হুমায়ুন আজাদের প্রথাবিরোধিতা ও বহুমাত্রিকতা
হুমায়ুন আজাদ একজন মেধাবী সাহিত্যিক। মূলত ভাষা নিয়েই বেশি কাজ করেছেন। ভাষাবিজ্ঞানের ওপর আটটি বই আছে তাঁর। ভাষাবিজ্ঞানের বইগুলো সাহিত্যের জন্য সম্পদ। সাহিত্য–সাহিত্যিক আলোচনা বইগুলোয় চমৎকার মুনশিয়ানার ছাপ রেখে পাঠককে জ্ঞানের গভীরে নিয়ে যেতেন। আলোচনা ও প্রবন্ধমূলক গ্রন্থ আছে ২২টি।
হুমায়ুন আজাদের শিশুতোষ গ্রন্থগুলোও চমৎকার। তাঁর আটটি কিশোর সাহিত্যের বই রয়েছে। উপন্যাসের ক্ষেত্রেও দারুণ সফল তিনি। কিছু ক্ষেত্রে বিতর্কিতও হয়েছেন। ১৩টি উপন্যাসের বই মানোত্তীর্ণ। কবি হিসেবেও যথেষ্ট সফল। কয়েকটি কবিতা তো অনেক পাঠকপ্রিয়। ‘সবকিছু নষ্টদের অধিকার’-এর মতো কিছু কবিতার অংশ তো প্রবাদপ্রতিম হয়ে গেছে। ‘এ লাশ আমরা রাখব কোথায়?/ তেমন যোগ্য সমাধি কই?/ মৃত্তিকা বলো, পর্বত বলো/ অথবা সুনীল-সাগর-জল—/ সবকিছু ছেঁদো, তুচ্ছ শুধুই!/ তাই তো রাখি না এ লাশ/ আজ মাটিতে পাহাড়ে কিম্বা সাগরে,/ হৃদয়ে হৃদয়ে দিয়েছি ঠাঁই।’ (এ লাশ আমরা রাখব কোথায়) বিভিন্ন লেখায় আমরা ব্যবহার করে থাকি। কবি হিসেবে কম আলোচিত হলেও সাতটি কবিতার বই আছে। সাক্ষাৎকারমূলক বইগুলো যেন জ্ঞানের সাগরে সিঞ্চিত। এ রকম ছয়টি বই আছে হুমায়ুন আজাদের। ‘আধুনিক বাঙলা কবিতা’ (১৯৯৪) নামে একটি সম্পাদিত বই রয়েছে। ‘যাদুকরের মৃত্যু’ (১৯৯৭) নামে একটি গল্পগ্রন্থও আছে।
বহুমাত্রিক ও প্রথাবিরোধী মননশীল-লেখক, ঔপন্যাসিক, কবি ও গবেষক অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ (২৮ এপ্রিল, ১৯৪৭-১১ আগস্ট, ২০০৪) ছিলেন একজন বাংলাদেশি কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, সমালোচক, গবেষক, ভাষাবিজ্ঞানী, কিশোর সাহিত্যিক এবং রাজনৈতিক ভাষ্যকার। গতানুগতিক চিন্তাধারা তিনি সচেতনভাবে পরিহার করতেন। হুমায়ুন আজাদের প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৭০–এর বেশি। ১৯৯২ সালে নারীবাদী গবেষণামূলক গ্রন্থ ‘নারী’ প্রকাশ করে সাড়া ফেলেন। বইটি পাঁচ বছর বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ছিল। বইটি তাঁর আলোচিত গবেষণামূলক কাজ হিসেবেও স্বীকৃত। সামগ্রিক সাহিত্যকর্ম ও ভাষাবিজ্ঞানে অবদানের জন্য তাঁকে ১৯৮৬ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং ২০১২ সালে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করা হয়। তাঁর রচিত কিশোরসাহিত্য ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত ‘আব্বুকে মনে পড়ে’ জাপানি ভাষায় অনূদিত হয়েছে ২০০৩ সালে।
মূলত গবেষক ও প্রাবন্ধিক হলেও হুমায়ুন আজাদ ১৯৯০-এর দশকে একজন প্রতিভাবান ঔপন্যাসিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তাঁর প্রকাশিত উপন্যাসের সংখ্যা ১৩। তাঁর ভাষা দৃঢ়, কাহিনির গঠন সংহতিপূর্ণ এবং রাজনৈতিক দর্শন স্বতঃস্ফূর্ত। তাঁর উপন্যাস ‘ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইল’ (১৯৯৪), ‘সব কিছু ভেঙে পড়ে’ (১৯৯৫), ‘মানুষ হিশেবে আমার অপরাধসমূহ’ (১৯৯৬), ‘যাদুকরের মৃত্যু’ (১৯৯৬), ‘শুভব্রত’, ‘তার সম্পর্কিত সুসমাচার’ (১৯৯৭), ‘রাজনীতিবিদগণ’ (১৯৯৮), ‘কবি অথবা দণ্ডিত অপুরুষ’ (১৯৯৯), ‘নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু’ (২০০০), ‘ফালি ফালি করে কাটা চাঁদ’ (২০০১), ‘শ্রাবণের বৃষ্টিতে রক্তজবা’ (২০০২), ‘১০,০০০, এবং আরো ১টি ধর্ষণ’ (২০০৩), ‘একটি খুনের স্বপ্ন’ (২০০৪), ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ (২০০৪)।
আশির দশকের শেষভাগ থেকে হুমায়ুন আজাদ বাংলাদেশের সমসাময়িক ও রাজনীতি নিয়ে গণমাধ্যমে বক্তব্য ও লিখতে শুরু করেন। এ সময় তিনি সাপ্তাহিক ‘খবরের কাগজ’ পত্রিকায় নিবন্ধ লিখতে শুরু করেন। সামরিক শাসনের বিরোধিতা দিয়ে তাঁর রাজনৈতিক লেখালেখির সূত্রপাত। তাঁর প্রকাশিত ‘আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম’ গ্রন্থটি মূলত রাষ্ট্রযন্ত্রের ধারাবাহিক সমালোচনা। তাঁর প্রবন্ধগ্রন্থগুলো হচ্ছে ‘শিল্পকলার বিমানবিকীকরণ ও অন্যান্যপ্রবন্ধ’ (১৯৮৮), ‘ভাষা-আন্দোলন: সাহিত্যিক পটভূমি’ (১৯৯০), ‘নারী’ (১৯৯২), ‘প্রতিক্রিয়াশীলতার দীর্ঘ ছায়ার নিচে’ (১৯৯২), ‘নিবিড় নীলিমা’ (১৯৯২), ‘মাতাল তরণী’ (১৯৯২), ‘নরকে অনন্ত ঋতু’ (১৯৯২), ‘জলপাই রঙের অন্ধকার’ (১৯৯২), ‘রবীন্দ্র প্রবন্ধ/রাষ্ট্র ও সমাজচিন্তা’ (১৯৯৩), ‘শামসুর রাহমান/নিঃসঙ্গ শেরপা’ (১৯৯৩), ‘সীমাবদ্ধতার সূত্র’ (১৯৯৩), ‘আধার ও আধেয়’ (১৯৯৩), ‘আমার অবিশ্বাস’ (১৯৯৭), ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম: সবুজ পাহাড়ের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হিংসার ঝরনাধারা’ (১৯৯৭), ‘মহাবিশ্ব’ (২০০০), ‘দ্বিতীয় লিঙ্গ’ (মূল: সিমোন দ্য বোভোয়ার, ২০০১), ‘আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম’ (২০০৩), ‘ধর্মানভূতির উপকথা ও অন্যান্য’ (২০০৪)। ‘নারী’, ‘দ্বিতীয় লিঙ্গ’ এবং ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ বেশ আলোচনার জন্ম দেয়।
১৯৬০-এর দশকে হুমায়ুন আজাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের ছাত্র। তখন পশ্চিমের ভাষাবিজ্ঞানী চমিস্ক-উদ্ভাবিত ‘সৃষ্টিশীল রূপান্তরমূলক ব্যাকরণ’ (transformational-generative grammar-TGG) তত্ত্বটি আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ডিগ্রির জন্য হুমায়ুন আজাদ এ তত্ত্বের কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে বাংলা ভাষার রূপমূলতত্ত্ব তথা বাক্যতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করেন। এর মাধ্যমে বাংলার ভাষাবিষয়ক গবেষণায় আধুনিক ভাষাবৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সূত্রপাত করেন। তাঁর পিএইচডি অভিসন্দর্ভের নাম ছিল ‘Pronominaliation in Bengali’ (অর্থাৎ বাংলা সর্বনামীয়করণ)। পরবর্তী সময়ে এটি একই শিরোনামের ইংরেজি বই আকারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়। এরপর ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বাংলা ভাষার বাক্যতত্ত্বের ওপর বাক্যতত্ত্ব নামে বই প্রকাশ করেন। একই সালে তিনি বাংলা ভাষা শিরোনামে দুই খণ্ডের একটি দালীলিক সংকলন প্রকাশ করেন, যাতে বাংলা ভাষার বিভিন্ন ক্ষেত্রের ওপর বিগত শতাধিক বছরের বিভিন্ন ভাষাবিদ ও সাহিত্যিকের লেখা গুরুত্বপূর্ণ ভাষাতাত্ত্বিক রচনা সংকলিত হয়। এই তিনটি গ্রন্থ বাংলা ভাষাবিজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হিসেবে বিবেচিত হয়। তিনি পরবর্তীকালে তুলনামূলক-ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান ও অর্থবিজ্ঞানের ওপর দুটি সংক্ষিপ্ত প্রাথমিক পাঠ্যপুস্তক লেখেন। ১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে তিনি বাংলা ভাষার একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যাকরণ রচনার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তবে দুর্ভাগ্যবশত অকালমৃত্যুর কারণে তাঁর এই আগ্রহ বাস্তবায়িত হতে পারেনি।
ভাষাবিজ্ঞানী ও গদ্যের জন্য বেশি জনপ্রিয় হলেও আমৃত্যু কাব্যচর্চা করে গেছেন হুমায়ুন আজাদ। তিনি ষাটের দশকের কবিদের সমপর্যায়ী আধুনিক কবি। সমসাময়িক কালের পরিব্যাপ্ত হতাশা, দ্রোহ, ঘৃণা, প্রেম ইত্যাদি তাঁর কবিতার মূল উপাদান। নবম শ্রেণিতে পড়াকালেই কবিতাচর্চা শুরু করেন। তাঁর প্রথম লেখা ছাপা হয়েছিল দৈনিক ইত্তেফাক–এর শিশুপাতা কচিকাঁচার আসরে। হুমায়ুন আজাদের ১০টি কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে ‘অলৌকিক ইস্টিমার’ (১৯৭৩), ‘জ্বলো চিতাবাঘ’ (১৯৮০), ‘সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে’ (১৯৮৫), ‘যতোই গভীরে যাই মধু যতোই ওপরে যাই নীল’ (১৯৮৭), ‘আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে’ (১৯৯০), ‘হুমায়ুন আজাদের শ্রেষ্ঠ কবিতা’ (১৯৯৩), ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’ (১৯৯৪), ‘কাফনে মোড়া অশ্রু বিন্দু’ (১৯৯৮), ‘কাব্য সংগ্রহ’ (১৯৮৮), ‘পেরোনোর কিছু নেই’ (২০০৪)।
আজ ১২ আগস্ট বহুমাত্রিক লেখক অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের ১৩তম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমির গ্রন্থমেলা থেকে বাসায় ফেরার পথে একদল সন্ত্রাসী হুমায়ুন আজাদকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর আহত করে। হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে হুমায়ুন আজাদ সুস্থ হয়ে ওঠেন। ওই বছরের ৭ আগস্ট একটি গবেষণা বৃত্তি নিয়ে তিনি জার্মানিতে যান। এর পাঁচ দিন পর ১২ আগস্ট মিউনিখের নিজ ফ্ল্যাটে তাঁকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।
আজীবন প্রথাবিরোধী ছিলেন হুমায়ুন আজাদ। সমাজের কাঠামোয় আঘাত এনেছেন। কুসংস্কার ও ধর্মীয় বাড়াবাড়িতেও কলম ধরেছেন। বাংলা ভাষা-সাহিত্যে আগের প্রথা ভেঙে নতুনভাবে দাঁড় করাতে চেয়েছেন। সামাজিক, পারিবারিক বা রাষ্টীয়—প্রভৃতি ক্ষেত্রের অসংগতিপূর্ণ কাজের বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন। বিভিন্ন অনাচারের বিরুদ্ধে কবিতায় বা প্রবন্ধে শাণিত করেছেন। তিনি অনিয়মের কাছে মাথা নত করেননি। কোনো দিন অনিয়ম ও অন্যায় মেনে নেননি। খুব ব্যতিক্রম ছাড়া রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক কোনো প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করেননি। আবার কারও অন্যায় ও অযৌক্তিক প্রশংসায় ব্যস্ত হননি। তাঁর বিবেচনায় যা ভালো, সেটাই গ্রহণ বা মেনে নিয়েছেন। অন্য ক্ষেত্রে বিরোধিতা করেছেন। এখানেই হুমায়ুন আজাদ অনন্য হয়েছেন। হাস্যরসাত্মক ভঙ্গিতে ও অকপটে অন্যায্য তুলে ধরে বিরোধিতা করাই ছিল তাঁর চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। এতে কে কী বলল, তাতে কিছু ভাবতেন না তিনি। লক্ষ্য ও সংকল্পে অটল থাকা তাঁর চরিত্রের বড় গুণ।
হুমায়ুন আজাদ ঠোঁটকাটা লোক ছিলেন। তোষামোদবিহীন এমন লোক সাহিত্যে খুব কমই আছেন। বিশেষ করে বাংলাদেশে। ১৯৮০ সাল থেকেই তিনি পাঠকগোষ্ঠীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। প্রাবন্ধিক, ভাষাবিজ্ঞানী হিসেবে হুমায়ুন আজাদের তুলনা নেই। ক্ষণজন্মা এ মহান পুরুষ বাংলা সাহিত্যকে অনেক দিয়েছেন। এ জগতে তিনি নিজের সঙ্গেই যুদ্ধ করেছেন। তাঁর সময়ে এমন ব্যক্তিত্ব নেই বললেই চলে। আর এখন এ দুই ক্ষেত্রে তো আরও সংকটে রয়েছে। বহুমাত্রিক হুমায়ুন আজাদ বাংলা ভাষায় বিরলপ্রজ প্রতিভা। আলোচনা থেকেই এটাই প্রমাণিত হয় যে সাহিত্যক্ষেত্রের সর্বত্র হুমায়ুন আজাদের পদচারণ ছিল। প্রবন্ধ ও গবেষণার ক্ষেত্রে বাংলা সাহিত্যে যা দিয়েছেন, অনেকে তা পারেননি। শুদ্ধ ভাষার দখল ও তার সুষ্ঠু প্রয়োগ দেখানোর মতো লোক ছিলেন তিনি। তাঁর মতো ক্ষণজন্মা ভাষাবিজ্ঞানী বাংলা ভাষা কবে পাবে কিংবা আদৌ পাবে কি না, সন্দেহ আছে!
লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক। উপপরিচালক, বিআরডিবি, কুষ্টিয়া। [email protected]