রাজধানীর কলাবাগান এলাকার বাসিন্দা শাহনাজ পারভীন। ঈদের দিন রোস্ট রান্না করতে গিয়ে দেখেন ঘরে তেল নেই। বাধ্য হয়ে একই ভবনের প্রতিবেশীর কাছ থেকে ধার করলেন সামান্য কিছু তেল। প্রতিবেশীর ঘরেও ছিল তেলের স্বল্পতা। তাই ইচ্ছা থাকলেও বেশি তেল দিতে পারেননি শাহনাজ পারভীনকে। সামান্য যেটুকু তেল ছিল, তা ভাগাভাগি করতে গিয়ে হাত ফসকে কিছু তেল ফ্লোরে পড়ে যায়। তাতেই শাহনাজ পারভীন ও তাঁর প্রতিবেশীর হাহাকার। একে অপরের মুখের দিকে অপলক চেয়ে ছিলেন। কারণ, তেলের এ আকালে কয়েক ফোঁটা তেলও যে মহামূল্যবান দুজনের কাছেই। এ ঘটনা ঈদের আগের দিনের।
তেল না পেয়ে ঈদের আগের দিন আর রোস্ট রান্না করা হলো না শাহনাজ পারভীনের। সেই দুঃখের কথাই তিনি জানালেন তাঁর প্রতিবেশীকে।
তেল না পেয়ে ওই দিন আর রোস্ট রান্না করা হলো না শাহনাজ পারভীনের। সেই দুঃখের কথায় তিনি জানালেন তাঁর প্রতিবেশীকে। সেই দুঃখ ঘোচানোর চেষ্টা করেও সফল হলেন না শাহনাজ পারভীনের ওই প্রতিবেশী। এ তো গেল কলাবাগানের বাসিন্দা শাহনাজ পারভীনের ঈদের দিনের দুঃখগাথা।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে বাজারসদাই করতে আসা দীপু হোসাইনের মুখটা আরও মলিন। বাজারে তেলের সংকট তাঁকে ফেলেছে মহাসংকটে। রাজধানীর কেরানীগঞ্জের বেলনা ইকো রিসোর্ট থেকে তিনি কারওয়ান বাজার এসেছেন রিসোর্টের জন্য সদাই কিনতে। দীপু হোসাইনের সদাইয়ের তালিকায় ‘তেল’-ই মুখ্য। ঈদের ছুটিতে রিসোর্টভর্তি অতিথি। অতিথি মানেই খাওয়াদাওয়া। আর বাঙালির উনুনে রান্না চড়ানো মানেই তেল। কিন্তু সেই তেল নিয়ে বাজারে চলছে তেলেসমাতি। পাড়া-মহল্লার ছোট ছোট দোকান থেকে শুরু করে পাইকারি বাজার— সর্বত্রই এখন তেলের জন্য হাহাকার।
কারওয়ান বাজারে সয়াবিন তেলের সংকট আরও প্রকট হয়েছে ১ মে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অভিযানের পর। আগে পরিবেশক বা পাইকারি বিক্রেতাদের কাছ থেকে চাহিদার বিপরীতে অল্পস্বল্প তেল মিললেও অভিযানের পর থেকে গুদামও খালি।হাজি মিজান, মালিক, হাজি মিজান এন্টারপ্রাইজ
কারওয়ান বাজারে এসে তেল না পেয়ে মলিন মুখে হাজি মিজান এন্টারপ্রাইজের সামনে একটি চেয়ারে অসহায়ের মতো বসে ছিলেন। তাঁর সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয় দোকানে তেল খুঁজতে গিয়ে। দীপু হোসাইন বলেন, ‘টাকা কোনো সমস্যা নয়। কিন্তু তেল পাচ্ছি না।’ বাজারে তেলের সংকট এতটাই যে বাড়তি টাকা দিয়েও মিলছে না এ সময়ে মহামূল্যবান হয়ে ওঠা তেল।
দীপু হোসাইন হাজি মিজান এন্টারপ্রাইজের নিয়মিত ক্রেতা। তাই দোকানির সঙ্গে রয়েছে দীর্ঘদিনের সখ্য। দীপু হোসেইনের উদ্বেগ দূর করতে দোকানি তাঁর সর্বোচ্চ চেষ্টা চালালেন। পুরো বাজার তন্ন তন্ন করে খুঁজে ৫ লিটারের তীর ব্র্যান্ডের দুই বোতল তেল জোগাড় করে দিলেন। তা-ও বাড়তি দামে ৫ লিটারের প্রতি বোতল ৯০০ টাকায়। যদিও গায়ের দাম ৭৬০ টাকা। কিন্তু তাতেও দীপু হোসেইনের চাহিদা মিটছে না। কারণ, তাঁর দরকার কমপক্ষে ৫ লিটারের ৫ বোতল তেল। কিন্তু নিরুপায় দোকানির আর যেন কিছুই করার নেই।
জানতে চাইলে হাজি মিজান এন্টারপ্রাইজের মালিক হাজি মিজান জানান, কারওয়ান বাজারে সয়াবিন তেলের সংকট আরও প্রকট হয়েছে ১ মে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অভিযানের পর। আগে পরিবেশক বা পাইকারি বিক্রেতাদের কাছ থেকে চাহিদার বিপরীতে অল্পস্বল্প তেল মিললেও অভিযানের পর থেকে গুদামও খালি। পরিবেশকেরা এখন আর তেলই তুলছেন না গুদামে। এর মধ্যে চলছে আবার ঈদের ছুটি। এ কারণে সয়াবিন তেলের সংকট এখন ‘মহাসংকট’–এ রূপ নিয়েছে।
হাজি মিজান স্টোরের পাশের দোকান জব্বার স্টোর। এ দোকানের বিক্রেতা আজিজুল জানান, তাঁর দোকানেও ঈদের আগের দিন থেকে তেল নেই। হন্যে হয়ে পরিবেশক ও পাইকারদের কাছে তেল খুঁজেও পাচ্ছেন না তাঁরা। এ দোকানে তেল খুঁজতে রাজধানীর হাতিরপুল এলাকা থেকে এসেছেন অমর সরকার। তিনি বলেন, ‘হাতিরপুলের দোকানে তেল না পেয়ে কারওয়ান বাজার এসেছি কিনতে। এখানেও একই অবস্থা। তেল নাই, তেল নাই।’
অমর সরকারের সঙ্গে কথা বলতে বলতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সোনার তরী’ কবিতার কয়েকটি লাইন যেন হঠাৎই মনে পড়ে গেল। ‘ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই/ছোট সে তরী’। তেলের ক্ষেত্রে যেন ঠিক উল্টো। দেশজুড়ে দোকান ও স্থানের কোনো অভাব নেই। শুধু সবখানেই ‘তেল নাই, তেল নাই’। অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্তের কবিতার মতো তেলের রাজ্যে আমরা যেন এখন ‘বিরাট এক নৈরাজ্যের—এক নেই—রাজ্যের বাসিন্দে’। তেল নিয়ে নৈরাজ্যের কারণেই ঈদের দিনে রোস্ট রান্না হয় না শাহনাজ পারভীনের ঘরে। আর দীপু হোসাইনরা অতিথিসেবায় তেল কিনতে ছুটে আসেন কেরানীগঞ্জ থেকে কারওয়ান বাজারে। তা-ও ফিরতে হয় মলিন মুখে। ছুটতে হয় এখান থেকে ওখানে। তেল চাই, তেল।
সয়াবিন তেল বাজার থেকে উধাও হয়ে গেলেও কারওয়ান বাজারে হাতে গোনা দুয়েকটি দোকানে অবশ্য মিলছে পাম তেল। তেমনই একটি আলী স্টোর। এখানে খোলা পাম তেল বোতলে করে ১৯০ টাকা কেজিদরে বিক্রি করা হচ্ছে। তা-ও আছে হাতে গোনা কয়েক বোতল।
এদিকে আজ বুধবার সকালে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের টাউন হল বাজারে গিয়ে দেখা যায়, বেশির ভাগ মুদিদোকানে সয়াবিন তেল নেই। ব্যবসায়ীরা বলছেন, কোম্পানির পরিবেশকেরা তাঁদের তেল দিচ্ছেন না। অনেক দোকানি ব্যবসার স্বার্থে বেশি দামে কৃষি মার্কেট থেকে কিছু তেল কিনে আনছেন। তবে সেগুলোও খুব দ্রুত বিক্রি হয়ে যাচ্ছে।
এই বাজারের দোকানি আফজাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সকাল থেকে ১২-১৫ জন ক্রেতা তেলের খোঁজ করে গেছেন। কিন্তু দিতে পারেননি। ঈদের আগে ২ লিটারের দুই কার্টন ও আধা লিটারের দুই কার্টন তেল পেয়েছিলেন। আনার কিছুক্ষণ পরই সেগুলো বিক্রি হয়ে গেছে। এর পর থেকে আর কোনো তেল পাননি বলে তিনি জানান।
তেল মিলছে না কোথাও। এ সংকট ঈদের আগে থেকেই। এ কারণে রাজধানীতেই কোথাও কোথাও পলিথিনে করে কয়েক শ গ্রাম তেলও বিক্রি হয়েছে গত কয়েক দিনে।
রাজধানীর একাধিক বাজারের ক্রেতা-বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পকেটভর্তি টাকা নিয়ে ঘুরছেন সবাই। বাড়তি দামও দিতে রাজি, কিন্তু তেল মিলছে না কোথাও। এ সংকট ঈদের আগে থেকেই। এ কারণে রাজধানীতেই কোথাও কোথাও পলিথিনে করে কয়েক শ গ্রাম তেলও বিক্রি হয়েছে গত কয়েক দিনে।