যে কারণে দাম পড়ে যাচ্ছে ড্রাগন ফলের
ফল বড় করতে একধরনের হরমোন ব্যবহার করা হয়, এমন প্রচার আছে। তাতে দাম কমে যাওয়ায় আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন চাষিরা।
সাধারণত ড্রাগন ফলের মৌসুম মে থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত। কিন্তু দেশের কিছুসংখ্যক চাষি বছরব্যাপী এই ফল চাষের জন্য ‘লাইটিং পদ্ধতি’ ব্যবহার শুরু করেছেন। এতে সারা বছর ড্রাগন ফল উৎপাদিত হচ্ছে। অসময়ের ফল মৌসুমের ফলের চেয়ে বড় হয়। চাষিরা বলছেন, অসময়ের ড্রাগন ফল নিয়ে সম্প্রতি নানা ‘অপপ্রচার’ শুরু হওয়ায় বাজারে এই ফলের চাহিদা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। তাতে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন রাজশাহীর ড্রাগনচাষিরা।
চাষিরা বলছেন, নানা অপপ্রচারের কারণে এখন অর্ধেক দামেও ড্রাগন ফল বিক্রি করা যাচ্ছে না। তাই ড্রাগন ফল নিয়ে অপপ্রচার রোধে সরকারের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন তাঁরা। বিভিন্ন পর্যায়ের একাধিক চাষির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদন করা ড্রাগন ফলের পুরোটাই লাল রঙের হয়, খোসাও থাকে পাতলা। আর কৃত্রিমভাবে বড় করা ড্রাগন ফলের খোসা মোটা থাকে এবং সেই ফল পুরোপুরি লাল হয় না। তাই ক্রেতারা দেখলেই সহজে প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম ড্রাগন ফল চিনতে পারেন।
ড্রাগন ফল বড় করার জন্য যে হরমোন ব্যবহার করা হয়, সেটা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। এ জন্য স্বাভাবিক আকারের ড্রাগন ফল খাওয়া উচিত।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, রাজশাহীতে এবার প্রায় ২২৪ হেক্টর জমিতে ড্রাগন চাষ হয়েছে। সম্ভাব্য ফলনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৪ হাজার ৬২০ মেট্রিক টন। এর মধ্যে মাত্র সাত হেক্টর জমিতে চাষিরা লাইটিং পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন। ডিসেম্বর থেকে মার্চ—এ সময়ে যে ড্রাগন চাষ করা হয়, তাতেই মূলত চাষিরা লাইটিং পদ্ধতি ব্যবহার করেন। মূলত শীতের এ সময়ে সূর্যের তাপ কমে আসায় এ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। কিন্তু মে থেকে নভেম্বর—এ সময়ে, অর্থাৎ মূল মৌসুমে ড্রাগন ফল চাষের ক্ষেত্রে লাইটিং পদ্ধতির দরকার হয় না।
সাম্প্রতিক সময়ে বাজারে ড্রাগন ফল নিয়ে ‘অপপ্রচার’ শুরু হয়েছে। সামাজিক বিভিন্ন যোগাযোগমাধ্যমে এ কথা ছড়িয়ে পড়েছে যে একধরনের হরমোন ব্যবহার করে ড্রাগন ফল বড় করা হচ্ছে। কিন্তু রাজশাহীর চাষিরা বলছেন, তাঁরা লাইটিং পদ্ধতিতে চাষের ক্ষেত্রেও কোনো ধরনের হরমোন ব্যবহার করেন না। তবে এ পদ্ধতিতে চাষের ক্ষেত্রে উৎপাদনে বেশি সময় লাগে এবং ফল বেশি দিন গাছে থাকে বলে সেগুলো আকারে বড় হয়। চাষিরা এ–ও বলছেন, হরমোন ব্যবহার করে উৎপাদিত ড্রাগন ফলের চামড়া বেশ মোটা হয়, রং পুরোপুরি লাল হয় না। ফলে এসব ড্রাগন ফল দেখলে আলাদাভাবে চিনতে খুব বেশি অসুবিধা হয় না।
কিন্তু সার্বিকভাবে সব ড্রাগন ফল নিয়ে অপপ্রচার শুরু হওয়ায় তাতে আর্থিকভাবে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছেন চাষিরা। তাঁদেরই একজন রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার উদপুর গ্রামের মাসুদ রানা। তিনি এবার ৩০ বিঘা জমিতে ড্রাগন চাষ করেছেন। মাসুদ রানা বলেন, অসময়ের (অফ সিজনে) ফল পরিপক্ব হতে সময় বেশি লাগে, এ জন্য সেগুলো আকারেও বড় হয়। কিন্তু অপপ্রচার চলছে, একধরনের ‘টনিক’ ব্যবহার করে কৃত্রিম উপায়ে ড্রাগন ফল বড় করা হচ্ছে। এই অপপ্রচারের কারণে প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত ফলের বাজারও পড়ে গেছে।
মাসুদ রানা জানান, গত বুধবার তিনি ঢাকায় ১৬০ কেজি ড্রাগন ফল পাঠিয়েছিলেন। সেই ফল ২৬০ টাকা কেজিতে বিক্রি করতে হয়। অথচ গত বছরের শুরুতে প্রতি কেজি ৬০০ টাকা ও বছরের শেষে ১ হাজার ২০০ টাকায় অসময়ের ড্রাগন ফল বিক্রি করেছেন। এখন উৎপাদন খরচই উঠছে না।
চাষিরা জানান, মে থেকে নভেম্বর—এ সময়ে, অর্থাৎ মূল মৌসুমে ড্রাগন ফল পরিপক্ব হতে ২৫ থেকে ২৮ দিন লাগে। জাতভেদে এসব ফলের ওজন হয় ২০০ থেকে ৫০০ গ্রাম পর্যন্ত। আর ডিসেম্বর থেকে মার্চ—অফ সিজনে বা অসময়ে ফল পরিপক্ব হতে সময় লাগে ৩৮ থেকে ৪২ দিন। এ সময়ে গাছে ফলও কম আসে। আবার বেশি সময় ফল গাছে থাকে বলে ওজনও বেশি হয়। জাতভেদে অসময়ের একেকটি ড্রাগন ফলের ওজন হয় ৮০০ গ্রাম পর্যন্ত।
সাধারণত ডিসেম্বর থেকে মার্চ এ সময়টাতে বাজারে দেশি ফল কম থাকে। তাই এ সময়ে ফলের পুষ্টির অভাব পূরণে ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠছিল ড্রাগন ফল। জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকায় চাষিরাও এ ফল চাষে বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। কিন্তু হরমোন ব্যবহারের ‘প্রচারণার’ কারণে চাষিরা দাম পাচ্ছেন না। তাঁরা এ ধরনের প্রচারণাকে ‘অপপ্রচার’ বলে দাবি করছেন।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোজদার হোসেন বলেন, কিছু ইউটিউবারের অপপ্রচারের কারণে বাজারে এ ফলের দাম পড়ে গেছে। অফ সিজনে বা অসময়ে ড্রাগন ফল কম আসে, এ জন্য সেগুলো আকারে বড় হয়। মৌসুমে অনেক ফল আসে। এ জন্য আকারে ছোট হয়। ফল বড় হলেই ‘টনিক’ ব্যবহার করা হয়েছে, এমনটি মনে করার কারণ নেই।
রাজশাহীর গোদাগাড়ীর চৈতন্যপুর গ্রামে এবার ১৮ বিঘা জমিতে ড্রাগন ফল চাষ করেছেন মনিরুজ্জামান। এর মধ্যে তিনি ১০ বিঘায় লাইটিং পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন। তাঁর জমিতে উৎপাদিত ফল আহরণ শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে তিনি ১০ মণ ফল বিক্রিও করেছেন।
মনিরুজ্জামান বলেন, বর্তমানে ফলের একটা চালান ঢাকায় পাঠালে বিক্রি হতে দুই দিন লাগছে। দামও ভালো পাওয়া যাচ্ছে না। গত বছর এই সময়ে পাইকারিতে প্রতি কেজি ড্রাগনের দাম ছিল ৬০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা। এবার সেই দাম নেমে এসেছে ২৮০ টাকায়। তাঁর বাগানেই এবার লাইটিং পদ্ধতিতে চাষ করা একেকটি ড্রাগন ফলের ওজন ৪০০ গ্রাম থেকে ১ কেজি পর্যন্ত হয়েছে। তাই ওজন নিয়ে ক্রেতাদের বিভ্রান্ত হওয়ার কোনো কারণ নেই বলে মনে করেন তিনি। এ পরিস্থিতি উত্তরণে তিনি সরকারিভাবে প্রকৃত তথ্য প্রচারের অনুরোধ জানান।
ঢাকার কারওয়ান বাজারের শাহী ভান্ডারের স্বত্বাধিকারী ব্যবসায়ী মো. রয়েল ইসলাম ওরফে রবিন আগে ভিয়েতনাম থেকে ড্রাগন ফল আমদানি করতেন। যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমদানি করা সেই ফলের ওজন একটাই এক কেজি হতো। তখন সবাই বেশি দামে কিনেছেন। এখন দেশে উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় আর আমদানি করতে হচ্ছে না। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা অপপ্রচারের কারণে দেশের ড্রাগনচাষিরা বিপাকে পড়েছেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক উদ্ভিদবিজ্ঞানী এম মনজুর হোসেন বলেন, ড্রাগন ফল বড় করার জন্য যে হরমোন ব্যবহার করা হয়, সেটা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। এ জন্য স্বাভাবিক আকারের ড্রাগন ফল খাওয়া উচিত।