সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে। অতি মুনাফার ফাঁদে ফেলে এভাবে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার সবচেয়ে বড় দুটি উদাহরণ হলো ডেসটিনি ও যুবক। এ দুটি প্রতিষ্ঠান সাধারণ গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করে প্রায় সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
ডেসটিনির বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলায় প্রধান অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল আমীন এখন আটক হলেও চিকিৎসার নামে হাসপাতালে আছেন। অন্যদিকে নয় বছর ধরে টাকা ফেরত পাওয়ার অপেক্ষায় আছেন যুবকের তিন লাখ গ্রাহক।
হাওয়াই ব্যবসায় ৪ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ: ৪ হাজার ১১৯ কোটি ২৪ লাখ টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগে বিচার হচ্ছে ডেসটিনি গ্রুপের প্রেসিডেন্ট, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, পরিচালকসহ ২২ জনের। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত করে দেখেছে, উচ্চ হারে মুনাফার লোভ দেখিয়ে এমএলএম (বহুস্তরের বিপণন) ব্যবসা পদ্ধতিতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড এবং ডেসটিনি ট্রি প্ল্যান্টেশন লিমিটেডের বিভিন্ন প্যাকেজের শেয়ার দেখিয়ে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন গ্রুপের পরিচালকেরা। ওই সব অর্থ ৩২টি অলাভজনক প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের নামে নিজেদের ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর করেছেন ডেসটিনির পরিচালকেরা। কিন্তু এখনো তাঁদের বিরুদ্ধে বিচারকাজ শেষ হয়নি।
অভিযুক্ত ব্যক্তিরা নিজেরা লাভবান হওয়ার জন্য ২০০৯ সালের জুলাই থেকে ২০১২ সালের জুন মাস পর্যন্ত ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির (ডিএমসিএসএল) সাড়ে আট লাখেরও বেশি বিনিয়োগকারীর সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। এ সময় ঋণ প্রদান, অলাভজনক প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ, নতুন প্রতিষ্ঠান খোলার নামে বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ১ হাজার ৯০১ কোটি ২৬ লাখ ২৫ হাজার টাকা সংগ্রহ করা হয়। সেই অর্থ থেকেই আসামিরা লভ্যাংশ, সম্মানী ও বেতন-ভাতার নামে ১ হাজার ৮৬১ কোটি টাকারও বেশি অর্থ সরিয়ে নেন।
২০০৬ সালের ২১ মার্চ থেকে ২০০৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আইন ও বিধি লঙ্ঘন করে গাছ বিক্রির নামে ডেসটিনি ট্রি প্ল্যান্টেশন লিমিটেডের (ডিটিপিএল) জন্য ২ হাজার ৩৩৫ কোটি ৭৪ লাখ ৮৫ হাজার ৫০০ টাকা জনগণের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়। এ অর্থ থেকে ২ হাজার ২৫৭ কোটি ৭৮ লাখ ৭৭ হাজার ২২৭ কোটি টাকা প্রতারণার মাধ্যমে আত্মসাৎ করেছেন প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ কর্মকর্তারা। এ অর্থ বেতন-ভাতা, সম্মানী, লভ্যাংশ, বিশেষ ভাতা বা কমিশনের আকারে আত্মসাৎ বা নিজ ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর করার প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত দল।
নয় বছর ধরে অপেক্ষায় যুবকের তিন লাখ গ্রাহক: অতি মুনাফার লোভ দেখিয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে যুব কর্মসংস্থান সোসাইটি বা যুবক। ১৯৯৬ সালে যুবকের নিবন্ধন দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধকের কার্যালয় (রেজসকো)।
রাজধানীর শাহবাগে আজিজ কো-অপারেটিভ মার্কেটে কয়েকটি দোকান ভাড়া নিয়ে যাত্রা শুরু করে যুবক। ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠানটি উচ্চ সুদের বিনিময়ে আমানত সংগ্রহ ও ঋণদান কর্মসূচি চালু করে। ২০০৫ সালে যুবকের প্রতারণামূলক কার্যক্রম নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হতে থাকলে তদন্তে নামে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অবৈধ ব্যাংকিংয়ের অভিযোগে তখন যুবকের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর এক দফা সময় বাড়িয়ে ২০০৭ সালের ৩১ মার্চের মধ্যে যুবকে গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
কিন্তু এ টাকা গ্রাহকদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব নেবে অর্থ মন্ত্রণালয়, নাকি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, তা নিয়ে কেটে যায় কয়েক বছর। গত নয় বছরেও যুবকের তিন লাখ চার হাজার গ্রাহক তাদের পাওয়া ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা ফেরত পাননি। এদিকে ব্যাংক হিসাব জব্দ না করায় ব্যাংক হিসাবে থাকা টাকা উঠিয়ে নিয়ে গেছেন যুবকের উদ্যোক্তারা। আবার যুবকের সম্পদ বাজেয়াপ্ত না করায় অনেক সম্পদ রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দখল হয়ে গেছে, আবার অনেক সম্পদ বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। গ্রাহকদের পাওনা, সম্পদের দায়দেনাসহ যুবকের আর্থিক কেলেঙ্কারির পরিমাণ ৪ হাজার ২০০ কোটি টাকা বলে জানা গেছে।
১০ মাসে বিনিয়োগ ডাবল!: ইউনিপেটুইউ নামে প্রতিষ্ঠানটি ১০ মাসে বিনিয়োগের দ্বিগুণ গ্রাহককে ফেরত দেওয়ার ফাঁদ পাতে। স্বর্ণে বিনিয়োগ করার স্কিমও নেয়। হাজার হাজার গ্রাহক এ ফাঁদে পা দেন। এভাবে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেন ইউনিপের চেয়ারম্যান শহীদুজ্জামান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুনতাসির হোসেন। ২০১১ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিষ্ঠানটির ওপর তদন্ত করে এ তথ্য পায়। বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, গ্রাহকদের কাছ থেকে শত শত কোটি টাকা নিয়ে তা বিনিয়োগ করেনি। ইউনিপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাবে প্রায় ৪১১ কোটি টাকা সরিয়ে নেওয়া হয়, যার পুরোটাই উচ্চ মুনাফার লোভ দেখিয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে।