স্বাস্থ্যখাত নিয়ে রোজিনার প্রতিবেদন–২
৩৫০ কোটি টাকার জরুরি কেনাকাটায় অনিয়ম
যেসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চিকিৎসা সরঞ্জাম ও সুরক্ষাসামগ্রী সরবরাহ করেছিল, তাদের অনেকের সঙ্গে নিয়ম অনুযায়ী চুক্তি পর্যন্ত হয়নি।
অনিয়মের কথা জানিয়ে গত ৯ ফেব্রুয়ারি সিএমএসডির পরিচালকের চিঠি।
তদন্ত হলেও এখন পর্যন্ত কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
সরকারি আইন ও বিধি না মেনেই কেন্দ্রীয় ঔষধাগার (সিএমএসডি) গত বছর প্রায় ৩৫০ কোটি টাকার চিকিৎসা সরঞ্জাম ও সুরক্ষাসামগ্রী কিনেছিল। যেসব প্রতিষ্ঠান এসব সরঞ্জাম সরবরাহ করেছে, তাদের সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে চুক্তি পর্যন্ত ছিল না। কেনাকাটার পুরো প্রক্রিয়ায় পণ্যের মান নিশ্চিত করার বিষয়টি ভাবা হয়নি। এমনকি ন্যায্য দাম নিশ্চিত করতে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর দর-কষাকষির ব্যবস্থাও ছিল না। আবার চাহিদা অনুযায়ী, সব সরঞ্জাম ঠিকমতো বুঝেও নেওয়া হয়েছিল কি না, সেটিও নিশ্চিত করা যায়নি।
করোনা মহামারির প্রথম ঢেউ মোকাবিলার জন্য গত বছরের জুনের আগে জরুরি ভিত্তিতে ওই সব কেনাকাটা হয়েছিল। তখন অন্তত ৫১টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রীয় ঔষধাগারকে চিকিৎসা সরঞ্জাম ও সুরক্ষাসামগ্রী সরবরাহ করেছে। ওই কেনাকাটায় গুরুতর অনিয়ম হওয়ার কথা উল্লেখ করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব বরাবর গত ৯ ফেব্রুয়ারি চিঠি দিয়েছেন সিএমএসডির পরিচালক। এসব অনিয়মের ঘটনায় ব্যবস্থা নিতে চিঠিতে অনুরোধ জানানো হয়েছে। একই সঙ্গে এ বিষয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠনের উদ্যোগ নিতেও সুপারিশ করা হয়েছে।
সিএমএসডির পরিচালকের এই চিঠির অনুলিপি পাঠানো হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, অর্থ বিভাগ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিট এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে।
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অধীন একটি প্রতিষ্ঠান সিএমএসডি। প্রতিষ্ঠানটির উপপরিচালক তউহীদ আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা চিঠি পাঠিয়েছি, টাস্কফোর্স গঠন করে সমস্যা সমাধানের কথাও বলেছি। কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এখন পর্যন্ত কোনো কিছু জানায়নি।’
সিএমএসডি থেকে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, ৩৫০ কোটি টাকার কেনাকাটায় সরাসরি ক্রয় পদ্ধতির প্রাথমিক প্রক্রিয়াসমূহ যেমন ক্রয় প্রস্তাব অনুমোদন, আনুষ্ঠানিক দর-কষাকষি, দরপত্র/প্রস্তাব মূল্যায়ন কমিটির মতামত অনুসরণ করা হয়নি। বিপুল অঙ্কের আর্থিক সংশ্লিষ্টতা থাকলেও সরকারি ক্রয়বিধি অনুসরণ করে ক্রয় অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষের অনুমোদন গ্রহণ করা হয়নি। কার্য সম্পাদন জামানত গ্রহণ এবং সরবরাহ চুক্তি সম্পাদন করা হয়নি। সরবরাহ আদেশে পণ্য সরবরাহের নির্দিষ্ট সময়সীমা উল্লেখ ছিল না। সংশ্লিষ্ট সামগ্রীর পরিমাণ উল্লেখ করা হলেও নির্ধারিত কোনো একক মূল্য ও মোট মূল্য উল্লেখ করা হয়নি।
সিএমএসডির কর্মকর্তারা বলছেন, ওই সব কেনাকাটার জন্য প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দও তখন নিশ্চিত করা হয়নি। সিএমএসডির আগের প্রশাসনের সময় এসব অনিয়ম হয়েছে। বিধি না মেনে যেসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান গত বছর চিকিৎসা সরঞ্জাম ও সুরক্ষাসামগ্রী সরবরাহ করেছে, তারা এখন বিল দাবি করছে। বিভিন্ন মাধ্যমে বিল পরিশোধের জন্য ক্রমাগত চাপও সৃষ্টি করছেন। সিএমএসডির বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মাঝেমধ্যেই সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের অনাকাঙ্ক্ষিত ও বিব্রতকর পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটছে।
সিএমএসডির বিগত প্রশাসনের সময়ে সরবরাহকৃত কোভিড–১৯ সরঞ্জামের কিছু বিল পরিশোধের বিষয়ে নির্দেশনার অনুরোধ করে গত জুনে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে চিঠি পাঠানো হয়েছিল। সে সময় বলা হয়, নানা প্রক্রিয়াগত ত্রুটি–বিচ্যুতির কারণে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে ওই সব কেনাকাটায় অনিয়মের বিষয়টি তদন্তাধীন রয়েছে। সিএমএসডি এ বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কোনো নির্দেশনা পায়নি।
এসব কেনাকাটার বিষয় তদন্ত করতে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও অডিট অনুবিভাগ বিভাগ) শাহাদাত হোসেনের নেতৃত্বে একটি কমিটি করা হয়েছিল। কমিটির তদন্তে কী বের হয়ে এল জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘জরুরি পরিস্থিতিতে এসব কেনাকাটা করা হয়েছিলে বলে আমরা জানিয়েছি। তবে পিপিআর অনুযায়ী বা কেনাকাটার নিয়মনীতি কোনো কিছুই মানা হয়নি, অনুসরণ করা হয়নি।’ তিনি বলেন, দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ তাঁরা করেছেন। দায়ী কারা জানতে চাইলে তিনি বলেন, তখন কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের প্রশাসনে যাঁরা দায়িত্বে ছিলেন। তবে তদন্ত কমিটিকে কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের কর্মকর্তারা বলেছেন, তৎকালীন পরিচালকের একক সিদ্ধান্তে ওই কেনাকাটা হয়েছে। এ অবস্থায় সরকারের উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্ত ছাড়া এ সমস্যা সমাধান হবে না।
উল্লেখ্য, গত বছরের ২২ মে সিএমএসডির পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শহীদউল্লাহকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তাঁর স্থলে আবু হেনা মোরশেদ জামানকে পদায়ন করা হয়।
সিএমএসডির নথিপত্র অনুযায়ী, ২০২০ সালের জুন মাসের আগে ১ হাজার ২৮৫ কোটি ২২ লাখ ৪১ হাজার টাকার প্রাক্কলিত মূল্যে ১৯৬টি প্যাকেজে বিভিন্ন কোভিড–১৯ সামগ্রী ক্রয়ের পরিকল্পনা হয়েছিল। এর মধ্যে ৩৪৪ কোটি ১১ লাখ ৫৭ হাজার টাকা চুক্তিমূল্যে মোট ৫৭টি প্যাকেজের দরপত্র মূল্যায়ন প্রতিবেদন অনুমোদনের জন্য স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে পাঠানো হয়েছে।
ওই সময় যাঁরা করোনা শনাক্তের কিট এবং পিপিই সরবরাহ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে তিনজন ঠিকাদার প্রথম আলোকে বলেন, সিএমএসডির তৎকালীন পরিচালক তাঁদের অনুরোধ করেছিলেন। আবার অনেক সময় তিনি স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলিয়ে দিয়েছেন। তখন পরিস্থিতি এমন ছিল যে চুক্তি, নিয়ম—এসব বিষয় নিয়ে ভাবার সময় ছিল না।
প্রসঙ্গত, সিএমএসডির তৎকালীন পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শহীদুল্লাহ গত ২৫ জুলাই করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। মৃত্যুর আগে গত বছরের ৩০ মে জনপ্রশাসন সচিবকে লেখা চিঠিতে তিনি বলেছিলেন, স্বাস্থ্য খাতের আলোচিত ঠিকাদার মোতাজজেরুল ওরফে মিঠু কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে যোগসাজশে বাজেট থেকে শুরু করে কেনাকাটার পরিকল্পনাও তৈরি করতেন। তারপর সেই তালিকা ধরে সিএমএসডিকে দিয়ে জিনিসপত্র কেনানো হতো। নামে-বেনামে অনেক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আছে তাঁর। ঘুরেফিরে এই প্রতিষ্ঠানগুলোই সিএমএসডির দরপত্র প্রক্রিয়ায় অংশ নিত।
জনপ্রশাসন সচিবকে লেখা ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছিল, সিএমএসডি ঢাকার সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জন্য কিছু যন্ত্রপাতি কেনাকাটার বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিল। একটি প্রতিষ্ঠান কাজ শেষ করে ৪৫০ কোটি টাকা তুলে নিয়ে যাওয়ার পর জানা যায় যে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজে যন্ত্রপাতিই পৌঁছায়নি। এই প্রতিষ্ঠানসহ যত প্রতিষ্ঠান প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিল, প্রতিটিরই মালিক মোতাজজেরুল ওরফে মিঠু।
মোতাজজেরুলের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। মোতাজজেরুল বেশ কয়েক মাস ধরেই দেশে নেই বলে দুদক সূত্র জানিয়েছে।