৩ পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাচন হয় না ২৭ বছর

তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাচন হওয়ার কথা পাঁচ বছর পরপর। কিন্তু এই পরিষদ গঠিত হওয়ার পর একবারই নির্বাচন হয়েছে, তা-ও ২৭ বছর আগে। নির্বাচন না হওয়ায় পরিষদ চলছে সরকারের মনোনীত দলীয় ব্যক্তিদের দিয়ে।
দীর্ঘদিন মনোনীত ব্যক্তিদের দিয়ে চলায় পরিষদকে ঘিরে দুর্নীতিবাজ চক্র গড়ে উঠেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে পরিষদ এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা পরিষদের প্রথম ও একমাত্র নির্বাচন হয়েছিল ১৯৮৯ সালে (তৎকালীন রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান স্থানীয় সরকার পরিষদ)। ওই পরিষদের মেয়াদ ছিল তিন বছর। ১৯৯৮ সালে মেয়াদ বাড়িয়ে পাঁচ বছর করা হয়। নির্বাচিত জেলা পরিষদে একজন চেয়ারম্যান ও ৩২ জন সদস্য থাকার কথা।
কিন্তু এরপর আর নির্বাচন না হওয়ায় সরকার একজন চেয়ারম্যানসহ পাঁচ সদস্যের মনোনীত পরিষদ গঠন করে। নির্বাচনের সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে পড়ায় জেলা পরিষদগুলোকে প্রতিনিধিত্বশীল করার জন্য সদস্যসংখ্যা বাড়িয়ে ১৫ করা হয়। বর্তমানে একজন চেয়ারম্যানসহ ১৫ সদস্যের মনোনীত পরিষদ পার্বত্য জেলা পরিষদগুলো পরিচালনা করছে।
সরকারি-বেসরকারি সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থানীয় সরকারের সর্বোচ্চ স্তর হচ্ছে আঞ্চলিক পরিষদ। তাদের কাজ মূলত সমন্বয়মূলক। মাঠপর্যায়ে কাজ করে জেলা পরিষদ। দীর্ঘদিন ধরে মনোনীত ব্যক্তিদের দিয়ে চলায় জেলা পরিষদগুলো সরকারের একপ্রকার দলীয় কার্যালয়ে পরিণত হয়েছে। অনির্বাচিত হওয়ায় জনগণের কাছে পরিষদের জবাবদিহিরও অভাব রয়েছে। ফলে জেলা পরিষদগুলো ঘিরে দুর্নীতির চক্র গড়ে উঠেছে।
স্থানীয় সূত্রগুলো বলেছে, তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের কার্যক্ষেত্র দেশের অন্য ৬১টি জেলার জেলা পরিষদের তুলনায় অনেক বেশি ব্যাপৃত। মাঠপর্যায়ে অনেক প্রকল্প বাস্তবায়নসহ বহুমুখী কাজ করে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ। এই পরিষদ অনির্বাচিত ও দলীয় মনোনীত ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত হওয়ায় এর চারপাশে দলের একশ্রেণির নেতা-কর্মী সমবেত হয়েছেন। নানা রকম দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে। এমন অনেক প্রকল্পের নামে টাকা কিংবা খাদ্যশস্য বরাদ্দ হয় যে প্রকল্প কখনো বাস্তবায়িত হয়নি। এ ছাড়া সাধারণ মানুষের অনেক প্রয়োজনীয় কাজের জন্যও এই দলীয় নেতা-কর্মীদের দ্বারস্থ হয়ে দুর্নীতির শিকার হতে হয়।
এই অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কংজ্যরি চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই। আর বান্দরবান জেলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ক্য সা প্রু ৯ অক্টোবর প্রথম আলোকে বলেন, অনিয়ম-দুর্নীতি করার কোনো সুযোগ নেই। জেলা পরিষদের আকার বৃদ্ধি পাওয়ায় জনগণকে সেবা দেওয়ার সুযোগ আরও বেড়েছে।
তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাচন না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে সরকারের একটি সূত্র বলেছে, এ ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে ভোটার তালিকা। জনসংহতি সমিতিসহ (জেএসএস) পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর দাবি, স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠান হিসেবে জেলা পরিষদের নির্বাচনে পাহাড়ি-বাঙালিনির্বিশেষে ওই এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা ছাড়া কেউ ভোটার হতে পারবেন না। তাদের এই দাবির সারমর্ম হচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের পুনর্বাসিত (সেটেলার) বাঙালিরা জেলা পরিষদের নির্বাচনে ভোটার হতে পারবে না।
জেএসএসের এই দাবির বিরোধিতা করছে পুনর্বাসিত বাঙালিরা। তা ছাড়া আইন অনুযায়ী সব ধরনের নির্বাচনের জন্য দেশে একটিই মাত্র ভোটার তালিকা হবে। সে অনুযায়ী বর্তমানে যে ভোটার তালিকা রয়েছে, তাতে পার্বত্য চট্টগ্রামের পুনর্বাসিত বাঙালিরাও অন্তর্ভুক্ত। জেলা পরিষদ নির্বাচনের জন্য আলাদা একটি ভোটার তালিকা করা আইনের বিধান অনুযায়ী সম্ভব নয়। এই অবস্থায় সরকার পার্বত্য জেলা পরিষদে দলীয় ব্যক্তিদের মনোনীত করার সুযোগ নিচ্ছে।
জানতে চাইলে পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান প্রথম আলোকে বলেন, পার্বত্য জেলা পরিষদগুলোর নির্বাচন খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। কিন্তু কবে তা হতে পারবে, তা অনিশ্চিত। ইতিমধ্যে মনোনীত পরিষদের আকার বাড়ানোও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি এবং জেলা পরিষদ আইনের লঙ্ঘন। কেননা, ওই চুক্তি ও আইনে বলা হয়েছে, এ ধরনের যেকোনো বিষয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কিন্তু তা করা হয়নি।
পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও জেএসএসের সূত্র বলেছে, তারা তিন পার্বত্য জেলা ও আঞ্চলিক পরিষদ নির্বাচনের লক্ষ্যে নির্বাচন বিধিমালা এবং স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে ভোটার তালিকা তৈরির বিধিমালা প্রণয়নের দাবি জানিয়ে আসছে দীর্ঘদিন থেকে। নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে তারা নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) চিঠিও দিয়েছিল। কিন্তু কোনো জবাব পায়নি।
এ বিষয়ে ইসির সূত্র বলেছে, সরকার না বললে তারা পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নিতে পারে না। কারণ, স্থানীয় সরকারের নির্বাচন অনুষ্ঠান তাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব নয়, আইনি দায়িত্ব। সরকারের চাহিদা অনুযায়ী তারা এই দায়িত্ব পালন করে।