বিশ্ববাজারে দাম কমার সুফল নেই দেশে
রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে প্রায় ১০ মাস আগে বিশ্ববাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামে রেকর্ড হয়েছিল। সে তুলনায় এখন বিশ্ববাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বেশির ভাগের দাম তুলনামূলক কম। দু–একটি বাড়লেও খুব বেশি অস্থিতিশীল হয়নি বৈশ্বিক বাজার। তবে বিশ্ববাজারে কমলেও দেশে সেই হারে দাম কমেনি। আবার বিশ্ববাজারে যেগুলোর দাম বেড়েছে, দেশে বেড়েছে তার দ্বিগুণ হারে।
বিশ্ববাজারে মতো দাম না কমার কারণ হিসেবে ডলার, গ্যাস–বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিকে দায়ী করেছেন ব্যবসায়ীরা। আবার বাজারে প্রতিযোগিতা কমে সরবরাহ হ্রাস পাওয়ায় পণ্যের দামও বেড়েছে। অর্থাৎ এত দিন নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার কারণ হিসেবে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব বা বিশ্ববাজারের মূল্যবৃদ্ধির দোহাই দেওয়া হলেও বাস্তবে অভ্যন্তরীণ কারণেই এই সুফল মিলছে না।
প্রধান আটটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানিমূল্য ও খুচরা বাজার তুলনা করে এই চিত্র পাওয়া গেছে। এই আট পণ্য হলো সয়াবিন তেল, পামতেল, চিনি, আটা তৈরির গম, পেঁয়াজ, মসুর ডাল, ছোলা ও মটর ডাল।
সয়াবিন তেলের উদাহরণ দেওয়া যাক। গত বছর মে মাসে বন্দর দিয়ে অপরিশোধিত সয়াবিনের গড় আমদানিমূল্য ছিল টনপ্রতি ১ হাজার ৮৮৩ ডলার। এই মাসে খালাস হওয়া সয়াবিনের আমদানিমূল্য কমে হয়েছে ১ হাজার ৩৩১ ডলার। প্রতি টনে কমেছে ৫৫২ ডলার বা প্রায় ২৯ শতাংশ। এ হিসাবে দেশেও একই হারে কমার কথা। অথচ দেশে সয়াবিন তেলের দাম কমেছে ৮ শতাংশ।
বাকি ২১ শতাংশ কেন কমেনি—জানতে চাইলে টিকে গ্রুপের পরিচালক শফিউল আথহার তাসলিম গতকাল বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, মে মাসের সঙ্গে এখনকার ডলারের দাম তুলনা করলে ৩২ শতাংশ বেড়েছে। গ্যাস–বিদ্যুতের দাম বাড়ায় সয়াবিন পরিশোধনের খরচও বেড়েছে। ডলার ও প্রক্রিয়াজাত খরচ আমলে নেওয়া হলে বাস্তবে বাজারে সয়াবিনের দাম বিশ্ববাজারের তুলনায় অনেক কম।
সয়াবিনের মতো পাম তেলের দামও কমেছে বিশ্ববাজারে। ১০ মাস আগে যে পাম তেলের আমদানিমূল্য ছিল প্রতি টন ১ হাজার ৫৩৩ ডলার, এখন তা নেমে এসেছে ৯৭৫ ডলারে। এ হিসেবে বিশ্ববাজারে কমেছে ৩৬ শতাংশ। তবে একই সময়ে দেশে দাম কমেছে ২৬ শতাংশ।
বিশ্ববাজারে দাম কমার তালিকায় আরেকটি পণ্য মসুর ডাল। এই পণ্যটি প্রতি টনে কমেছে ১৮০ ডলার বা ২০ শতাংশ। তবে দেশের বাজারে কমেছে ১০ শতাংশ। এখন মোটা মসুর ডাল কেজি ১০০ টাকা।
হিসাব মিলছে না আটার দামেও
গত বছর মে মাসে আটা তৈরির গমের টনপ্রতি আমদানিমূল্য ছিল গড়ে ৩৬০ ডলার। মাঝে দাম বাড়লেও রাশিয়া–ইউক্রেন শস্য চুক্তির পর ইউক্রেন গম রপ্তানি শুরু করে। তাতে বিশ্ববাজারে গমের দাম স্থিতিশীল রয়েছে। এ মাসে আমদানি হওয়া আটা তৈরির গমের টনপ্রতি মূল্য পড়েছে ৩৬০ ডলার। বিশ্ববাজারে একই থাকলেও দেশে একই সময়ের ব্যবধানে খুচরা বাজারে আটার দাম বেড়েছে ৩৫ শতাংশ।
যেমন গত বছর মে মাসে প্যাকেটজাত এক কেজি আটার দাম ছিল ৪৮ টাকা, এখন তা ৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
আমদানি তথ্য ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আটার দাম বাড়ার জন্য দুটি কারণ দায়ী। যেমন ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও দেশে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম। নভেম্বরের মাঝামাঝি ভারত থেকে গম আমদানি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। এখন ইউক্রেন বা অন্য বিকল্প বাজার থেকে গম আমদানি করতে পারছেন শুধু গুটিকয় বড় ব্যবসায়ী।
বিশ্ববাজারে কমেছে, দেশে বেড়েছে
বাজারে একটি পণ্য পাওয়া গেছে, যেটির দাম বিশ্ববাজারে কমলেও দেশে বেড়েছে। এই পণ্যটি হলো পেঁয়াজ। ভারত থেকে এখন পেঁয়াজ আমদানি হচ্ছে প্রতি টন ১৩৯ ডলারে। গত বছর মে মাসে আমদানি মূল্য ছিল ১৮৬ ডলার। অর্থাৎ আমদানি মূল্য ২৫ শতাংশ কমেছে। তবে দেশে খুচরা বাজারে এখন আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৪০ টাকা দরে। গত বছর মে মাসে দাম ছিল কেজি ৩০ টাকা।
বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের একজন আমদানিকারক প্রথম আলোকে বলেন, এখন ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানিতে কেজিপ্রতি সব মিলিয়ে খরচ পড়বে ১৩ থেকে ১৪ টাকা। তবে কৃষকদের স্বার্থরক্ষায় পেঁয়াজ আমদানির অনুমতিপত্র দেওয়া হবে না, এমন গুজবে পেঁয়াজের দাম বাড়ছে।
বিশ্ববাজারের চেয়ে দ্বিগুণ বেড়েছে
১০ মাসের তুলনায় বিশ্ববাজারে এখন চিনি, ছোলা ও মটর ডালের আমদানি মূল্য কিছুটা বেশি। তবে বিশ্ববাজারে যা বেড়েছে, তার দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে দেশের বাজারে।
যেমন চিনির কথা ধরা যাক। গত বছর মে মাসে বন্দর দিয়ে আমদানি হওয়া অপরিশোধিত চিনির গড় আমদানি মূল্য ছিল টনপ্রতি ৪৫৭ ডলার। এই মাসে খালাস হওয়া চিনির টনপ্রতি গড় আমদানি মূল্য ৪৯১ ডলার। অর্থাৎ দাম বেড়েছে ৭ শতাংশ। একই সময়ে খুচরা বাজারে দাম বেড়েছে ৪৭ শতাংশ।
বিশ্ববাজারে চিনির দাম বাড়ছে। তবে বাড়তি দামে কেনা চিনি দেশে পৌঁছায়নি। আবার চিনিতে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি কাস্টমস শুল্ক টনপ্রতি তিন হাজার টাকা প্রত্যাহার করা হয়েছে। সম্পূরক শুল্ক কমানো হয়েছে ৫ শতাংশ। এতে আগে যেখানে কেজিপ্রতি ৩০ টাকা শুল্ক দিতে হতো, এখন দিতে হচ্ছে ২৫ টাকা। নতুন শুল্কহারে বেশ কিছু চিনিও খালাস হয়েছে।
চিনির মতো মটর ডালের দাম বিশ্ববাজারে বেড়েছে ১৪ শতাংশ। দেশে খুচরা বাজারে প্রক্রিয়াজাত মটর ডালের দাম বেড়েছে ২৭ শতাংশ।
আবার ছোলার দামও বিশ্ববাজারে ৭ শতাংশ বাড়লেও দেশে ১৪ শতাংশ বেড়েছে। অবশ্য ছোলার দাম পাইকারি বাজারে এখন কমতির দিকে। খুচরায় এখনো পুরোপুরি প্রভাব পড়েনি। ছোলার দামে মোটামুটি সুফল পাওয়ার কারণ হলো বাজারে প্রতিযোগিতা বেড়েছে। ভারত থেকে বিপুলসংখ্যক ব্যবসায়ী ছোলা আমদানি করতে পেরেছেন।
বড় ভূমিকা ডলারের মূল্যবৃদ্ধির
বিশ্ববাজারে দাম কমলেও দেশের বাজারে কমবে কি না, তা নির্ভর করছে মূলত দেশে ডলারের দাম কত, তার হিসাবে। যেমন ১০ মাস আগেও এক ডলারের আমদানি পণ্যের দাম দেশে পড়ত ৮৬ টাকা। এখন বিশ্ববাজারে একই দাম থাকলেও কদিন আগেও পরিশোধ করতে হয়েছে ১০৬ থেকে ১১০ টাকা পর্যন্ত। এখন ১১৪ টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে। অর্থাৎ শুধু ডলারের কারণেই ১০ মাসের হিসাবে ৩২ শতাংশ বেড়ে যাচ্ছে।
সরবরাহ বাড়া–কমার ক্ষেত্রেও ডলারের দাম ভূমিকা রাখছে বলে ব্যবসায়ীরা জানান। তাঁরা বলছেন, এখন ডলারের যে দরে হিসাব করে পণ্য আমদানি করা হচ্ছে, তা নিয়েও ভয়ে আছেন ব্যবসায়ীরা। কারণ, অনেক পণ্যের আমদানি দায় ছয় মাস পরে শোধ করতে হবে। তখন যদি ডলারের দাম আরও বাড়ে, তাহলে বিপুল অঙ্কের লোকসান গুনতে হবে ব্যবসায়ীদের। কারণ, এখনকার ডলারের দাম ধরে পণ্য বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা।
পণ্যবাজারের অবস্থা নিয়ে জানতে চাইলে সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা প্রথম আলোকে বলেন, শঙ্কা–অনিশ্চয়তা যা কিছু থাকুক না কেন, এবার রোজায় যে পরিমাণ পণ্য আমদানি হয়েছে, তা দিয়েই চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে। রোজায় নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার শঙ্কা নেই। উল্টো রোজার আগে পাইকারি বাজারে চিনি ও ভোজ্যতেলের দাম কিছুটা কমে গেছে।
সুযোগ কম, তদারকিই ভরসা
দেশীয় বাজার ব্যবস্থাপনা করে বিশ্ববাজারের সুফল পাওয়ার কোনো সুযোগ আছে কি না, জানতে চাইলে গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, দ্রুত বিশ্ববাজারের সুফল পুরোপুরি পাওয়ার সুযোগ কম। এখন সংকটের কারণে ডলারের বিনিময় মূল্য বেশি। এতে পণ্যের দাম বেশি পড়ছে। আবার সব ব্যাংক আগের মতো ঋণপত্র খুলতে পারছে না।
তাতে আমদানিনির্ভর নিত্যপণ্যের সরবরাহ বাড়ানোতেও অনিশ্চয়তা থাকছে। আবার মূল্যস্ফীতির কারণে এমনিতে সব ধরনের পণ্যে বাড়তি মূল্য যুক্ত হয়ে আছে। এসব সংকট থেকে এখনই বেরিয়ে আসার সুযোগ কম থাকলেও বাজার তদারকি করে অন্তত কোনো পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ঠেকানো সম্ভব বলে মন্তব্য করেন তিনি।