বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) দেশের মূল্যস্ফীতির হার গণনা করে থাকে। বিবিএস জাতীয় পর্যায়ে এবং গ্রাম ও শহরাঞ্চলের জন্য ভোক্তা মূল্য সূচক (কনজ্যুমার প্রাইস ইনডেক্স বা সিপিআই) হিসাব করে। এই সূচকগুলো ব্যবহার করে শহর, গ্রাম ও জাতীয় পর্যায়ে মূল্যস্ফীতির হার গণনা করা হয়। শহর ও গ্রামের গড় আয়ের পরিবারগুলোর ওপর ভিত্তি করে এই ভোক্তা মূল্য সূচক তৈরি করা হয়।
এই পরিবারগুলোর অর্থ ব্যয়ের ধরন বা ভোগের ধরন নিরূপণ করা হয় ২০০৫-০৬ সালের খানা আয় ও ব্যয় জরিপের ভিত্তিতে। এ ক্ষেত্রে শহর ও গ্রামের জন্য দুটি আলাদা ভোগ্যপণ্যের তালিকা বা কনজ্যুমার বাস্কেট নির্ধারণ করা হয়। শহরের ভোক্তাদের এই তালিকায় আছে খাদ্য, অন্যান্য নানা ব্যবহার্য জিনিসসহ ৪২২টি পণ্য এবং একইভাবে গ্রামের ভোক্তাদের তালিকায় আছে ৩১৮টি পণ্য। ভোক্তা মূল্য সূচক তৈরি করতে কোন পণ্যের গড় মান (পরিসংখ্যানের ভাষায় যাকে বলা হয় ওয়েইট) কত হবে, সেটি বিবিএস নির্ধারণ করে একটি পরিবারের মোট খরচের কত অংশ কোন পণ্যের পেছনে যায়, তার ভিত্তিতে। আর এই উপাত্তের উৎস ২০০৫-০৬ সালের খানা আয়-ব্যয় জরিপ।
বিবিএসের সিপিআই ও মূল্যস্ফীতি হিসাবের প্রক্রিয়া নিয়ে প্রধানত দুটি সমালোচনার জায়গা আছে। প্রথমত, ২০১৬ সালে খানা আয়-ব্যয়ের একটি জরিপ আছে এবং যার তথ্য-উপাত্ত ২০১৭ সাল থেকেই পাওয়া যাচ্ছে। তাহলে বিবিএস এখনো কেন ২০০৫-০৬ সালের গৃহস্থালি আয় ও ব্যয় সমীক্ষার উপাত্ত ব্যবহার করছে, তা স্পষ্ট নয়।
অন্যদিকে ২০০৫-০৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত দেশের দরিদ্র ও সচ্ছল উভয় শ্রেণির মানুষের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন এসেছে। অথচ বিবিএস যখন সিপিআই হিসাব করে, তখন এই খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন বিবেচনায় আসে না। দ্বিতীয়ত, শহর ও গ্রামাঞ্চলের নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোর মূল্যস্ফীতির প্রকৃত চিত্র সিপিআইয়ের সরকারি হিসাবে প্রতিফলিত হয় না। সিপিআই গণনা করার জন্য বিবিএস যে ভোগ্যপণ্যের তালিকা ব্যবহার করে, তাতে নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোর ভোগ বা ব্যয়ের প্রকৃত চিত্র আড়ালে থেকে যায়। অতএব মূল্যস্ফীতির ফলে প্রান্তিক দরিদ্র পরিবারগুলো যে চাপের মুখে পড়ে, তা সরকারি পরিসংখ্যানে প্রতিফলিত হয় না।
আমরা বাংলাদেশের প্রান্তিক পরিবারগুলোর জন্য একটি মূল্যস্ফীতির হার প্রাক্কলন করেছি। এ জন্য শহর ও গ্রাম মিলিয়ে আটটি প্রান্তিক গোষ্ঠী চিহ্নিত করেছি, যারা অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধির কারণে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকিতে আছে। শহরাঞ্চলে এই গোষ্ঠীর মধ্যে আছে তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিক, দিনমজুর, রিকশা/ভ্যানচালক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। গ্রামীণ এলাকায় এই গোষ্ঠীর মধ্যে আছে ভূমিহীন কৃষক, দিনমজুর, রিকশা/ভ্যানচালক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী।
প্রতিটি গোষ্ঠীর জন্য আলাদা করে ভোক্তা মূল্য সূচক বা সিপিআই গণনা করেছি। এ জন্য আমরা ২০১৮ সালে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) ও বাংলাদেশের পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত ১০ হাজার ৫০০ পরিবারের দেশব্যাপী সমীক্ষার বিশদ তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করেছি। এই সমীক্ষার তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে আমরা প্রান্তিক গোষ্ঠীগুলোর জন্য একটি সাধারণ খাদ্যসামগ্রীর তালিকা তৈরি করেছি। এরপর এই তালিকার প্রতিটি সামগ্রীর জন্য নতুন করে গড় মান গণনা করেছি। এই তালিকার ওপর ভিত্তি করে এবং সরকারের কৃষি বিপণন বিভাগ ও ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) সংগৃহীত খুচরা মূল্যের উপাত্তের ভিত্তিতে আমরা মাসিক পয়েন্ট টু পয়েন্ট খাদ্য মূল্য সূচক ও খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার গণনা করেছি। তার ফলাফল সবাইকে চমকে দেওয়ার মতো:
প্রথমত, বিবিএস যে ভোগ্যপণ্যের তালিকা ব্যবহার করে, তার তুলনায় আমাদের নির্বাচিত প্রান্তিক গোষ্ঠীগুলোর ভোগ্য পণ্যের তালিকায় পণ্যের সংখ্যা অনেক কম।
দ্বিতীয়ত, আমরা দেখতে পাই, শহরের প্রান্তিক গোষ্ঠীগুলো গড়ে তাদের মোট খরচের ৬১ দশমিক ৩১ শতাংশ খাদ্যের পেছনে ব্যয় করে। আর গ্রামীণ প্রান্তিক গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে তা ৬৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ। বিবিএস এ ক্ষেত্রে যে হিসাব দেয়, তার তুলনায় এ হার অনেক বেশি। বিবিএসের হিসাবে শহর ও গ্রামের পরিবারগুলো তাদের মোট খরচের যথাক্রমে ৪৫ দশমিক ১৭ শতাংশ ও ৫৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ খাদ্যের পেছনে খরচ করে।
তৃতীয়ত, আমাদের প্রাক্কলনে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শহর ও গ্রামাঞ্চলের এই প্রান্তিক গোষ্ঠীর গড় খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার পাওয়া গেছে যথাক্রমে ১২ দশমিক ৪৭ শতাংশ ও ১২ দশমিক ১০ শতাংশ। ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে শহর ও গ্রামীণ এলাকার জন্য এই হার ছিল যথাক্রমে ১১ দশমিক ৩৬ শতাংশ ও ১১ দশমিক ২১ শতাংশ। তাতে বোঝা যায়, ফেব্রুয়ারি মাসে যে কেবল খাদ্য মূল্যস্ফীতির হারই বৃদ্ধি পেয়েছে তা নয়; বরং সরকারি পরিসংখ্যানে যা বলা হচ্ছে, মূল্যস্ফীতির হার তার চেয়ে অনেক বেশি। ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে বিবিএসের হিসাবে, শহর ও গ্রামীণ এলাকার জন্য খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ছিল যথাক্রমে ৪ দশমিক ৮৫ শতাংশ ও ৫ দশমিক ৯৪ শতাংশ। অথচ আমাদের হিসাবে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের প্রান্তিক গোষ্ঠীগুলো যে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হারের মুখোমুখি হচ্ছে, তা বিবিএসের দাবি করা খাদ্য মূল্যস্ফীতির হারের দ্বিগুণের বেশি।
মূল্যস্ফীতিকে বলা হয় প্রান্তিক মানুষের জন্য নিষ্ঠুরতম কর। আমাদের বিশ্লেষণে এটি স্পষ্ট, বাংলাদেশের প্রান্তিক মানুষ প্রকৃত যে খাদ্য মূল্যস্ফীতির মুখে পড়েছে, সেটি আনুষ্ঠানিক পরিসংখ্যানে প্রতিফলিত হচ্ছে না। দরিদ্র মানুষের ব্যয়ের বেশির ভাগ খাদ্যের পেছনে যায় বলে তাঁদের পক্ষে খরচ কমানো সম্ভব হয় না। ফলে মূল্যস্ফীতির কারণে তারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়ায় এই উদ্বেগজনক পরিস্থিতিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে।
সেলিম রায়হান: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, সানেম