করোনা সংক্রমণ কিছুটা নিম্নগামী। সড়ক পরিবহনের ক্ষেত্রে এখন আর তেমন বিধিনিষেধ নেই। নৌপথেও স্বাভাবিকভাবেই যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে। কিন্তু সরকারের সংস্থা রেলে এখনো স্বাভাবিক চলাচল শুরু হয়নি। সারা দেশে এখনো ৯২টি মেইল, লোকাল ও কমিউটার ট্রেন চালু হয়নি। রেলে এসব ট্রেন ‘গরিবের’ বাহন হিসেবে পরিচিত। এই ট্রেনগুলো শিগগিরই চালু হওয়ার কোনো সম্ভাবনাও নেই।
করোনা সংক্রমণের কারণে প্রায় দুই মাস যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকা, পরে অর্ধেক আসন ফাঁকা রেখে ট্রেন পরিচালনা এবং লোকালসহ কিছু ট্রেন চালু না করার প্রভাব পড়েছে আয়ে। গত পাঁচ মাসে ক্রমাগত লোকসান গুনতে থাকা সরকারের সংস্থা রেলের আয় কমেছে ৫২ শতাংশ। যাত্রী কমে গেছে ৬২ শতাংশ।
করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির আগে ময়মনসিংহ-ভৈরব পথে চারটি লোকাল ট্রেন চলাচল করত। মার্চে বন্ধ হওয়ার পর সেগুলো আর চালু হয়নি। স্বাধীনতার পরপরই ঈশা খাঁ এক্সপ্রেস নামে দুটি মেইল ট্রেন ঢাকা থেকে ময়মনসিংহের পথে চলাচল করত। করোনা সংক্রমণের আগে হঠাৎ করে সেগুলোও বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে এই পথে এখন আর কোনো লোকাল বা মেইল ট্রেন চলছে না। অথচ ময়মনসিংহ ও কিশোরগঞ্জ জেলার ২২টি স্টেশনের মাধ্যমে এসব লোকাল ও মেইল ট্রেনে যাতায়াত করত লাখো মানুষ। কমবেশি একই অবস্থা ময়মনসিংহ-জামালপুর, ভৈরব-আখাউড়া, চট্টগ্রাম-চাঁদপুরসহ আরও কিছু পথে।
সব মিলিয়ে ভেবেচিন্তে এবং পর্যায়ক্রমে লোকাল ও মেইল ট্রেনগুলো চালু করা হবে।নূরুল ইসলাম, রেলমন্ত্রী
রেলওয়ে বলছে, লোকাল ও মেইল ট্রেনে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চালানো কঠিন। গাদাগাদি করে যাত্রী পরিবহনের কারণে করোনার সংক্রমণ বাড়তে পারে। ফলে সরকারের উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্ত ছাড়া লোকাল ও মেইল ট্রেন চালু করা যাবে না।
রেলওয়ে সূত্র বলছে, বন্ধ থাকা লোকাল, মেইল ও কমিউটার ট্রেন চালুর বিষয়ে রেলের খুব একটা আগ্রহ নেই। এমনও আলোচনা আছে, বন্ধ পথের অনেকগুলোতে আবার ট্রেন চালু না–ও করা হতে পারে। ইঞ্জিন-কোচসংকট এবং আয় কম—এই যুক্তিতে দীর্ঘদিন ধরেই কিছু লোকাল ও মেইল ট্রেন বন্ধের চেষ্টা করে আসছিল কর্তৃপক্ষ। করোনার কারণে বন্ধ হওয়ার সুযোগটা নিতে চাইছে রেল।
রেলে সব মিলিয়ে ৩৫৯টি যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করে। এর মধ্যে আন্তনগর ট্রেনের সংখ্যা ১০৪টি। ঢাকা-কলকাতা পথে চলে চারটি ট্রেন। বাকি সব কটি মেইল, লোকাল ও কমিউটার ট্রেন হিসেবে চলাচল করে। করোনার সংক্রমণ শুরু হলে মার্চের শেষের দিকে সব যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। অর্ধেক আসনের টিকিট বিক্রিসহ নানা বিধিনিষেধ নিয়ে ৩১ মে থেকে আট জোড়া ট্রেন চালু করা হয়। এরপর পর্যায়ক্রমে ট্রেনের সংখ্যা বেড়েছে। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতে সব আন্তনগরসহ বেশির ভাগ ট্রেন চালু হয়। বিধিনিষেধও উঠে যায়।
রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, এই মুহূর্তে লোকাল ট্রেনগুলো চালু করার বিষয়ে তাঁরা কিছুটা নিরুৎসাহিত করছেন। প্রথমত, লোকবলের ঘাটতি আছে। আছে ইঞ্জিন–কোচের সংকট। কিছু ট্রেন বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় চলত। সেগুলো রেল নিজে চালাবে। এর বাইরে করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি তো আছেই। সব মিলিয়ে ভেবেচিন্তে এবং পর্যায়ক্রমে লোকাল ও মেইল ট্রেনগুলো চালু করা হবে। তিনি বলেন, করোনার প্রভাব সব খাতেই পড়েছে। রেলের আয় কমবে—এটা তাঁদের ধারণার মধ্যেই ছিল।
আয়ে টান পড়েছে
রেলের আয়সংক্রান্ত নথি বলছে, গত জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে রেল যাত্রী পরিবহন করেছে প্রায় ১ কোটি ৩৮ লাখ। গত বছর একই সময়ে যাত্রী পরিবহন করে ৩ কোটি ৬৬ লাখের বেশি। অর্থাৎ চলতি বছরে এই সময়ে যাত্রী পরিবহন ৬২ শতাংশ কমে গেছে।
রেলওয়ে সূত্র বলছে, বন্ধ থাকা লোকাল, মেইল ও কমিউটার ট্রেন চালুর বিষয়ে রেলের খুব একটা আগ্রহ নেই। এমনও আলোচনা আছে, বন্ধ পথের অনেকগুলোতে আবার ট্রেন চালু না–ও করা হতে পারে। ইঞ্জিন-কোচসংকট এবং আয় কম—এই যুক্তিতে দীর্ঘদিন ধরেই কিছু লোকাল ও মেইল ট্রেন বন্ধের চেষ্টা করে আসছিল কর্তৃপক্ষ। করোনার কারণে বন্ধ হওয়ার সুযোগটা নিতে চাইছে রেল।
যাত্রী পরিবহন কমে যাওয়ার কারণে স্বভাবতই টান পড়েছে আয়ে। জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে রেল যাত্রী পরিবহন করে আয় করেছে ২০৬ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। অথচ গত বছর একই সময়ে যাত্রী পরিবহন করে রেল আয় করেছিল ৪৩২ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত বছর একই সময়ের তুলনায় অর্ধেকের কম আয় হয়েছে।
রেলওয়ে সূত্র বলছে, লোকাল ও মেইল ট্রেনে যত ইচ্ছা যাত্রী চলতে পারে। এসব ট্রেন থামে প্রায় সব স্টেশনেই। ফলে এই ট্রেনগুলোতে বেশি যাত্রী পরিবহন করে। তবে ভাড়া তুলনামূলক কম বলে আয় কম হয়। এ ছাড়া স্বল্প দূরত্বে ও নিম্ন আয়ের মানুষ বেশি চলাচল করে বলে টিকিট কাটার হারও কম। সব মিলিয়ে আয় কম, যাত্রী বেশি। অন্যদিকে আন্তনগর ট্রেনে টিকিটের দাম বেশি। নির্ধারিত পরিমাণের বাইরে টিকিট বিক্রি হয় না।
রেলের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, সব আন্তনগর ট্রেন চালু হলেও আসন পূর্ণ করে চলতে পারছে না। যাত্রী বাড়লে লোকাল ট্রেন বন্ধ থাকলেও আয়ে খুব একটা প্রভাব পড়ত না। তবে লোকাল ও মেইল ট্রেন বন্ধের পাশাপাশি আন্তনগর ট্রেনে যাত্রী কম হওয়ায় আয়ে প্রভাব পড়ছে। অর্থাৎ রেল পুরোপুরি সেবাও দিতে পারছে না, আবার আয়ও কমছে।
রেলের আয়সংক্রান্ত নথি বলছে, গত জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে রেল যাত্রী পরিবহন করেছে প্রায় ১ কোটি ৩৮ লাখ। গত বছর একই সময়ে যাত্রী পরিবহন করে ৩ কোটি ৬৬ লাখের বেশি। অর্থাৎ চলতি বছরে এই সময়ে যাত্রী পরিবহন ৬২ শতাংশ কমে গেছে।
বাংলাদেশ-ভারত রেল চলাচল অনিশ্চিত
ঢাকা-কলকাতার মধ্যে সপ্তাহে মৈত্রী এক্সপ্রেসের আটটি ট্রেন আসা-যাওয়া করে। এর মধ্যে বাংলাদেশের চারটি, ভারতের চারটি ট্রেন। মাসে গড়ে ১ লাখ ৮০ হাজার যাত্রী চলাচল করে। অন্যদিকে খুলনা-কলকাতা পথে বন্ধন এক্সপ্রেস নামে সপ্তাহে দুটি ট্রেন চলাচল করে। করোনার কারণে এই দুই পথেই ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে।
বাংলাদেশ-ভারত ট্রেন চলাচল দেখভালে নিয়োজিত রেলের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, দুই দেশে ট্যুরিস্ট ভিসা চালু না হলে মৈত্রী বা বন্ধন এক্সপ্রেস চালু করা সম্ভব নয়। মার্চের আগে ভারতের সঙ্গে ট্রেন চালু হওয়ার সম্ভাবনা কম।