হেফাজতের মামলা নিয়ে নতুন করে তৎপর পুলিশ
সাত বছর আগে হেফাজতে ইসলামের ঢাকা অবরোধকে কেন্দ্র করে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় করা মামলাগুলো নিয়ে নতুন করে তৎপর হচ্ছে পুলিশ। পুলিশের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র প্রথম আলোকে জানিয়েছে, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সবুজ সংকেতের পর হিমঘরে থাকা মামলাগুলো পুনরুজ্জীবিত হচ্ছে।
হেফাজত–সংশ্লিষ্ট কেউ কেউ মনে করছেন, এতদিন হেফাজতের একটা অংশের সঙ্গে সরকারের এক ধরনের বোঝাপড়া ছিল। তাই মামলাগুলো চাপা পড়েছিল। এরই মধ্যে হেফাজতের প্রতিষ্ঠাতা আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফীর মৃত্যুর পর সংগঠনে নতুন নেতৃত্ব এসেছে। এরপর ভাস্কর্যবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে হেফাজতকে চাপে রাখতে মামলাগুলো সামনে আনা হচ্ছে।
এদিকে আল্লামা শাহ আহমদ শফীর মৃত্যুর তিন মাস পর তাঁকে হত্যার অভিযোগে গত বৃহস্পতিবার হেফাজতের ৩৬ জন নেতা-কর্মীকে আসামি করে চট্টগ্রাম আদালতে মামলা হয়। এই মামলাকেও ‘রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র’ এবং ‘চাপে ফেলার কৌশল’ বলে দাবি করছেন হেফাজতের নেতারা। চট্টগ্রামের মামলায় ভাস্কর্যের বিরোধিতা করে আলোচনায় আসা হেফাজতের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হকও রয়েছেন।
সরকারের নির্দেশ পেলে তদন্ত শেষ করে হেফাজতে ইসলামের বিরুদ্ধে করা মামলাগুলোর অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।
রাজধানীর শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন চলাকালে কথিত নাস্তিক ব্লগারদের শাস্তিসহ ১৩ দফা দাবি নিয়ে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে হঠাৎ আলোচনায় আসে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। ওই বছরের ৫ মে ঢাকার ছয়টি প্রবেশমুখে অবরোধ কর্মসূচি শেষে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে অবস্থান নেন হেফাজতের বিপুলসংখ্যক কর্মী-সমর্থক। তাঁরা দিনভর বিভিন্ন স্থাপনা ও যানবাহনে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেন।
পরদিন ৬ মে চট্টগ্রামের হাটহাজারী, নারায়ণগঞ্জ, বাগেরহাটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হেফাজতের কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে হেফাজতের কর্মীদের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হেফাজতের ২২ কর্মীসহ ৩৯ জন নিহত হন।
এসব ঘটনায় ঢাকাসহ সারা দেশে ৮৩টি মামলা হয়। এগুলোর মধ্যে ২২টি মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করা হলেও বাকি ৬০ মামলার তদন্ত স্থবির হয়ে পড়ে। যেসব মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়, সেগুলোর বিচার কার্যক্রমও অনেকটা স্থবির হয়ে আছে। বাগেরহাটের একটি মামলার রায় হয়, তাতে সব আসামি খালাস পান।
হেফাজতের নেতা-কর্মীরা এত দিন মনে করেছিলেন, যথাসময়ে হেফাজতের বিরুদ্ধে করা মামলাগুলো প্রত্যাহার করা হবে।
সারা দেশে হেফাজতের যেসব মামলার তদন্ত চলমান আছে, তা যথানিয়মে তদন্ত সম্পন্ন করে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।মো. সোহেল রানা, পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি-গণমাধ্যম ও জনসংযোগ)
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, ২০১৩ সালের ঘটনায় ৮৩ মামলার মধ্যে রাজধানীতে ৫৩টি মামলা হয়। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, কক্সবাজার ও লক্ষ্মীপুরে ৩০টি মামলা করা হয়। এসব মামলায় হেফাজতে ইসলাম, ইসলামী ঐক্যজোট, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রশিবির, নেজামে ইসলাম, খেলাফত মজলিস, খেলাফত আন্দোলন, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতা-কর্মীদের আসামি করা হয়।
মামলায় ৩ হাজার ৪১৬ জনের নামসহ ৮৪ হাজার ৯৭৬ জনকে আসামি করা হয়। হেফাজতের তৎকালীন আমির শাহ আহমদ শফীকে কোনো মামলায় আসামি করা হয়নি। পরে হেফাজতের কেন্দ্রীয় কমিটির মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরীসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতাসহ ৮৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাঁরা জামিনে মুক্তি পান।
পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি-গণমাধ্যম ও জনসংযোগ) মো. সোহেল রানা প্রথম আলোকে বলেন, সারা দেশে হেফাজতের যেসব মামলার তদন্ত চলমান আছে, তা যথানিয়মে তদন্ত সম্পন্ন করে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে। মামলাগুলোর বিষয়ে সরকারের কোনো নির্দেশনা আছে কি না জানতে চাইলে তিনি এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি।
ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) জানায়, রাজধানীতে করা ৫৩টি মামলার মধ্যে ৪টির অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে, বাকি ৪৯টির তদন্ত শেষ হয়নি। এসব মামলায় প্রায় আড়াই শ নেতার নামসহ অন্তত ৪০ হাজার অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি করা হয়।
মামলার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে ডিএমপির কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম গত মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, হেফাজতের বিরুদ্ধে হওয়া মামলাগুলোর তদন্ত অব্যাহত আছে।
তদন্তে যুক্ত থাকা কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৩ সালের ৫ মে ঘটনার পর হেফাজতের কেন্দ্রীয় নেতা জুনায়েদ বাবুনগরী, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিব মুফতি ওয়াক্কাসসহ কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ৫ মে এক পুলিশ সদস্য নিহতের ঘটনায় বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতা মওদুদ আহমদ, এম কে আনোয়ার, রফিকুল ইসলাম মিয়াকেও গ্রেপ্তার করা হয়।
ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) যুগ্ম কমিশনার মো. মাহবুব আলম প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের নির্দেশ পেলে তদন্ত শেষ করে হেফাজতে ইসলামের বিরুদ্ধে করা মামলাগুলোর অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।
ঢাকার বাইরে
২০১৩ সালে ঢাকার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ওই দিন এবং পরদিন বাগেরহাটে হেফাজতের কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে হেফাজতের দুজন কর্মী নিহত হন। এ ঘটনায় ফকিরহাটে চারটি ও বাগেরহাট সদর থানায় দুটি মামলা করে পুলিশ। এতে হেফাজত, জামায়াত ও স্থানীয় বিএনপির ৮৮ জন নেতা-কর্মীসহ ১০-১২ হাজার অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি করা হয়। একইভাবে নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর-শিমরাইল এলাকায় হেফাজতের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশ-বিজিবির সংঘর্ষ এবং নিহতের ঘটনায় সোনারগাঁ ও সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় আটটি মামলা হয়।
পুরোনো ইস্যুকে টেনে এনে মামলাগুলো সচল করার অর্থ হচ্ছে ষড়যন্ত্র করা।আজিজুল হক ইসলামাবাদী, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক
সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ওসি মো. মশিউর রহমান জানান, সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় হওয়া সাত মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে।
হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদী প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুরোনো ইস্যুকে টেনে এনে মামলাগুলো সচল করার অর্থ হচ্ছে ষড়যন্ত্র করা।’