স্মারকে সরব প্রথম প্রতিরোধ
এর নাম পাগলাঘণ্টা। স্বচ্ছ কাচের বাক্সটির ভেতরে রেললাইনের পাতের কাটা অংশ। পাশে হাতুড়ির মতো লৌহখণ্ড। এই দুটি জড়বস্তু জীবন্ত করে রেখেছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী রাজারবাগ আক্রমণ করতে এলে বেজে উঠেছিল এই লৌহখণ্ড। মুক্তিপাগল কোটি প্রাণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিধ্বনি হয়েই বুঝি বেজেছিল এই পাগলাঘণ্টা। তৎকালীন আইজিপির বডিগার্ড আবদুল আলী বাজিয়েছিলেন এই ঘণ্টা। ঘণ্টাধ্বনি শুনে পুলিশ সদস্যরা অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে শত্রুকে প্রতিহত করতে অবস্থান নিয়েছিলেন। তাঁদের বুকে সেদিন সমুদ্রের গর্জনের তালে বেজেছিল শিকল ভাঙার মহাসংগীত। হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধযুদ্ধের সূচনা হয়েছিল এখান থেকেই।
শুধু পাগলাঘণ্টা নয়, আছে সেই বেতারযন্ত্রটিও। রাজারবাগ আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে এই যন্ত্রটি ব্যবহার করে সারা দেশে বার্তা পাঠিয়েছিলেন শাহজাহান মিয়া ‘...উই আর অলরেডি অ্যাটাক্ড বাই পাক আর্মি। ট্রাই টু সেভ ইয়োর সেলফ।’
রাজারবাগের এই ছোট জাদুঘরটির ভেতরে কান পাতলেই শোনা যাবে ২৫ মার্চ রাতে পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের অদম্য সাহসিকতার কথা, ‘মুক্তির মন্দির সোপানতলে’ যাঁরা প্রাণ বলিদান করেছিলেন, তাঁদের অমর কাহিনি।
রাজারবাগ পুলিশ টেলিকমের পাশে যে স্মৃতিসৌধ, সেটি লাগোয়া বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। দেড় বিঘা জমির ওপর স্থাপিত এই জাদুঘরের নকশা করেছেন স্থপতি মীর আল-আমিন।
ঢুকলে প্রথমেই চোখে পড়বে বঙ্গবন্ধু গ্যালারি। দুপাশে বঙ্গবন্ধুসহ অনেক মনীষীর বাণী। ডান পাশে একটি ভার্চ্যুয়াল লাইব্রেরি। বাঁ পাশে অডিও ভিজ্যুয়াল কক্ষ। রয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বইপত্তর, বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন ভাষণ। ওপরের গ্যালারির মাঝখান দিয়ে একটি সিঁড়ি নেমে গেছে নিচে। এটাই জাদুঘরের মূল কক্ষ। এই কক্ষে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সময় পুলিশ সদস্যদের ব্যবহৃত রাইফেল, বন্দুক, মর্টার শেল, হাতব্যাগ, টুপি, চশমা, মানিব্যাগ ও ইউনিফর্ম। দেয়ালজুড়ে সেঁটে দেওয়া হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা পুলিশ সদস্যদের যুদ্ধের সময়ের ডায়েরি, হাতে লেখা বিভিন্ন বার্তা, আলোকচিত্র ও পোস্টার। আছে প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নেওয়া পুলিশ মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহৃত হাতব্যাগ, নামাজের টুপি, হাতঘড়ি, চশমা, ওষুধ, মগ, মর্টার শেল ইত্যাদি। ভাওয়াল রাজা তৎকালীন পুলিশপ্রধানকে একটি ঘোড়ার গাড়ি উপহার দিয়েছিলেন, সেটাও আছে। আছে ১৮৬৩ সালে পুলিশের ব্যবহৃত ‘লেটার বক্স’।
জাদুঘর প্রতিষ্ঠা কমিটির সভাপতি, অতিরিক্ত ডিআইজি হাবিবুর রহমান প্রথম আলোকে বললেন, ‘প্রায় ১৪ হাজার পুলিশ সদস্য মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। এর মধ্যে ১ হাজারের বেশি সদস্য শহীদ হন। আহত ও পঙ্গু হন আরও দেড় হাজার। ২৫ মার্চ কালরাতেই রাজারবাগে শহীদ হলেন অন্তত ১০০ পুলিশ সদস্য। তাঁদের সবাইকে আমরা জাদুঘরের সঙ্গে যুক্ত করতে চাই।’ তিনি জানান, ২০১৩ সালের ২৪ মার্চ জাদুঘরটি প্রথম উদ্বোধন করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পুলিশের মহাপরিদর্শক আবদুল খালেক বেতারে একটি ভাষণ দিয়ে পুলিশ বাহিনীকে উজ্জীবিত করেন। সেই ভাষণের কপিটিও আছে জাদুঘরে।
জাদুঘরের পরিচালক এআইজি আবিদা সুলতানা বললেন, ‘এই জাদুঘরে ঢুকলে আপনি জানতে পারবেন মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের অবদানের কথা। জানা যাবে ব্রিটিশ আমল থেকে কীভাবে এই বাহিনী বেড়ে উঠল সে ইতিহাসও।’
রাজশাহী বিভাগের পুলিশের উপমহাপরিদর্শক মামুন মাহমুদের পারিবারিক আলোকচিত্র ও নোটখাতা, রাজশাহীর এসপি শাহ আবদুল মজিদ, কুমিল্লার এসপি কবির উদ্দিন আহমেদ, চট্টগ্রামের এসপি এম শামসুল হক, বরিশালের অতিরিক্ত এসপি গোলাম হোসেন, পিরোজপুরের পুলিশ কর্মকর্তা ফয়জুর রহমান আহমেদ (লেখক হুমায়ূন আহমেদ ও জাফর ইকবালের বাবা)-সহ আরও অনেক শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধার কীর্তির আলোকচিত্র আছে এই জাদুঘরে। আরও আছে যুদ্ধে ব্যবহার করা বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র ও সরঞ্জাম। সবই যেন যুদ্ধদিনের জীবন্ত সাক্ষ্য বহন করে চলেছে।