বৈশ্বিক ব্র্যান্ডের পথে বাংলাদেশের হাতিল
পড়াশোনা শেষ। পুরান ঢাকার ফরাশগঞ্জে বাবার কাঠের ব্যবসায় বসেছেন তরুণ সেলিম এইচ রহমান। বসেছেন বললে ভুল হবে। মূলত তাঁর কাজ ছিল কাঠ মাপজোখ করা। তবে তাতে নতুনত্ব না থাকায় কোনো মজা পাচ্ছিলেন না তিনি। সেটি আবার বাবাকে বলতেও পারছেন না ভয়ে। অবশ্য সারাক্ষণই তাঁর মাথায় ঘুরতে থাকে, নতুন কী করা যায়। নতুন কী করা যায়।
একদিন সুযোগ চলে এল। নিজের বাসার দরজার জন্য কাঠ কিনতে লতা হোসেন নামের একজন ক্রেতা ফরাশগঞ্জে এলেন। সঙ্গে তাঁর কাঠমিস্ত্রি। হঠাৎ করে মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল সেলিম এইচ রহমানের, ক্রেতাকে দরজা বানিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দিলেন। কাকতালীয়ভাবে সেই ক্রেতা রাজি হয়ে গেলেন। দরজার জন্য অগ্রিম ৫০ হাজার টাকাও দিলেন ক্রেতা। সেই টাকা দিয়ে বাবার কারখানার ভেতরে মহা উৎসাহে দরজা বানানোর কাজে নেমে পড়লেন সেলিম এইচ রহমান। তখন সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিলেন বাবার ব্যবসার কর্মচারী আহসান হাবিব।
দরজা বানাতে গিয়ে তরুণ সেলিম মনস্থির করলেন, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কাজটি করবেন। তখনো দেশে দরজার কোনো ব্র্যান্ড ছিল না। সময়টা ১৯৮৮ সাল। বাবার কাছ থেকে বেশ কিছু টাকা ধার করে বাড্ডায় দিলেন দরজা বিক্রির দোকান। নাম হাতিল ডোরস। খোরশেদ আলম নামের এক তরুণকে বিক্রয়কর্মী হিসেবেও নিয়োগ দিলেন। কিন্তু দরজা তো বিক্রি হয় না। দিনের পর দিন বউনি হয় না। দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। এভাবে ১৮-১৯ দিন কেটে যাওয়ার পর প্রথম দরজা বিক্রি হলো।
অল্প সময়ের মধ্যেই মিরপুরের কাজীপাড়ায় দ্বিতীয় বিক্রয়কেন্দ্র করে ফেললেন সেলিম এইচ রহমান। চাহিদা বাড়তে থাকায় ১৯৯০ সালে পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ার একটি ময়দার মিল ভাড়া করে দরজা বানানোর কারখানা করলেন। তখন হাতিলের দরজার মান দেখে ক্রেতাদের কেউ কেউ বলতে লাগলেন, আপনারা তো আসবাবও বানাতে পারেন। পরামর্শটা সেলিম এইচ রহমানের মনে ধরল। শুরু করলেন সেগুন কাঠের খাট ও ডাইনিং টেবিল বানানো। ভালো সাড়া পেতে শুরু করলেন। ১৯৯২ সালে হঠাৎ করেই উত্তরা থেকে দুই ভদ্রলোক এলেন। হাতিলের ডিলারশিপ নেওয়ার প্রস্তাব দিলে রাজি হয়ে গেলেন সেলিম এইচ রহমান। শুরু হলো নতুন যাত্রা। সেই হাতিল বর্তমানে দেশের আসবাব ব্র্যান্ডের পরিচিত একটি নাম। সারা দেশে তাদের বিক্রয়কেন্দ্র ৭০টি।
হাতিলকে কেবল দেশের আসবাব খাতের অন্যতম শীর্ষ ব্র্যান্ড বললে ভুল হবে। আসবাব রপ্তানিতে শীর্ষস্থানে পৌঁছেছে হাতিল। গত কয়েক বছরে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, নেপাল ও ভুটানে ছড়িয়েছে ব্র্যান্ড হাতিল। দেশের অনেক প্রতিষ্ঠানই পণ্য রপ্তানি করে। তবে তাদের বেশির ভাগই ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী তাদের নামে পণ্য উৎপাদন করে থাকে। সেখানে হাতিল পুরোপুরি ভিন্ন। তারা নিজস্ব ব্র্যান্ডের আসবাব উৎপাদন ও রপ্তানি করছে। মানে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর মানুষ বাংলাদেশি ব্র্যান্ড হাতিলের আসবাব কিনছেন। এভাবেই বৈশ্বিক ব্র্যান্ড হওয়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছে তারা।
গত অর্থবছর দেশে-বিদেশে ৩২৩ কোটি টাকার আসবাব বিক্রি করেছে হাতিল। বর্তমানে তাদের কারখানা ও কার্যালয়ে কাজ করেন তিন হাজারের বেশি কর্মী। হাতিলকে আজকের অবস্থানে নিয়ে আসার পেছনে চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম এইচ রহমানের সঙ্গে আছেন তাঁর ছোট চার ভাই। তাঁরা হলেন মাহফুজুর রহমান, মিজানুর রহমান, মশিউর রহমান ও শফিকুর রহমান। চারজনই হাতিলের পরিচালক। প্রত্যেকেই ভিন্ন ভিন্ন দায়িত্ব পালন করছেন।
কাঠের সঙ্গে শৈশব
১৯৬৬ সালে ফরাশগঞ্জের উল্টিনগঞ্জ লেনে কাঠের ব্যবসা শুরু করেন প্রয়াত হাবিবুর রহমান। এইচ এ টিম্বার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামের সেই প্রতিষ্ঠানে দেশি চিটাগাং টিক, জারুল, টিক চাম্বুল, চাপালিশ, শিল কড়ই এবং বিদেশি বার্মাটিক, রেড ওক, বিচসহ বিভিন্ন জাতের কাঠ বিক্রি করে। মিয়ানমার, জার্মানি, কানাডা ও আফ্রিকা অঞ্চলের বিভিন্ন দেশ থেকে কাঠ আমদানি করে তারা। হাবিবুর রহমানের হাত ধরে দেশের প্রথম সিজনিং বা কাঠ শুষ্ককরণ প্ল্যান্ট হয়। প্রতিষ্ঠানটি এখনো টিকে আছে। সেটির দেখাশোনা করেন মাহফুজুর রহমান।
বাবার কাঠের ব্যবসার সুবাদে পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ায় বড় হন সেলিম এইচ রহমান ও তাঁর ভাইয়েরা। বাবার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়া-আসার কারণে ছোটবেলা থেকেই তাঁদের কাঠের সঙ্গে যোগাযোগ। ভবিষ্যতে ব্যবসায়ী হওয়ার বীজ বপনের বিষয়টি ঘটেছে তখনই। ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে মিটফোর্ড হাসপাতালের ফ্যান, লাইটসহ বিভিন্ন পণ্য সরবরাহের দরপত্রে অংশ নেন সেলিম এইচ রহমান। কাজ পেয়েও যান। তাতে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা মুনাফা হয়েছিল। সেই টাকা দিয়ে পরিবারের সবাইকে উপহার দিলেন। বাকি টাকা দিয়ে ঘুরে এলেন ভারত।
সেলিম এইচ রহমান বললেন, ‘বাবার কাছেই আমার ব্যবসার হাতেখড়ি। তিনি সব সময় সততার সঙ্গে ব্যবসা করেছেন। আমরা পাঁচ ভাই সেটিই করে যাচ্ছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা ক্রেতাদের যেটা বলেছি, সব সময় সেটিই দেওয়ার চেষ্টা করেছি। কখনো এই কাঠ দিয়ে আসবাব বানানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে অন্য কাঠ দিইনি। পণ্য কেনার পর সমস্যা হলে সেটি সমাধানের চেষ্টা করেছি। বিক্রি করেই দায়িত্ব শেষ করিনি। একজন ক্রেতা যখন আমাদের পণ্য কিনে সন্তুষ্ট হয়েছেন কিংবা বিক্রয়–পরবর্তী সময়ে সেবা পেয়েছেন, তখনই তাঁরা আরেকজনকে কাছে হাতিলের প্রশংসা করেছেন। এভাবেই আজকের পর্যায়ে পৌঁছেছি আমরা।’
পুরান ঢাকা থেকে সাভার
১৯৯৩ সালে কুড়িলের ৫ হাজার বর্গফুটের একটি কারখানা ভাড়া নিয়ে হাতিলের আসবাব বানানো শুরু হয়। সেখানেই বেশ কয়েক বছর চলল। তবে নতুন নতুন বিক্রয়কেন্দ্র চালু ও আসবাবের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ২০০৩ সালে পুরান ঢাকার শ্যামপুর শিল্পনগরে আরেকটি কারখানা ভাড়া নেওয়া হলো। তাতেও চাহিদা অনুযায়ী জোগান দেওয়া যাচ্ছে না। পরে ফরাশগঞ্জ ও আশপাশের এলাকায় তিন-চারটি শেড ভাড়া করে কারখানা করেন সেলিম এইচ রহমান।
তত দিনে ব্র্যান্ড হিসেবে ভালোভাবে দাঁড়িয়ে গেছে হাতিল। ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা কারখানাগুলো এক জায়গায় নিয়ে আসা দরকার। সেই ভাবনা থেকেই সাভারের জিরানীতে বাবার ১২ বিঘা জমি কিস্তিতে কিনে কারখানার কাজ শুরু করেন সেলিম এইচ রহমান। ২০০৮ সালে নতুন কারখানায় যাত্রা শুরু করে হাতিল। বর্তমানে মোট ৬৫ বিঘার ওপর তাঁদের দুটি কারখানা।
নতুন কারখানা করেই থেমে যাননি সেলিম এইচ রহমান। সেই কারখানায় জার্মানি, ইতালি, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাধুনিক প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি স্থাপন করেছেন। কারখানার একটি ছাড়া সব ইউনিট কাঠ বা বোর্ডের গুঁড়া মুক্ত করেছেন। ফলে প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা কাজ করছেন স্বচ্ছন্দে। তাঁদের স্বাস্থ্যঝুঁকি কমে গেছে অনেকটাই। সব মিলিয়ে বর্তমানে এটিই দক্ষিণ এশিয়ায় কাঠের আসবাব তৈরির সবচেয়ে আধুনিক কারখানাগুলোর একটি।
হাতিলের কারখানায় রোবট
রোবটের চারটি হাতের ওপর চারটি চেয়ার দাঁড়িয়ে আছে। কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত সেই রোবটের ওপরের একটি অংশ থেকে চেয়ারে লেকার স্প্রে করা হচ্ছে স্বয়ংক্রিয়ভাবে। হাতের কোনো কাজ নেই। দুই কর্মী পাশে দাঁড়িয়ে প্রক্রিয়াটি নজরদারি করছেন। বার্নিশ হয়ে গেলে তাঁদের কাজ নতুন চারটি চেয়ার আবার রোবটের চার হাতে তুলে দেওয়া।
সাভারের জিরানীতে বিকেএসপির পাশে হাতিলের কারখানায় গিয়ে ৫ জানুয়ারি এমন চিত্রই দেখা গেল। কারখানার উৎপাদনপ্রক্রিয়া দেখাতে আমাদের সঙ্গে ছিলেন পরিচালক শফিকুর রহমান এবং বিক্রয় ও বিপণন বিভাগের প্রধান ফিরোজ আল মামুন। তাঁরা বললেন, ত্রিমাত্রিক বা আঁকাবাঁকা নকশার আসবাব রোবটের মাধ্যমে বার্নিশ করা হয়। তাতে প্রতিটি পণ্যের বার্নিশের মান ও রং একই থাকে। একেক পণ্যের শেড একেক রকম হয়ে যায় না।
হাতিলের অনেক আসবাবই ছোট ছোট অংশ বানিয়ে জোড়া দেওয়া হয়। সেসব অংশ প্রতিটি ধাপেই উন্নত মানের যন্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে। যেমন কাঠ বা বোর্ড কাটা থেকে শুরু করে ছিদ্র করা কিংবা নকশার কাজ পুরোটা করছে কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র। সেই যন্ত্রের সঙ্গে আছে বিশেষ ধরনের মোটা পাইপ। সেই পাইপটি আপনাআপনি কাঠের বা বোর্ডের গুঁড়া টেনে নিয়ে কারখানার বাইরে জড়ো করছে। সেই গুঁড়া দিয়ে পুনরায় পার্টিকেল বোর্ড তৈরি হয় নিজেদের কারখানায়।
সব মিলিয়ে হাতিলের প্রতিটি বিভাগ ঘুরে দেখা গেল, আধুনিক যন্ত্রের সঙ্গে কর্মীদের দক্ষ হাতের ছোঁয়ায় প্রতিদিন উৎপাদন হচ্ছে শত শত নান্দনিক আসবাব।
হাতিলের কারখানায় বর্তমানে সময় ধরে পণ্য উৎপাদিত হচ্ছে। মানে প্রকৌশলীরা আসবাবের প্রতিটি অংশ বানানোর সময় হিসাব করে বের করছেন। তারপর সেই তালিকা কর্মীদের দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কখনো কোনো আসবাবের কোনো অংশ বানাতে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে অতিরিক্ত লাগলে তার কারণ খুঁজে বের করে তাৎক্ষণিকভাবে সমাধান করা হচ্ছে।
হাতিলের ইস্পাতের আলমারি, ক্যাবিনেটসহ অন্যান্য আসবাব বানানোর আলাদা ইউনিট রয়েছে। ইস্পাতের আসবাবে যাতে মরিচা না ধরে, সে জন্য কেমিক্যাল ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা আছে। এ ছাড়া পার্টিকেল বোর্ড ও ফোম বানানোর আলাদা ইউনিট হাতিলের আছে।
সেলিম এইচ রহমান বললেন, ‘যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরা সব সময় নিজেদের পরিবর্তন করতে চাই। সে জন্য বিশ্বের অনেক দেশ ঘুরে ঘুরে আধুনিক কারখানা দেখেছি। যেখানে সুযোগ পাইনি, সেখানে ক্রেতা সেজে খুঁটিনাটি দেখে এসেছি।’ সময় ধরে পণ্য উৎপাদনের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘শিল্পকারখানায় অন্যান্য পণ্য যেভাবে উৎপাদিত হয়, আমরা সেভাবেই করার চেষ্টা করছি। এতে করে পণ্যের গুণগত মান উন্নত হওয়ার পাশাপাশি খরচ কমে আসে।’
কারখানার কর্মপরিবেশ বিষয়ে হাতিলের চেয়ারম্যান বলেন, ‘পোশাকশিল্পের কমপ্লায়েন্স বা উন্নত কর্মপরিবেশ নিয়ে অনেক কথাবার্তা হচ্ছে। তবে আসবাবশিল্পে কমপ্লায়েন্সের বিষয়টি সেভাবে আসেনি। তারপরও আমাদের মনে হয়েছে, হাতিলের কর্মীদের জন্য ভালো একটা পরিবেশ দেওয়া দরকার। ক্রেতাদের কোনো ধরনের চাপে নয়, বরং আমরা মন থেকেই কাজটি করার চেষ্টা করেছি।’
অনেক নতুনের সঙ্গী
শুরুতে সেগুন কাঠের আসবাব তৈরি করলেও দেশে বনভূমির স্বল্পতার কথা ভেবে সেখান থেকে সরে আসে হাতিল। ২০০৯ সাল থেকে সেগুনের বদলে আমদানি করা ওক কাঠ দিয়ে আসবাব বানানো শুরু করে তারা। পরবর্তীকালে জার্মানভিত্তিক দ্য ফরেস্ট স্টিওয়ার্ডশিপ কাউন্সিলের (এফএসসি) সনদপ্রাপ্ত ওক এবং বিচ ওক কাঠ দিয়ে আসবাব উৎপাদনে উদ্যোগী হয় হাতিল। পরিবেশের ক্ষতি না করে যেসব কাঠ উৎপাদিত হয়, সেগুলোকেই সনদ দেয় এফএসসি। বর্তমানে এফএসসি সনদপ্রাপ্ত কাঠের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের বোর্ড ও ইস্পাত ব্যবহার করছে হাতিল। এমনকি তাদের কারখানাটিও এফএসসি সনদপ্রাপ্ত।
২০০২ সালে হাতিল দেশে প্রথম লেকার ফিনিশড (একধরনের বার্নিশ, যা যন্ত্রের মাধ্যমে করা হয়) নিয়ে আসে। সাধারণ বার্নিশের চেয়েও সেটি বেশ দৃষ্টিনন্দন। পরবর্তী সময়ে অন্যরা সেটি অনুসরণ করলে আরও উন্নত মানের লেকার ফিনিশড নিয়ে আসে হাতিল কর্তৃপক্ষ। সেটির সর্বশেষ সংস্করণ রোবটিক যন্ত্রটি। বিক্রয়কেন্দ্রের জায়গার দাম আকাশচুম্বী হয়ে যাওয়ার কারণে ২০১৭ সালে ভার্চ্যুয়াল স্টোর চালু করে প্রতিষ্ঠানটি। ফলে ছোট বিক্রয়কেন্দ্রে সব আসবাব প্রদর্শনের ব্যবস্থা না থাকলেও কোনো সমস্যা হচ্ছে না। কারণ, তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে সেই ভার্চ্যুয়াল স্টোরে হাতিলের সব আসবাব ত্রিমাত্রিকভাবে দেখে পছন্দ করে নিতে পারেন ক্রেতারা।
আসবাবের নকশায় হাতিল সব সময় ক্রেতাদের বিশেষ নজর কাড়ে। সেটির পেছনেও গল্প আছে। নকশায় আধুনিকতা আনার ধারাবাহিক চেষ্টার অংশ হিসেবে ২০০৪ সালে হাতিল ফার্নিচার প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। তাতে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা আসবাবের নকশা দেন। দুই বছর পর একই ধরনের প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। তবে প্রতিযোগিতায় অংশ নিলেও পাকাপাকিভাবে আসবাবশিল্পে কাজ করতে আগ্রহী হলেন না শিক্ষার্থীরা। ফলে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ডিজাইনার খুঁজে বের করার চেষ্টাটি অনেকটা ব্যর্থই হলো।
তবে দমলেন না সেলিম এইচ রহমান। ২০১০ সালে তিনজন অভিজ্ঞ ব্রিটিশ ডিজাইনারকে নিয়ে এলেন। তাঁদের সঙ্গে হাতিলের কর্মীরাও যোগ দিলেন। টানা ছয় মাস আসবাবের নকশা করে তা প্রস্তুত করলেন বিদেশি তিন ডিজাইনার। সেগুলো ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় প্রদর্শন করা হলো। ক্রেতাদের কাছ থেকে ভালো সাড়া পেয়ে উৎপাদন শুরু করে হাতিল।
নকশায় প্রতিনিয়ত নতুনত্ব আনার চেষ্টাটি আগের মতোই গুরুত্ব দিয়ে করছে হাতিল। সেলিম এইচ রহমানের নেতৃত্বে গড়ে উঠছে ডিজাইনার টিম। তিনি নিজেও নকশা নিয়ে কাজ করেন প্রতিদিন। কারখানায় তাঁর অফিস কক্ষের পাশেই আছে সব সরঞ্জাম। সুযোগ পেলেই সেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সময় কাটান।
আসবাবের নকশায় বিষয়ে সেলিম এইচ রহমান বলেন, মানুষের রুচি পরিবর্তন হচ্ছে প্রতিনিয়ত। তা ছাড়া নগরকেন্দ্রিক মানুষের বসবাসের জায়গা ছোট হয়ে আসছে। ফলে অল্প জায়গা রুচিশীল আসবাব দেওয়ার জন্য নকশায় সব সময় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছি আমরা। আমরা এমন নকশার আসবাব করতে চাই, যাতে ১০-১৫ বছরের ব্যবধানে তা পুরোনো মনে না হয়। তার মানে হচ্ছে, সময়ের থেকে একটু এগিয়ে থাকার চেষ্টা।
হাতিলের বিদেশযাত্রা
বছর আট আগে প্রথম আসবাব রপ্তানি করে হাতিল। ২০১৩ সালে অস্ট্রেলিয়ায় প্রবাসী এক বাংলাদেশির হাত ধরে বিক্রয়কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠানটি। ওই বছরই যুক্তরাষ্ট্রের আসবাব ব্র্যান্ড পল রবার্টের সঙ্গে চুক্তি করে মধ্যপ্রাচ্যে রপ্তানি শুরু করে তারা। পরের বছর কানাডায় হাতিলের বিক্রয়কেন্দ্র হয়। ২০১৬ সালে ভুটান ও পরের বছর নেপালের বাজারে যায় হাতিল। ২০১৭ সালেই ভারতে ফ্র্যাঞ্চাইজি মডেলে ব্র্যান্ড হিসেবে যাত্রা শুরু করে তারা। বর্তমানে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে ১৮টি বিক্রয়কেন্দ্র আছে হাতিলের।
জানতে চাইলে সেলিম এইচ রহমান বলেন, ‘একসময় চীন থেকে আমাদের দেশে প্রচুর পরিমাণে আসবাব আমদানি হতো। চীনারা পারলে আমরা কেন পারব না—সেই ভাবনা থেকে আমরা প্রস্তুতি নিয়েছি। বর্তমানে আমরা বাংলাদেশি ব্র্যান্ড হিসেবে বিদেশে পরিচিত হতে চাই।’
ভারতের বাজার বিষয়ে হাতিলের চেয়ারম্যান বলেন, ‘ভারত পার্শ্ববর্তী দেশ। আমাদের ক্রেতাদের চাহিদার সঙ্গে তাদের একটা মিল আছে। ভারতের আসবাবের কয়েকটি ব্র্যান্ড আছে। তারপর তাদের বিশাল বাজারের চাহিদা মেটাতে চীন থেকে আমদানি করতে হয়। তবে চীনের সস্তা পণ্যের নেতিবাচক অভিজ্ঞতার কারণে ক্রেতারা বিকল্প খুঁজছে। ফলে আমরা যখন ভারতে ব্যবসা শুরু করেছি, তখন থেকেই ক্রেতারা আগ্রহ দেখিয়েছেন। বিভিন্ন প্রদেশের আসবাব ব্যবসায়ীরা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন। এভাবেই ধাপে ধাপে অগ্রসর হচ্ছি।’
পাঁচ ভাইয়ের বন্ধন
আগেই বলেছি, হাতিল পরিচালনার সঙ্গে সেলিম এইচ রহমানের সঙ্গে তাঁর ছোট চার ভাই আছেন। তাঁদের মধ্যে মাহফুজুর রহমান এইচ এ টিম্বারের দেখাশোনা করেন। তিনি ছাড়া বাকি চার ভাই উত্তরায় একটি বাসায় বসবাস করেন। সবাই মিলে একসঙ্গে বসবাস করার বিষয়ে সেলিম এইচ রহমান বলেন, ‘বাবা একান্নবর্তী পরিবারে বড় হয়েছেন। আমাদের মধ্যেও সেটি চলে এসেছে। আমাদের পাঁচ ভাইয়ের বন্ধনটা আমাদের পরিবার ও ব্যবসার বড় একটা শক্তি।’
বড় ভাই সম্পর্কে জানতে চাইলে শফিকুর রহমান বললেন, ‘আমাদের পরিবারকে এক সুতায় গেঁথে রেখেছেন সেলিম ভাই। বাবার অবর্তমানে তিনিই আমাদের অভিভাবক। প্রতিদিন সকাল ঘুম থেকে সেলিম ভাই কমপক্ষে ১০ মিনিট মায়ের সঙ্গে কথা বলেন। তারপরই দিন শুরু হয় তাঁর। প্রতিদিন সকাল সাড়ে ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে কারখানায় পৌঁছান। বিকেলে মিরপুরের প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে রাত পর্যন্ত কাজ করেন। ব্যবসায়িক ব্যস্ততার পরও তিনি পরিবারের সবার খোঁজ রাখেন। অবসর পেলেই সবাইকে নিয়ে দেশে কিংবা দেশের বাইরে ঘুরতে বের হন।
সবার ঘরে পৌঁছার স্বপ্ন
হাতিল দেশের শীর্ষস্থানীয় আসবাব ব্র্যান্ডের একটি হলেও মজার তথ্য হচ্ছে, শুরুতে তেমন কোনো চিন্তাভাবনা ছিল না সেলিম এইচ রহমানের। শুনুন তাঁর মুখেই, ‘বাবার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এইচ এ টিম্বার তখনকার সময়ে সারা দেশেই পরিচিত নাম ছিল। আমি যখন ব্যবসা শুরু করি, তখন টিকে থাকাটাই ছিল বড় প্রশ্ন। ধীরে ধীরে ব্যবসা বড় হয়েছে। তবে ব্র্যান্ড করব সেই চিন্তা থেকে হাতিল করিনি। ব্র্যান্ড হচ্ছে ক্রেতাদের বিশ্বাস। অবচেতন মনে সারাক্ষণই আমরা চিন্তা করেছি, ক্রেতারা যেন আমাদের বিশ্বাস করে। সেটি থেকেই ধীরে ধীরে হাতিল ব্র্যান্ড হয়ে গেছে।’
ভবিষ্যতে হাতিল কোন পথে হাঁটবে—এমন প্রশ্নের জবাবে সেলিম এইচ রহমান, ‘আমরা আসবাব নিয়ে আছি। ভবিষ্যতেও আসবাব নিয়েই থাকতে চাই। আমরা স্বপ্ন দেখি, সবার ঘরে ঘরে হাতিল থাকবে। কবে পারব সেটি জানি না। তবে চেষ্টা করছি। সবার ঘরে পৌঁছতে আমরা তুলনামূলক কম দামে মানসম্মত ও আধুনিক নকশার পণ্য উৎপাদন শুরু করেছি।’