তখন দিন দশেক হয় প্রথম আলোতে যোগ দিয়েছি। ছোটখাটো অ্যাসাইনমেন্ট করি আর অফিসে বসে দু-একটা প্রেস বিজ্ঞপ্তি প্রতিবেদন আকারে লিখি। একদিন প্রধান প্রতিবেদক পিন্টু ভাই (শরীফুজ্জামান) ডেকে বললেন, ‘কাল থেকে আপনি ট্রাইব্যুনালে যাবেন।’
জানতে চাইলাম, ‘কোন ট্রাইব্যুনালে?’ পিন্টু ভাই বললেন, ‘যুদ্ধাপরাধের বিচার হচ্ছে যে ট্রাইব্যুনালে। এখন থেকে রেগুলার কভার করবেন।’ পিন্টু ভাইয়ের জিজ্ঞাসু কণ্ঠ, ‘পারবেন না?’
বিস্ময় আর অবিশ্বাস গোপন করে দুর্বল কণ্ঠে আমার জবাব, ‘চেষ্টা করব।’
এর পর থেকে প্রতিদিন সকালে আমার গন্তব্য পুরোনো হাইকোর্ট ভবনের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। সকাল থেকে বিকেল অবধি এজলাসে বসে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার দেখি, তারপর অফিসে ফিরে প্রতিবেদন লিখি। আর দিনকে দিন রাষ্ট্রের জন্য স্পর্শকাতর এই বিচার কভার করতে করতে আমার অভিজ্ঞতার ঝুলি ভারী হতে থাকে।
২০১২ সালের শুরুর দিকের ঘটনা। তখন জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিচার চলছে। একদিন ট্রাইব্যুনালে গিয়ে দেখি, এজলাসে সাক্ষীর কাঠগড়া সরিয়ে ছোট একটা খাট পাতা হয়েছে। তাতে শুয়ে জবানবন্দি দেবেন মধুসূদন ঘরামী নামের এক অশীতিপর। বার্ধক্য আর অসুস্থতার কারণে তিনি বেশিক্ষণ সোজা হয়ে বসতে পারেন না, তাই এ ব্যবস্থা। সাক্ষ্য দেওয়ার একপর্যায়ে তিনি কাঁদতে শুরু করলেন। বাঁধভাঙা কান্না নয়, ভেজা নিঃশ্বাসের সঙ্গে বেরিয়ে আসছে হাহাকার। কষ্টের দমকে কেঁপে কেঁপে উঠছে তাঁর ৮১ বছরের কুঁকড়ে যাওয়া শরীর। এর মধ্যেই তিনি বলে চললেন অর্ধেক জীবন ধরে আঁকড়ে রাখা যন্ত্রণার কাহিনি। একাত্তরে সবে বিয়ে করেছেন, কয়েক দিনের মাথায় মধুসূদনের বাড়ি লুট করল পাকিস্তানি সেনাদের এদেশীয় দোসর রাজাকাররা। এরপর রাজাকারদের অব্যাহত হুমকিতে প্রাণে বাঁচতে ধর্মান্তরিত হলেন। তাতেও শেষ রক্ষা হলো না। কয়েক দিন পর রাজাকাররা ধর্ষণ করল তাঁর নববিবাহিত স্ত্রীকে। প্রাণ বাঁচাতে পালালেন এলাকা ছেড়ে। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলো, কন্যাসন্তানের বাবা হলেন মধুসূদন। কিন্তু ভাঙা ঘর আর মেরামত হলো না। সমাজ আঙুল তুলল ধর্ষণের শিকার স্ত্রী ও সদ্যোজাত কন্যার দিকে। শেষে মান বাঁচাতে স্ত্রী-সন্তানকে ভারতে পাঠিয়ে দিলেন। সেই থেকে তিনি একা। যাদের জন্য তিনি সব হারিয়েছেন, তাদের বিচারের আশায় চার দশক ধরে একাকী বেঁচে আছেন।
ওই দিন মধুসূদনের জবানবন্দি শেষে এজলাসে উপস্থিত বেশির ভাগ মানুষ যখন চোখ মুছছেন, আমি তখন তাঁর হাহাকারের ভাষা বোঝার চেষ্টা করছি। কিন্তু আমি বুঝতে পারি, স্বাধীনতার অন্তরালে লুকিয়ে থাকা কোটি মানুষের বেদনার ভাষা বোঝা আমার সমসাময়িক নাগরিক বোধের বাইরে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসিদের গেস্টাপো যেমন ছিল এক কুখ্যাত খুনে বাহিনী, তেমনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিল আলবদর। জামায়াতের নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে একদিন সাক্ষ্য দিতে ট্রাইব্যুনালে এলেন একাত্তরে ওই আলবদর বাহিনীর সদস্য মোহন মুন্সী। দীর্ঘ জবানবন্দিতে ষাটোর্ধ্ব এই বৃদ্ধ বলেন মুক্তিযুদ্ধের সময় খুনে বাহিনীতে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা।
মোহন মুন্সীকে অবশ্য আমি আগে থেকেই চিনতাম ছাত্রজীবনে ‘আলবদর’ প্রামাণ্যচিত্রে গবেষণা সহকারীর কাজ করার বদৌলতে। তাই তাঁর জবানবন্দিও ছিল আমার কাছে অনেকটাই পরিচিত। কিন্তু একটা প্রশ্ন অনেক আগে থেকেই আমার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল, এবার তা করার সুযোগ পেলাম। জবানবন্দি শেষে মোহন মুন্সী যখন সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামছিলেন, তখন তাঁর পাশে গিয়ে নিচু স্বরে জানতে চাইলাম, ‘আপনি নিজে আলবদর হয়ে আলবদরদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিলেন কেন? বেইমানি হলো না?’ বৃদ্ধের চকিত জবাব, ‘আমাকে তো ওরা (রাজাকাররা) জোর করে আলবদর বানায়। আর ওই সময় (মুক্তিযুদ্ধের সময়) তো পাকিস্তান ছিল, তাই ওদের হয়ে কাজ করলেও ক্ষতি নাই। বাংলাদেশ হইছে, এখন আমি বাংলাদেশের পক্ষে। দেশের সাথে তো বেইমানি করি নাই।’
বিস্মিত হলাম মোহন মুন্সীর ন্যায়বোধ দেখে! বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে, স্বাধীনতার বিপক্ষে কাজ করেছে, আজও মনে মনে এ দেশকে স্বীকৃতি না দিয়ে এ দেশেরই মানুষের ওপর ছড়ি ঘোরাচ্ছে, এমন মানুষের অভাব নেই। একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাদের সেই দোসররা তাদের কৃতকর্মের জন্য আজও ক্ষমা চায়নি। অথচ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই এমন এক মোহন মুন্সীরও দেশের প্রতি অবিচল আনুগত্য।
বিচার চলাকালে সাক্ষীদের কথা লেখা যায় না বলে তখন মোহন মুন্সীর এ কথা কোনো প্রতিবেদনে লিখতে পারিনি। আজ তাঁর কথা লিখলাম, কারণ মোহন মুন্সীর মতো মানুষদের জানা আমাদের খুব দরকার।
ট্রাইব্যুনালের অভিজ্ঞতা যে শুধু মুক্তিযুদ্ধের টুকরা ইতিহাস আর বেদনার দুঃখগাথা, এমন কিন্তু নয়। বিচার চলাকালে মাঝেমধ্যে এমন সব পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো, তখন হাসি চেপে রাখা কষ্টকর হয়ে উঠত। এমন একদিনের ঘটনা। জামায়াতের নেতা আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মামলার কার্যক্রম চলছে। এক বাঙালি পরিবারের ওপর পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের নির্মম নির্যাতনের বিবরণ দিচ্ছেন আইনজীবী। ইংরেজিতে দেওয়া বক্তব্যের একপর্যায়ে ওই আইনজীবী আছাড় মেরে হত্যা করার ইংরেজি ভুলে গেলেন। বললেন, ‘হিজ টু ইয়ারস ওল্ড সান ওয়াজ কিলড বাই...কিলড বাই আছড়িয়া...আপস অ্যান্ড ডাউন...।’ আছাড় মেরে হত্যা করা হয়েছে বোঝাতে তিনি হাত দিয়ে ইশারা করে দেখালেন বিচারকদের। ততক্ষণে হাসির রোল পড়ে গেছে।
ট্রাইব্যুনালে যাঁরাই সাক্ষ্য দিতে গেছেন, হয় তাঁদের বেশির ভাগ নিজে নৃশংসতার শিকার হয়েছেন, নয়তো নৃশংসতার সাক্ষী হয়েছেন। যুদ্ধের সময় মোহাম্মদপুরের শারীরিক শিক্ষা কলেজ পরিণত হয় আলবদর বাহিনীর সদর দপ্তরে, সেখানে ঘটে বীভৎস হত্যাযজ্ঞ ও নারী নির্যাতন। ওই কলেজের নিরাপত্তাকর্মী রুস্তম আলী মোল্লা কিশোর বয়সেই সেই বীভৎসতার সাক্ষী হন। ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দি দিতে গিয়ে রুস্তম জানান কীভাবে তিনি মুক্তিযুদ্ধ শেষে কলেজের পেছনে বস্তাবন্দী ১০০-১৫০ মানুষের চোখ উদ্ধার করেছেন, কীভাবে ইট পোড়ানোর চুল্লিতে মানুষের পোড়া হাড় পেয়েছেন, কীভাবে মাটি খুঁড়ে বের করেছেন মানুষের মাথার খুলি...। একাত্তরের বর্বরতাকে যেন এজলাসে দৃশ্যমান করে তুললেন এই কালের সাক্ষী।
স্বাধীনতার চার দশক পর বাংলাদেশে একাত্তরের গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরু হয়েছে। প্রতিদিন ট্রাইব্যুনালে বিচারকাজ চলছে, প্রতিদিনই এ দেশের ইতিহাস নতুনভাবে লেখা হচ্ছে। স্বাধীন বাংলাদেশের মধ্যে এই ট্রাইব্যুনাল হয়ে উঠেছেন আরেক বাংলাদেশ।
কুন্তল রায়: নিজস্ব প্রতিবেদক