'পরিবর্তনজটে' তিতাসের দুর্নীতি অনুসন্ধান!
দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের নানা দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান চলছে ঢিমেতালে। বারবার অনুসন্ধান কর্মকর্তা বদলের জটে তেমন অগ্রগতি হচ্ছে না সরকারি সেবা সংস্থাটির শীর্ষ কর্তাদের দুর্নীতির অভিযোগ। তবে দুদক বলছে, অনুসন্ধান এগিয়ে চলছে। অভিযোগের প্রকৃতি ও ব্যাপকতার কারণে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সময় বেশি লাগতে পারে।
দুদক সূত্র জানায়, তিতাসের কর্মকর্তাদের দুর্নীতির তিনটি বড় অভিযোগ অনুসন্ধান করছে সংস্থাটি। এসব অভিযোগের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে সাবেক এমডি থেকে শুরু করে শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা ও সিবিএ নেতারা রয়েছেন। দীর্ঘ অনুসন্ধানে কাগজপত্র সংগ্রহ ছাড়া তেমন অগ্রগতি নেই বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন।
জানতে চাইলে দুদকের উপপরিচালক (জনসংযোগ) প্রণব কুমার ভট্টাচার্য প্রথম আলোকে বলেন, অনুসন্ধান বা তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। নানা কারণে কমিশন নানা বিচার–বিশ্লেষণ করেই এ পরিবর্তন করে। অনুসন্ধান বা তদন্তের প্রয়োজনে কর্মকর্তা পরিবর্তন হতে পারে। আবার বদলির কারণেও এটা হয়। তবে তাতে অনুসন্ধানে প্রভাব পড়ে না।
দুদক সূত্র বলছে, শিল্পপ্রতিষ্ঠানে গ্যাসের অবৈধ সংযোগ, সীমার অতিরিক্ত গ্যাস ব্যবহারের সুযোগ দিয়ে ঘুষ গ্রহণসহ বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তিতাসের গাজীপুর ও টঙ্গী অঞ্চলের শীর্ষ কয়েক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হয় ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে। অনুসন্ধানের প্রাথমিক পর্যায়ে এর দায়িত্ব ছিল উপপরিচালক আহমারুজ্জামানের। প্রেষণে দুদকে আসা এই কর্মকর্তা কয়েক মাস আগে পদোন্নতি পেয়ে নিজ প্রতিষ্ঠান পুলিশে ফিরে যান। অনুসন্ধান পর্যায়ে অভিযোগ সম্পর্কে প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন তিনি। নতুন অনুসন্ধানের দায়িত্ব পান দুদকের আরেক উপপরিচালক এ কে এম মাহবুবুর রহমান। তাঁর নেতৃত্বে একটি অনুসন্ধান দল গঠন করা হয়। দলের অন্য দুই সদস্য হলেন উপসহকারী পরিচালক মো. সাইদুজ্জামান ও মোহাম্মদ শাহজাহান মিরাজ। দলটি দায়িত্ব নেওয়ার পর সেপ্টেম্বরে দুই দফায় তিতাসের পাইপলাইন ডিজাইন বিভাগের ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী সাব্বের আহমেদ চৌধুরী এবং ইলেকট্রিক্যাল কোরেশন কন্ট্রোল (ইসিসি) বিভাগের ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মো. আবু বকর সিদ্দিকুর রহমানকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুই দফায় তলব করেন। কিন্তু তাঁরা হাজির হননি। এরই মধ্যে আবারও অনুসন্ধান কর্মকর্তা পরিবর্তন করে নতুন করে উপপরিচালক মো. মনজুর আলমের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি দল গঠন করা হয়।
পুরোনো ওই অভিযোগের সঙ্গে গাজীপুর, সাভার, ভালুকা ও নারায়ণগঞ্জ অঞ্চলে তিতাসের এমডিসহ পদস্থ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ‘কেজি মেপে ঘুষ লেনদেন’ শিরোনামের আরেকটি প্রতিবেদন যুক্ত করে দেওয়া হয়। গত ২০ সেপ্টেম্বর ‘তিতাসে “কেজি মেপে” ঘুষ লেনদেন’ শিরোনামে প্রথম আলোয় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে তিতাসের ঘুষ লেনদেনের একটি চিত্র তুলে ধরা হয়।
ওই প্রতিবেদনে তিতাসের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মীর মশিউর রহমান, পাইপলাইন ডিজাইন বিভাগের ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী সাব্বের আহমেদ চৌধুরী, ইলেকট্রিক্যাল কোরেশন কন্ট্রোল (ইসিসি) বিভাগের ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মো. আবু বকর সিদ্দিকুর রহমান, গাজীপুরের চলতি দায়িত্বে থাকা মহাব্যবস্থাপক (বর্তমানে জিএম, ভিজিল্যান্স) এস এম আবদুল ওয়াদুদ এবং সাবেক কোম্পানি সচিব ও বর্তমানে সুন্দরবন গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির এমডি মোশতাক আহমেদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির কথা বলা হয়েছে।
অভিযোগে বলা হয়, সাব্বের আহমেদ চৌধুরী গাজীপুর বিক্রয় অঞ্চলে এবং মো. আবু বকর সিদ্দিকুর রহমান টঙ্গী উত্তরের সিস্টেম অপারেশন বিভাগের ব্যবস্থাপক থাকার সময়ে ঘুষ নিয়েছেন প্রধানত স্থাপনা পুনর্বিন্যাস, গ্রাহকদের অবৈধ গ্যাস-সংযোগ, গ্যাসের অবৈধ লোড বৃদ্ধি, অনুমোদন অতিরিক্ত স্থাপনা ব্যবহারের অবৈধ সুযোগ এবং পছন্দসই পদায়নকে কেন্দ্র করে। অভিযোগে খুদে বার্তায় ঘুষের আলাপের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে খুদে বার্তার রেকর্ড উল্লেখ করে বলা হয়, গাজীপুরে অবস্থিত এএমসি নিট কম্পোজিট নামের একটি প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশলী প্রদীপ দাসের কাছ থেকে তিতাস কর্মকর্তা সাব্বের আহমেদ চৌধুরী পরিবার যে ঘুষ নিয়েছে, এর মধ্যে ৫০ লাখ টাকা নেওয়ার একটি ঘটনা ২০১৬ সালের ১৩ অক্টোবরের। ওই দিন সাব্বের-প্রদীপের খুদে বার্তাগুলোয় ৫০ লাখ টাকা বুঝিয়ে দেওয়ার কথোপকথনের রেকর্ড রয়েছে। একইভাবে গাজীপুরের ভিয়েলাটেক্স লিমিটেড নামের প্রতিষ্ঠান থেকেও সাব্বের আহমেদ ও মীর মশিউর রহমানের বিরুদ্ধে ঘুষের বিষয়টি উঠে এসেছে। অনুরূপভাবে মো. আবু বকর সিদ্দিকুর রহমানসহ সবুর, জাহাঙ্গীর, টেপা, নোমান ও কাদেরসহ বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে ঘুষের অভিযোগ রয়েছে।
অন্যদিকে, মিটার টেম্পারিং ও মিটার বাইপাস করে গ্যাস–সংযোগ দিয়ে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের আরও একটি অভিযোগ ২০১৭ সালের এপ্রিল থেকে অনুসন্ধান করছে দুদক। ওই অভিযোগে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে সাবেক এমডি মীর মসিউর রহমানসহ আটজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করেন অনুসন্ধান কর্মকর্তা ও দুদকের উপপরিচালক মো. ফরিদ আহমেদ পাটোয়ারী। কিন্তু অসুস্থতার কথা জানিয়ে দুদকে হাজির হননি তাঁরা। এরই মধ্যে ৪ অক্টোবর প্রতিষ্ঠানটির পাঁচ কর্মকর্তার বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা চেয়ে ইমিগ্রেশনে চিঠি দেন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। এর কয়েক দিন পরই অনুসন্ধান কর্মকর্তা পরিবর্তন করে উপপরিচালক গোলাম শাহরিয়ার চৌধুরীকে নতুন দায়িত্ব দেওয়া হয়। জানা গেছে, আগের অনুসন্ধান কর্মকর্তা ফরিদ আহমেদ পাটোয়ারীকে প্রেষণে নদী রক্ষা কমিশনে পাঠানো হয়েছে।
সিবিএ নেতাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান
তিতাসের সিবিএ সভাপতি ও দুই যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে আলাদা আরেকটি অনুসন্ধান করছে দুদক। সংস্থার উপসহকারী পরিচালক মো. সাইদুজ্জামান অনুসন্ধানের দায়িত্ব আছেন।
সিবিএ সভাপতি কাজীম উদ্দিনসহ অন্যদের বিরুদ্ধে অবৈধ গ্যাস–সংযোগ ও মিটার টেম্পারিংসহ বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ এবং অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে।
অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে সিবিএ সভাপতি কাজীম উদ্দিন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আয়াজ উদ্দিন, সহকারী ব্যবস্থাপক ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মোহাম্মদ নাসীর উদ্দিন, হিসাব রক্ষক আসাফুদ্দৌল্লাহ টুটুল ও সাভার মিটারিং অ্যান্ড ভিজিল্যান্স শাখার ডেপুটি ম্যানেজার মো. সিরাজুল ইসলামকে সেপ্টেম্বরে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়।
এ ছাড়া তিতাসের আরও অন্তত এক ডজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে অনুসন্ধান চলমান। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অনুসন্ধানে দীর্ঘ সময় লাগার কারণে অনেক সময় অভিযোগ–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা অভিযোগের বিষয়গুলোর ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারেন। অনেকে সময় নথিপত্রসহ নানা প্রমাণ গায়েব করার মতো কর্মকাণ্ডেও জড়িয়ে যেতে পারেন। তবে দুদক বলছে, অনুসন্ধানে সময় নেওয়া হয় যথাযথ তথ্য–প্রমাণ জোগাড় করার জন্য। যত দ্রুত প্রয়োজনীয় দলিলপত্র ও প্রমাণ পাওয়া যায়, তত দ্রুতই অনুসন্ধান শেষ হয়।