার্জার)।
সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, দেশে দুর্বল নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা চলছে এবং বৃহৎ ব্যবসায়ী গোষ্ঠী রাষ্ট্রকে আয়ত্তে নিয়ে ফেলেছে। রাজনীতিবিদদের শুভবুদ্ধির উদয় না হলে এই দুষ্টচক্র থেকে অর্থনীতি, এমনকি দেশ বাঁচানো যাবে না।
পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাশরুর রিয়াজ বলেন, রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে এমন উপলব্ধি আসতে হবে যে ব্যাংক খাতকে আর অপব্যবহার করা যাবে না এবং যারা ঋণ লুণ্ঠন করেছে, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।