আমদানি শুল্ক কমানোর পরে আলু-পেঁয়াজের দাম কতটা কমল

আলু ও পেঁয়াজের দাম কমাতে গত ৫ সেপ্টেম্বর নিত্যপ্রয়োজনীয় এ দুই পণ্যের আমদানি শুল্ক কমায় অন্তর্বর্তী সরকার। এর প্রভাবে গত প্রায় এক মাসে দেশের বাজারে আলু–পেঁয়াজের দাম কিছুটা কমেছে। এ সময়ে প্রতি কেজি আলুর দাম ১ দশমিক ৭৯ শতাংশ ও আমদানি করা পেঁয়াজের দাম ১১ দশমিক ৬৩ শতাংশ কমেছে বলে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

সম্প্রতি তৈরি করা ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে আলু ও পেঁয়াজের দাম গত এক মাসে বেশ খানিকটা বেড়েছে। তা সত্ত্বেও দেশের বাজারে এসব পণ্যের দাম বাড়েনি, বরং কিছুটা কমেছে। আমদানি শুল্ক কমানোর কারণে দেশের বাজারে আলু ও পেঁয়াজের দাম কমেছে বলে মনে করে ট্যারিফ কমিশন।

দেশে বিরাজমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে অনেক দিন ধরেই চাপে রয়েছেন সাধারণ মানুষ। গত আগস্ট মাসে দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১১ দশমিক ৩৬ শতাংশ। জুলাই মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি আরও বেশি ছিল। বাজারে চাল, ডিম, চিনি, বিভিন্ন ধরনের ফল, ভোজ্যতেল ও জ্বালানি তেলের দাম এখনো বেশ চড়া। এসব পণ্যের অনেকগুলো আমদানি করে চাহিদা মেটাতে হয়। তাই বাজার বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আলু-পেঁয়াজের মতো আরও কিছু নিত্যপণ্যে শুল্ক কমানো হলে সেগুলোর দাম কমে আসতে পারে। ফলে ভোক্তারা স্বস্তি পাবেন।

স্থানীয় বাজারে পেঁয়াজ ও আলুর দাম অনেক দিন ধরেই বাড়তি থাকার কারণে সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে এই দুই পণ্যের আমদানি শুল্ক কমানোর উদ্যোগ নেয় সরকার। এরপর গত ৫ সেপ্টেম্বর এ–সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন (এসআরও) জারি করা হয়। আলুর ক্ষেত্রে শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশে নির্ধারণ করা হয়। পাশাপাশি আলু আমদানিতে যে ৩ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ছিল, তা প্রত্যাহার করা হয়। একই সঙ্গে পেঁয়াজের ওপর প্রযোজ্য ৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক তুলে নেওয়া হয়।

এক মাস আগে বাজারে এক কেজি আলু বিক্রি হতো ৫৫-৬০ টাকায়। গতকাল তা বিক্রি হয়েছে ৫৪-৫৬ টাকা দরে। আবার এক মাস আগে খুচরা বাজারে প্রতি কেজি আমদানি করা পেঁয়াজের দাম ছিল ১১০-১১৫ টাকা। একই পেঁয়াজ গতকাল বিক্রি হয়েছে ৯০-১০০ টাকায়। পাশাপাশি দেশি পেঁয়াজের দামেও এর প্রভাব দেখা গেছে। এক মাস আগে দেশি পেঁয়াজের দাম ছিল ১১০-১২০ টাকা কেজি, যা গতকাল বিক্রি হয়েছে ১০৫-১১০ টাকায়।

সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) ও কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে ট্যারিফ কমিশন জানিয়েছে, শুল্ক কমানোর পর গত এক মাসে আলুর দাম ১ দশমিক ৭৯ শতাংশ, দেশি পেঁয়াজ ৬ দশমিক ৫২ শতাংশ ও আমদানি করা পেঁয়াজের দাম ১১ দশমিক ৬৩ শতাংশ কমেছে।

বিশ্ববাজারে দাম বাড়লেও দেশে কমেছে

আলু ও পেঁয়াজের আন্তর্জাতিক দর বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এই দুই পণ্যের দাম সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববাজারে বেড়েছে। বৈশ্বিক বাজার তথ্য প্রদানকারী প্ল্যাটফর্ম রেফিনেটিভ ও ভারতের মান্ডি বাজারের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত এক মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে পেঁয়াজের দাম ২৫ দশমিক ৪০ শতাংশ ও আলুর দাম ২০ দশমিক ১৩ শতাংশ বেড়েছে। তবে বিশ্ববাজারে পেঁয়াজের দাম বাড়ার ধারা গত এক সপ্তাহে কিছুটা শ্লথ হয়েছে। অর্থাৎ, আলু–পেঁয়াজের দেশি বাজার বিশ্ববাজারকে অনুসরণ করছে না।

বাংলাদেশের জন্য পেঁয়াজ আমদানির অন্যতম উৎস ভারত। অভ্যন্তরীণ বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় গত মে মাসে দেশটি পেঁয়াজের সর্বনিম্ন রপ্তানিমূল্য ৫৫০ ডলার নির্ধারণ করে দিয়েছিল, সেই সঙ্গে আরোপ করেছিল ৪০ শতাংশ রপ্তানি শুল্ক। বিকল্প হিসেবে বাংলাদেশি আমদানিকারকেরা তখন পাকিস্তান, চীন, মিসর ও তুরস্ক থেকে পেঁয়াজ আমদানি করেন। গত ১৩ সেপ্টেম্বর ভারত পেঁয়াজের সর্বনিম্ন রপ্তানিমূল্য প্রত্যাহার করে এবং রপ্তানি শুল্ক ২০ শতাংশে নামিয়ে আনে। ফলে ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানিতে খরচ এখন কিছুটা কম পড়ছে।

পেঁয়াজের পাইকারি বিক্রেতারা জানান, আমদানি করা পেঁয়াজের দামের সঙ্গে মিল রেখে বাজারে দেশি পেঁয়াজের দামও ওঠানামা করে। আমদানি করা পেঁয়াজের দাম কমে গেলে বাজার ধরে রাখতে স্থানীয় কৃষকেরা দাম কমিয়ে দেন। আর আমদানির খরচ বাড়লে দেশি পেঁয়াজও উচ্চ দামে বাজারে ছাড়া হয়। ফলে পেঁয়াজ আমদানি ব্যয় যত কমবে দেশি পেঁয়াজের দামও তত কমে আসবে।

আরও পণ্যের শুল্ক কমানোর দাবি

পেঁয়াজ ও আলুর বাইরে অনেক নিত্যপণ্যের বাজার অনেক দিন ধরেই বেশ চড়া। যেমন ডিম। বাজারে আজ মঙ্গলবার প্রতি ডজন ডিম কিনতে খরচ হচ্ছে ১৬০ থেকে ১৬৫ টাকা। কোথাও কোথায় বিক্রেতারা আরও ৫ টাকা বেশি দাম চাইছেন। গত এক মাসে সব ধরনের চালের দাম কেজিপ্রতি ২ থেকে ৬ টাকা করে বেড়েছে। টিসিবির হিসাবে, গত এক বছরের মধ্যে চালের দাম বেড়েছে ৭ থেকে ৯ দশমিক ৫ শতাংশ পর্যন্ত। বাজারে চিনির দাম প্রায় এক বছর ধরে উচ্চ মূল্যে মোটামুটি স্থির রয়েছে; প্রতি কেজি ১২৬ থেকে ১৩৫ টাকা। ভোজ্যতেলের চিত্রও প্রায় একই রকম।

বাজারের এই পরিস্থিতিতে চাল, ডিম, চিনি, ফল, ভোজ্যতেল ও জ্বালানি তেল আমদানিতে শুল্ক কমানোর পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।

বাজার বিশেষজ্ঞ ও কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সাবেক সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, শুল্ক কমালে সাধারণত দেশের বাজারে পণ্যের সরবরাহ বৃদ্ধি পায়। যাঁরা পণ্য মজুত করে রাখেন, তাঁরা বাজারে পণ্য ছাড়েন। এ কারণে দাম কমে আসে। পেঁয়াজ ও আলুর ক্ষেত্রে অনেকটা এমনই ঘটেছে। ফলে আরও কিছু নিত্যসামগ্রী, যেগুলোর দাম অনেক দিন ধরে বাড়তি রয়েছে, সেগুলোর আমদানি শুল্ক কমানো গেলে ভোক্তাদের মাঝে কিছুটা স্বস্তি আসতে পারে।