'জান বাঁচাতে চাইলে বাড়ি ফাঁকা করে দে'
‘কয়েক দিন আগে এক লোক বাড়িতে এসে ছেলেকে বলল, বাড়ি ছেড়ে চলে যা। ভোট শেষ হলে ফিরে আসবি। ছেলে বলল, কেন যাব, আমরা কি সন্ত্রাসী? পরদিন কয়েকজন আসেন। তারা বলল, জান বাঁচাতে চাইলে বাড়ি ফাঁকা করে দে। সেই থেকে ছেলে আর বাড়ি নেই। এখন সে বেঁচে আছে না মরে গেছে, তা-ও জানি না।’
নাটোরের লালপুরের বিরুপাড়া নিজের বাড়ির দাওয়ায় বসে এভাবেই আশঙ্কার কথা বলছিলেন বৃদ্ধ আয়েশা বেওয়া। শীতের সকালের সোনালি রোদ এসে বৃদ্ধার মুখে পড়েছে। বাঁ হাতে শাড়ির আঁচল মুখে টেনে বললেন, ‘বাবা, আমরা কি দেশে থাকতে পারব না?’
উপজেলার পুরাতন ঈশ্বরদী ভাদুরবটতলা, মমিনপুর, ভবানীপুর, ফুলবাড়ী, ওয়ালিয়া, দুড়দুড়িয়া, দাঁড়পাড়া ও রহিমপুর এলাকার বেশ কিছু বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, পুলিশ ও র্যাব পরিচয়ে কিছু লোক তাঁদের বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন। তাঁরা ভোটের দিন ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার কথা বলছেন। কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। আর যাঁরা আওয়ামী লীগের নিশ্চিত ভোটার নন, তাঁদের ভোটের সময় পর্যন্ত এলাকার বাইরে থাকতে বলা হচ্ছে। বাসিন্দাদের অভিযোগ, দিনের বেলা র্যাব-পুলিশ পরিচয়ে এলেও রাতে আসছেন আওয়ামী লীগের লোকজন। তাঁরা বিএনপি কর্মীদের বাড়িঘরে হামলা করছেন, মারধর করছেন।
জানতে চাইলে র্যাবের নাটোর ক্যাম্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহরিয়ার রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এটা র্যাবের কাজ নয়। এ ধরনের কাজের সঙ্গে র্যাব যুক্ত নয়। তবে র্যাব পরিচয়ে কেউ এটা করে থাকতে পারে।
সংসদ নির্বাচনের পরিস্থিতি নিয়ে কথা হয় জেলা প্রশাসক ও রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. শাহরিয়াজের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা মুখে মুখে এসব কথা শুনছি। কিন্তু কেউ সুনির্দিষ্টভাবে বলছেন না। তারপরও অভিযোগ যা পাচ্ছি, পুলিশ বা সংশ্লিষ্টদের বলছি তদন্ত করে দেখতে।’
নাটোরে অনেকের মুঠোফোনে ঘুরছে একটি ভিডিও। গত সোমবার (২৪ ডিসেম্বর) বিকেলে এই ভিডিও ধারণ করা। এতে দেখা যায়, নাটোরের লালপুর উপজেলার আড়বাব এলাকায় নাটোর-১ (লালপুর-বাগাতিপাড়া) আসনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী পথসভা চলছে। সেখানে উপস্থিত আছেন দলের প্রার্থী শহিদুল ইসলাম, বর্তমান সাংসদ মো. আবুল কালাম আজাদ। বক্তৃতায় দলের উপজেলা সভাপতি আফতাব হোসেন বলছেন, ‘বিএনপি ভাইদের উদ্দেশে বলতে চাই, ঠিক হয়ে যান। আর যদি ঠিক না হন, ১০ বছর ভালো ছিলেন, আগামী পাঁচ বছর কী হবে, আমরা বলতে পারব না। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা প্রস্তুত রয়েছে। ৩০ তারিখ যাঁরা নৌকায় ভোট দিবেন, তাঁরাই যাবেন কেন্দ্রে। আর কাউকে যেতে দেওয়ার সুযোগ নাই। নৌকার বাইরে আর কোনো প্রতীকের ভোট থাকবে না, থাকবে না।’
জানতে চাইলে আফতাব হোসেন বলেন, ‘এটা আমার রাজনৈতিক বক্তব্য। আসলে কর্মীদের চাঙা করার জন্য নেতারা এ ধরনের কথা বলেই থাকে। এটা সত্যিকার নয়। মানুষ ভোটকেন্দ্রে তো যাবেই।’
নাটোর-২ আসনে রাস্তাঘাটে চলছে আওয়ামী লীগের প্রার্থী শফিকুল ইসলামের জমজমাট প্রচার-প্রচারণা। আর বিএনপির প্রার্থী সাবিনা ইয়াসমিন বাড়ির চারতলায় মাইক লাগিয়ে প্রচার করছেন। গতকাল সকালে তাঁর বাড়িতে গেলে তিনি বলেন, ‘রাস্তায় তো মাইকিং করা যায় না, প্রতিপক্ষরা মাইক ভেঙে ফেলছে। তাই বাড়ির ছাদে লাগিয়ে প্রচার করছি।’ তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘আমি একের পর এক অভিযোগ করছি, নিরাপত্তা চাচ্ছি, কিন্তু প্রতিকার পাচ্ছি না।’
নাটোর-৩ আসনে বিএনপির প্রার্থী দাউদার মাহমুদের অভিযোগ, প্রায় প্রতিদিনই তাঁদের দলের লোকজনের ওপর হামলা হচ্ছে। এসব হামলার সময় পুলিশ নীরব ভূমিকা পালন করছে। ভয়ে কেউ বের হতে পারছেন না। দাউদারের সঙ্গে কথা বলার সময় তাঁর এক কর্মী ৪৭টি মামলার ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেন।
এসব অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে নাটোরের পুলিশ সুপার সাইফুল্লাহ আল মামুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছি। কাউকে ছাড় দেওয়া হচ্ছে না।’
নাটোর-৪ আসনের বড়াইগ্রাম ও গুরুদাসপুরের রাস্তাঘাটে সর্বত্রই নৌকার পোস্টার শোভা পাচ্ছে। এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবদুল কুদ্দুস। আর গতকালই বিএনপির প্রার্থী আবদুল আজিজের প্রার্থিতা স্থগিত করেন হাইকোর্ট। উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের পদে থেকে মনোনয়নপত্র দাখিলের বৈধতা নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী রিট করেছিলেন। প্রার্থিতা স্থগিতের পরপরই দলের প্রচারণা বন্ধ হয়ে যায়। আবদুল আজিজ জানান, আদালতে তাঁর প্রার্থিতা স্থগিতের সিদ্ধান্তে তিনি স্তম্ভিত। নেতা-কর্মীদের মনোবলও ভেঙে গেছে। তাঁর দাবি, এ সবকিছুই প্রতিপক্ষকে ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়ার আয়োজন। এর আগেও তিনি সহজভাবে প্রচারণায় থাকতে পারেননি। প্রতিপক্ষের হামলা-মামলায় তিনিসহ নেতা-কর্মীরা কষ্টে ছিলেন।