করোনার সময়ে দেশের ব্যবসা–বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বেসরকারি খাত যত বেশি সহযোগিতা পাবে, তত দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে এবারের বাজেট ভালো হয়েছে বলতে হবে।
প্রস্তাবিত বাজেটে আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে যাতে দেশীয় শিল্পের সুরক্ষা হয়, সে জন্য কয়েকটি খাতে ১০ বছরের জন্য কর ছাড় দেওয়া হয়েছে, এটা খুবই ইতিবাচক। বাজেটে অটোমোবাইল, থ্রি হুইলার এবং ফোর হুইলার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, তথ্যপ্রযুক্তি, হার্ডওয়্যার, গৃহস্থালি পণ্য এবং হালকা প্রকৌশল শিল্পের পণ্য উৎপাদনকারী কোম্পানিকে ১০ বছরের জন্য কর অব্যাহতি দেওয়ার ঘোষণা খুবই ইতিবাচক পদক্ষেপ। দীর্ঘ সময় কর ছাড় দেওয়ার ফলে উদ্যোক্তারা এসব খাতে বিনিয়োগে উৎসাহী হবে। আবার মোটরগাড়ি, এলপিজি সিলিন্ডার, রেফ্রিজারেটর উৎপাদনকারীদের ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা বাড়ানো উদ্যোক্তাদের স্বস্তি দেবে। আমদানি নির্ভরতা কমবে।
করোনার সময় ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাজেটে এসএমই খাতের নারী উদ্যোক্তাদের বার্ষিক ৭০ লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেনকে কর অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। তবে এটা এক কোটি টাকা পর্যন্ত করার পাশাপাশি সব এসএমই উদ্যোক্তাকে এ ছাড় দেওয়া উচিত। কারণ, এক কোটি টাকা বেশি মনে হলেও মাসে টার্নওভারের পরিমাণ মাত্র সোয়া আট লাখ টাকার মতো। পুঁজিবাজারে এসএমএই খাতের প্রতিষ্ঠানকে তালিকাভুক্ত করতে বিশেষ কর ছাড় দেওয়া উচিত। তাহলে এই খাতের প্রতিষ্ঠানের পুঁজিবাজারে অন্তর্ভুক্তি বাড়বে।
আগাম কর প্রত্যাহার দেখব বলে প্রত্যাশা ছিল। প্রায় সব খাতের উদ্যোক্তারা এই কর প্রত্যাহার চেয়েছেন। কিন্তু বাজেটে সেটি ১ শতাংশ কমিয়ে ৩ শতাংশ করা হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এটা অনেক বোঝা ব্যবসায়ীদের জন্য। কারণ, ব্যবসা করে মুনাফা করলে কর দেওয়ার কথা। এখন ব্যবসা করার আগে অর্থাৎ পণ্য উৎপাদনের আগেই এই কর দিয়ে দিতে হচ্ছে। করোনার এ সময়ে আগাম কর পরিশোধ করতে গিয়ে অনেকের পুঁজিতে টান পড়ছে।
বাজেটে দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নে কৃষি, মৎস্য, বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ওপর যেসব প্রতিষ্ঠান পেশাগত প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, তাদের ১০ বছরের কর অব্যাহতির সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এটা নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ। দেশে কম–বেশি প্রতিটি খাতে দক্ষ জনশক্তির অভাব রয়েছে। দক্ষ জনশক্তির অভাবে পোশাক খাতের মতো অনেক খাতে বিদেশিদের নিয়োগ দিতে হচ্ছে। এ নিয়ে বিজিএমইএসহ অনেক সংস্থা কাজ করছে। বাজেটে এই প্রস্তাবনায় অনেকে প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট গড়ে তুলতে উদ্যোগী হবেন। তবে কর ছাড় যাতে অটোমোবাইল, হালকা প্রকৌশল কিংবা মোবাইল খাতের প্রশিক্ষণ প্রদানে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও দেওয়া হয়, তা আহ্বান জানাই।
তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এবারের বাজেটেও। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ক্লাউড সার্ভিস, ই–বুক পাবলিকেশন, ফ্রিল্যান্সিং সেবা থেকে প্রাপ্ত আয় ২০২৪ সাল পর্যন্ত কর অব্যাহতির উদ্যোগ দেশে তরুণ উদ্যোক্তা তৈরিতে ভূমিকা রাখবে। এটা সময়োপযোগী পদক্ষেপ।
বন্দর–সুবিধা বাড়ানো নিয়ে আরেকটু জোর দেওয়া উচিত ছিল বাজেটে। সরকার মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর বাস্তবায়ন করছে। সেটি যুক্ত হবে ২০২৬ সালে। এখন দরকার বে টার্মিনালের নির্মাণকাজ শুরু করা। বাজেট বক্তৃতায়ও অর্থমন্ত্রী বলেছেন, বে টার্মিনাল নির্মিত হলে জাহাজের গড় অবস্থান সময় কমে আসবে। বে টার্মিনাল হলে সারা দেশের ব্যবসায়ীরা সহজে বৈদেশিক বাণিজ্যের পণ্য আনা–নেওয়ার সুযোগ পাবেন। পোশাকশিল্পের রপ্তানি পণ্যও দ্রুত ক্রেতার কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে।
পোশাক খাত নিয়ে সরকার খুবই আন্তরিক। তবে এই খাতকে আরও প্রতিযোগিতামূলক করতে পোশাকশিল্পে রপ্তানি বৈচিত্র্যের জন্য কৃত্রিম তন্তুভিত্তিক পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ নগদ সহায়তা দেওয়া উচিত।
মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে শুল্ক–সুবিধা থাকলেও যন্ত্রপাতির সঙ্গে যুক্ত সরঞ্জাম খালাসে সমান সুবিধা দেওয়া উচিত। আবার কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্পে ভ্যাট ছাড় দেওয়া উচিত। এই খাতে ছোট উদ্যোক্তার সংখ্যাই বেশি। অনেক তরুণ কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্পে যুক্ত হচ্ছেন। তাঁদের সুরক্ষা দিলে উদ্যোক্তার সংখ্যা বাড়বে।
সব মিলিয়ে শিল্প খাতের জন্য ভালো বাজেট হয়েছে। এবারের বাজেট শিল্পবান্ধব বাজেট। শিল্পায়ন হলে দেশে কর্মসংস্থান বাড়বে। করোনার এ দুঃসময়ে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে গতি পাবে।