সিরাজুল আলম খান এবং স্বাধীনতার নিউক্লিয়াস
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক সিরাজুল আলম খান। কেউ কেউ তাঁকে বলেন রাজনীতির রহস্যমানব। সিরাজুল আলম খান আজ শুক্রবার মারা গেছেন। তাঁকে নিয়ে লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদের লেখা ‘সিরাজুল আলম খান এবং স্বাধীনতার নিউক্লিয়াস’ শীর্ষক নিবন্ধ ২০১৯ সালে প্রথম আলোর ঈদ সংখ্যায় প্রকাশ করা হয়। তাঁর স্মরণের লেখাটি আবার প্রকাশ করা হলো।
শ্রাবণ মাসের ৬ তারিখ শুক্রবার, ২১ জুলাই ১৯৭২। মনে হচ্ছিল বৃষ্টি হবে অঝোরে। কিন্তু অবাক করা সকাল। আকাশে টুকরো টুকরো মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে, কোথাও সাদা, কোথাও ধূসর। কিন্তু রোদ আছে।
মাত্র সাত মাস হলো দেশ স্বাধীন হয়েছে। মনটা ফুরফুরে থাকার কথা। ভোর থেকেই মুহসীন হলে উত্তেজনা। ছাত্রলীগের তিন দিনের সম্মেলন শুরু হবে। কয়েকজন সঙ্গী-সাথি নিয়ে রওনা দিলাম। পল্টন ময়দানে হাজি চান মিয়া ডেকোরেটরের বানানো বিশাল শামিয়ানার নিচে শুরু হলো সম্মেলন কাঁটায় কাঁটায় ১০টায়। শুরুতে ছিল কিছু আনুষ্ঠানিকতা। উদ্বোধন করার কথা ছিল মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ছাত্রলীগের নেতা স্বপন কুমার চৌধুরীর বাবার। তিনি আসেননি। তাঁর বড় ভাই অধ্যাপক রূপেন চৌধুরী চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসেছেন। কিন্তু তিনি পল্টনে না এসে চলে গেছেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। ওখানেও সম্মেলন চলছে ছাত্রলীগের আরেক গ্রুপের। উদ্বোধন ছাড়াই শুরু হলো আমাদের সম্মেলন।
আ স ম আবদুর রব আর শাজাহান সিরাজ ছাত্রলীগ থেকে বিদায় নিচ্ছেন। তাঁরা কিছু কথাবার্তা বললেন। তারপর ঘণ্টাখানেকের বিরতি। ওই সময় লাল মলাটের একটা বুকলেট বিলি করা হলো। রাজনৈতিক রিপোর্ট। আমরা তখন দিল্লি-মস্কোর চোখ দিয়ে দুনিয়া দেখার চেষ্টা করছি। পুস্তিকায় তার ছাপ আছে। এক জায়গায় মন্তব্য ছিল, ‘পীত সাম্রাজ্যবাদী চীন’। এই শব্দচয়ন আমাদের অনেকেরই ভালো লাগেনি। কিন্তু চোখ আটকে গেল অন্য একটি বাক্যে, ‘১৯৬২ সাল থেকেই ছাত্রলীগের ভেতরে একটি নিউক্লিয়াস বাংলাদেশের স্বাধীনতার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছিল।’
১৯৬৯ সালের শেষ দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই দেখেছি, ছাত্রলীগের মধ্যে দুটি স্রোতোধারা। একটির কেন্দ্রে ছাত্রলীগের সাবেক নেতা শেখ ফজলুল হক মণি, অন্যটির মধ্যমণি ছাত্রলীগের আরেক সাবেক নেতা সিরাজুল আলম খান। আমি কেমন করে জানি সিরাজুল আলম খানকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া ঘরানার মধ্যে ঢুকে গেছি। আমি জানতাম এমন একটা প্রক্রিয়ার কথা, যেখানে আমরা সরাসরি স্বাধীনতা ও সমাজতন্ত্রের কথা বলতাম। অন্য গ্রুপের বন্ধুরা আমাদের নিয়ে মশকরা করত। বলত, পাতি বিপ্লবী।
বিজ্ঞানে নিউক্লিয়াস বলতে যা বোঝায়, রাজনীতিতে তার রূপ হয়তো আলাদা। এটা এমন একটা প্রক্রিয়া, যাকে একজন বা একটি ছোট গ্রুপ সঞ্চালন করে, নিয়ন্ত্রণ করে। তখন থেকেই জানি, শেখ মুজিব হলেন আসল নেতা। তাঁর সবচেয়ে আস্থাভাজন শিষ্য হলেন সিরাজুল আলম খান। আমরা শেখ মুজিবকে বলি বঙ্গবন্ধু আর সিরাজুল আলম খানকে বলি সিরাজ ভাই। স্বাধীনতার পর তিনি কলকাতা থেকে ফিরে এলেন। তখন লক্ষ করলাম, অনেকেই তাঁকে ‘দাদা’ বলতে শুরু করেছে। ‘দাদা’ শব্দটির ব্যাপারে আমার অ্যালার্জি ছিল। উগান্ডার স্বৈরশাসক ইদি আমিনকে দাদা নামে সম্বোধন করা হতো।
আমার ধারণা ছিল, শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য গোপনে কাজ করে যাচ্ছেন। তবে তিনি নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি করেন, অন্তত প্রকাশ্যে। কিন্তু সিরাজুল আলম খানকে দিয়ে তিনি অনেক কাজ করান। সিরাজ হলেন শেখ মুজিবের ডান হাত। কিন্তু যখন শুনলাম, শেখ মুজিব পল্টনের সম্মেলনে অতিথি হিসেবে না এসে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে চলে গেছেন, তখন বিষম ধাক্কা খেলাম মনে। এটা কী হলো? এমনটা হবে তা তো আগে কেউ বলেনি?
দিন যায়, মাস যায়, বছর গড়ায়। ছাত্রলীগের এই সিরাজপন্থী গ্রুপ থেকে তৈরি হলো জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল। সংক্ষেপে জাসদ। জাতীয় সমাজতন্ত্র তো হিটলারের আদর্শ ছিল। এই নামের ভূত আমাদের ঘাড়ে চাপল কেন? এর কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পেলাম না। আসলে তখন যাঁরা এসবের পরিকল্পনা করতেন বা সিদ্ধান্ত নিতেন, তাঁরা হয়তো বিষয়টি খতিয়ে দেখেননি। হয়তো তাঁরা দুনিয়ার খবর রাখেন না। কিন্তু নিউক্লিয়াস শব্দটি চাউর হতে থাকল। জানতে পারলাম, এটি ছিল তিনজনের একটি চক্র বা সেল। সিরাজুল আলম খান ছাড়াও আরও ছিলেন ছাত্রলীগের সাবেক নেতা আবদুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমদ। বাহাত্তর সালেই এই নিউক্লিয়াস ভেঙে যায়। আবদুর রাজ্জাক থেকে যান আওয়ামী লীগে। কাজী আরেফের সঙ্গে সিরাজুল আলম খানের রাজনৈতিক বিচ্ছেদ ঘটে ১৯৮৪ সালের দিকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ছাত্রত্ব শেষ হলো ১৯৭৫ সালে এমএ পরীক্ষা দেওয়ার মধ্য দিয়ে। তার বছরখানেকের মধ্যেই আমি রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিই। আমি বুঝলাম, এটা আমার পথ নয়। কিন্তু রাজনীতির প্রতি আগ্রহ রয়েই গেল। সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৭০ সালের শুরুর দিকে। তাঁকে আমি অনেকবার বলেছি, ‘আপনার কাজ, আপনার অভিজ্ঞতার কথা লিখুন। সবাই জানুক।’ তিনি বলেছিলেন, ‘আমি তো লিখতে পারি না।’ আসলেও তা-ই। তিনি বলেন, অন্যেরা লেখে। অথবা অন্যেরা লেখে, তিনি দেখে দেন কখনো-সখনো।
১৯৬৭-৬৯ সালে আমি ঢাকা কলেজে পড়েছি। আমার ক্লাসের বন্ধুদের মধ্যে যারা বেশি রকম রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিল, তারা হলো শেখ কামালউদ্দিন, রেজাউল হক মুশতাক ও নিজামুদ্দিন আজাদ। মুশতাক ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগ শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিল। আজাদ ছিল কলেজ শাখা ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক। কামাল ছাত্রলীগের হলেও সে কোনো পদে ছিল না। শেখ মুজিবের ছেলে হিসেবে তার অন্য রকম একটি পরিচিতি দাঁড়িয়ে যায়। ওই সময় শেখ মুজিব কারাবন্দী থাকায় কামালের ওপর আমাদের সবার মমতা ছিল।
আজাদের সঙ্গে সখ্যের কারণে আমি ছাত্র ইউনিয়নে ভিড়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু উনসত্তরের গণ-আন্দোলন আমাকে অনেক বদলে দিয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত হই। অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে পড়ার সময় মুহসীন হল ছাত্র সংসদের সহসাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হই ১৯৭০ সালে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আজাদ শহীদ হয়। পঁচাত্তরের নির্মম হত্যাকাণ্ডে পরিবারের অন্যদের সঙ্গে কামালকেও আমরা হারাই। মুশতাক তত দিনে রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি আর যুক্ত ছিল না। তার সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল বরাবর।
১৯৮৩ সালে আমি জাসদকে নিয়ে একটি গবেষণার কাজ শুরু করি। অক্টোবরের এক সকালে মুশতাককে সঙ্গে নিয়ে আবদুর রাজ্জাকের ধানমন্ডির বাসায় যাই। তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের একজন বড় নেতা, সাধারণ সম্পাদক। শেখ হাসিনা দলের সভাপতি। তাঁদের মধ্যকার রসায়নটি কাজ করেনি। তিনি আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত হলেন। আরেক বহিষ্কৃত নেতা মহিউদ্দিন আহমেদকে নিয়ে তিনি তৈরি করলেন বাকশাল নামে আরেকটি দল। রাজ্জাক সাহেবের বাসায় লোকজনের ভিড়। একজনের পর একজন আসছেন আর যাচ্ছেন। জননেতাদের বোধ হয় এমনই জীবন। আমি দেখলাম, যে উদ্দেশ্যে আসা, অর্থাৎ তাঁর একটি সাক্ষাৎকার নেব, সেটি এই হট্টগোলের মধ্যে সম্ভব নয়। মুশতাক আর আমি তাঁকে নিয়ে চলে এলাম মুশতাকের ভূতের গলির বাসায়। সেখানে তাঁর সঙ্গে কথা হলো প্রায় চার-পাঁচ ঘণ্টা। তিনি মেলে ধরলেন নিউক্লিয়াস-বৃত্তান্ত। তাঁর ভাষ্য ছিল এ রকম:
এটা ঠিক যে আমরা নিউক্লিয়াস তৈরি করেছিলাম। চিন্তাটা হয়েছিল ১৯৬২ সালে। ১৯৬৪ সালে তার একটা কাঠামো দাঁড় করানো হয়। সিরাজ ভাই রূপকার, বিষয়টা এমন নয়। আমাদের মধ্যে কাজ ভাগ করা ছিল। সিরাজ ভাই ছিলেন আমাদের থিওরেটিশিয়ান। আমি রিক্রুটিংয়ের কাজ দেখতাম। আরেফ ছাত্রলীগের মধ্যে আমাদের চিন্তার প্রসার ঘটাত। এরপর চতুর্থ ব্যক্তি হিসেবে আমাদের সঙ্গে যোগ দেয় আবুল কালাম আজাদ। আমরা আঙুল কেটে রক্ত দিয়ে শপথ নিই, দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত আমরা ব্যক্তিগত সুখ-সুবিধার পেছনে ছুটব না। বিয়ে করব না। আমাদের না জানিয়ে আবুল কালাম আজাদ স্কুলপড়ুয়া একটা নাবালিকাকে বিয়ে করলে আমরা তাকে বহিষ্কার করি। মুজিব ভাইকে সামনে রেখেই আমরা এটা শুরু করি। তিনিই আমাদের নেতা। এ ব্যাপারে তাঁকে আমরা কিছুটা জানিয়েছিলাম ১৯৬৬ সালে। ১৯৬৯ সালে তাঁকে ডিটেইল জানানো হয়।
আমাদের সেলটির নাম দেওয়া হয় ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’। নামটি গোপন ছিল। কাজকর্ম হতো খুবই গোপনে।
আমরা বিপ্লবী বাংলা নামে হাতে লেখা একটা বুলেটিন বের করি। সাইক্লোস্টাইল করে এর কপি করা হতো। দুটো সংখ্যা বেরিয়েছিল।
সিরাজ ভাইকে আমরা নেতা মানতাম। তবে তাঁর পারসোনাল লাইফের অ্যানার্কি আমরা পছন্দ করতাম না।
সিরাজুল আলম খান ছিলেন অন্তর্মুখী। সাধারণ মানুষকে একটা ধারণা দেওয়া হতো, তিনি প্রচারবিমুখ। এখন অবস্থা পাল্টেছে। অনেক বছর ধরেই তিনি তাঁর নিউক্লিয়াস-তত্ত্ব প্রচার করছেন, নিজে লিখছেন না। তবে ডিকটেশন দিয়ে অন্যদের দিয়ে লেখাচ্ছেন। ইতিমধ্যে এ বিষয়ে তাঁর উদ্যোগে ও প্রশ্রয়ে ছাপা হয়েছে অগুনতি বই, বেশির ভাগই আধা ফর্মা বা এক ফর্মার, সেখানে তুলে ধরা হচ্ছে ‘নিউক্লিয়াসের’ বিবরণ। এসব পুস্তিকায় তাঁর বয়ানটি পড়ে মনে হয়, এটা শুধু একটা প্রক্রিয়া ছিল না, এটা বাস্তবিক অর্থেই ছিল একটি সংগঠন, গোপন রাজনৈতিক দলের ভ্রূণ। এই দলে অনেকেই সংশ্লিষ্ট হয়েছেন। তিনি দাবি করছেন, সাবেক রাষ্ট্রদূত—লেখক কামরুদ্দীন আহমদ এবং অধ্যাপক আহমদ শরীফ নিউক্লিয়াসের পরামর্শদাতা ছিলেন। ঢাকা ছাড়িয়ে তাঁদের এই নেটওয়ার্ক জেলা পর্যায়ে বিস্তৃত হয়েছিল।
আহমদ শরীফের নানান লেখা ও চিঠিতে শেখ ফজলুল হক মণি, আবদুল আজিজ বাগমার, আল মুজাহিদী প্রমুখ ছাত্রলীগ নেতার উল্লেখ থাকলেও সিরাজুল আলম খানের প্রসঙ্গ নেই। বরং আহমদ শরীফের লেখা থেকে জানা যায়, ঢাকা জেলা ছাত্রলীগের একসময়ের সভাপতি আবদুল আজিজ বাগমার স্বাধীন বাংলাদেশের কথা ভাবতেন। জানা যায়, ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৫ সালের মধ্যে বাগমার স্বাধীনতার তিনটি ইশতেহার প্রকাশ করেছিলেন। তৈরি করেছিলেন ‘অস্থায়ী পূর্ববঙ্গ সরকার’। সংক্ষেপে ‘অপূর্ব সংসদ’।
প্রথম ইশতেহারটি লিখে দিয়েছিলেন অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী। দ্বিতীয়টি বাগমারের নিজের লেখা, সম্পাদনা করে দিয়েছিলেন মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী ও আহমদ শরীফ। তৃতীয়টি আহমদ শরীফের লেখা ‘ইতিহাসের ধারায় বাঙালি’। সেখানে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটির উল্লেখ আছে। বাগমারের ব্যাপারে আহমদ শরীফের স্নেহ ও উৎসাহের সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো বিশ শতকে বাঙালী বইটি বাগমারের নামে উৎসর্গ করা। উৎসর্গলিপিতে তিনি লেখেন, ‘স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রয়াসে পথিকৃৎ আবদুল আজিজ বাগমার প্রিয়বরেষু।’ বাগমারের নেতা ছিলেন শেখ মুজিব। ছয় দফার মধ্যে বাগমার তাঁর লক্ষ্য অর্জনের দিশা পেয়ে যান। প্রক্রিয়াটি এখানেই শেষ।
আমি শুনছিলাম, ছাত্ররাজনীতিতে সিরাজুল আলম খানের উত্থান ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও পরে সভাপতি শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের হাত ধরে। পঞ্চাশের দশকের শেষে ষাটের দশকের শুরুতে আওয়ামী বৃত্তের তরুণদের মধ্যে শেখ মুজিবের পরেই জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন ছিলেন তুঙ্গে। ২০১৪ সালে আমি আওয়ামী লীগ নিয়ে একটি গবেষণামূলক কাজে হাত দিই। তো ওই সময়ের ইতিহাসের সন্ধানে ২০১৫ সালের ৯ অক্টোবর আমি একদিন হাজির হই তাঁর গুলশানের ডেরায়। যথারীতি আমার সঙ্গী রেজাউল হক মুশতাক। আমাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে শাহ মোয়াজ্জেম ইতিহাসের এক অধ্যায় তুলে ধরেন, যা এত দিন আমার জানা ছিল না।
পূর্ব বাংলা স্বাধীন করার ব্যাপারে শেখ মুজিবুর রহমান যে কত বেপরোয়া ছিলেন, তার আভাস পাওয়া যায় শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের ভাষ্যে। দিন-তারিখ মনে নেই শাহ মোয়াজ্জেমের। এতটুকু স্মরণ আছে যে তখন আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারি ছিল। আমার সঙ্গে তাঁর কথোপকথন ছিল এ রকম:
মহিউদ্দিন আহমদ: আমরা শুনেছি ওই সময় দেশ স্বাধীন করার জন্য কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এ সম্পর্কে আপনি যতটুকু জানেন, বলবেন কি?
শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন: মুজিব ভাই একটা লিফলেট ড্রাফট করেছেন ‘পূর্ববঙ্গ মুক্তি ফ্রন্ট’ নাম দিয়ে। সাইকেল চালিয়ে নিজেই প্রেসে গিয়ে ছেপেছেন। উনি আমাকে একটা সাইকেল প্রেজেন্ট করেছিলেন। আমাকে ডাকলেন। আমি ওই সাইকেল চালিয়েই গেলাম। উনি আমার হাতে এক বান্ডিল লিফলেট দিয়ে বললেন, ‘তোর বিশ্বস্ত লোক নিয়া এগুলি ডিস্ট্রিবিউট করবি।’ লিফলেটটি লেখা হয়েছিল ইংরেজিতে। আমি এটা দেখালাম রফিকুল্লাহ চৌধুরীকে। উনি একসময় ছাত্রলীগে আমার প্রেসিডেন্ট ছিলেন, আমি তখন ছাত্রলীগের জেনারেল সেক্রেটারি। উনি লিফলেটটা দেখলেন। বললেন, ‘বানান ভুল আছে, টেনস কয়েক জায়গায় ভুল। বাট ইট ক্যারিজ দ্য মিনিং।’
আমি পাঁচজনের একটা টিম করলাম। কে এম ওবায়দুর রহমান, সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক মণি, ফরিদপুরের আনিস আর আমি নিজে। রাত ১২টার পর বের হতাম। ধরা পড়লে স্ট্রেট ফাঁসি। কিন্তু নেতার নির্দেশে আমরা এটা করেছি। চাদর গায়ে দিয়ে সাইকেল চালিয়ে বিভিন্ন এমবাসির গেটের সামনে ফেলে দিয়ে চলে আসতাম।
এখন অনেকেই স্বাধীনতার কথা নানাভাবে মনের মাধুরী মিশিয়ে বলে। বাট দিস ইজ দ্য ফ্যাক্ট। বাংলাদেশপন্থী কেউ ছিল না, আমরাই ছিলাম। শেখ সাহেবের অনুসারীরাই ছিলাম। কমিউনিস্টরা আমাদের বলত ইললিটারেট গ্র্যাজুয়েটের শিষ্য।
মহি: সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে আপনার পরিচয়-ঘনিষ্ঠতা হলো কীভাবে?
মোয়াজ্জেম: একদিন খবর পেলাম ফজলুল হক হলে নতুন একটা ছেলে এসেছে। সারা দিন তাস খেলে। তার পার্টনার বদল হয়। কিন্তু তার বদল হয় না। কী ব্যাপার? আমার কৌতূহল হলো। তাকে ডেকে পাঠালাম এবং মুহূর্তেই তাকে পছন্দ করে ফেললাম। তাকে রিক্রুট করলাম। এভাবেই সিরাজুল আলম খান আমার সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ হলো। ও ছিল খুব ভালো, হার্ডওয়ার্কিং। দিন-রাত কাজ করত।
মহি: উনি তো বলছেন, উনি ছাত্রলীগের মধ্যে স্বাধীনতার নিউক্লিয়াস তৈরি করেছেন ১৯৬২ সালে। তো আপনারা শেখ মুজিবের দেওয়া স্বাধীনতার লিফলেট একসঙ্গে বিলি করলেন। এদিকে উনি বলছেন, উনি এটা শুরু করেছেন। উনি তো আপনার কথা বলেন না। এটা কি ওনার মনের সংকীর্ণতা?
মোয়াজ্জেম: তা বলতে পারব না। হয়তো তার মেমোরিতে এটা নেই। মনের সংকীর্ণতাও হতে পারে। তবে ও আমার খুব আস্থাভাজন ছিল। অমানুষিক পরিশ্রম করতে পারত। আমিই তো ওকে ছাত্রলীগের সেক্রেটারি বানিয়েছিলাম।
শাহ মোয়াজ্জেমের কথায় বোঝা যায়, পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা নিয়ে শেখ মুজিবের নিজস্ব চিন্তাভাবনা ও পরিকল্পনা ছিল। এ জন্য তিনি ভারতের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চালান। এর একটি বিস্ময়কর বিবরণ পাওয়া যায় ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের তৎকালীন উপহাইকমিশনের পলিটিক্যাল অফিসার শশাঙ্ক শেখর ব্যানার্জির কাছ থেকে। ব্যানার্জি পুরান ঢাকায় চক্রবর্তী ভিলায় থাকতেন। পাশের বাড়িতেই ছিল ইত্তেফাক অফিস। ১৯৬২ সালের ২৪ মার্চ মাঝরাতে ইত্তেফাক সম্পাদক মানিক মিয়া একটি ছেলেকে পাঠিয়ে ব্যানার্জিকে ইত্তেফাক অফিসে ডেকে আনেন। মানিক মিয়ার সঙ্গে ছিলেন শেখ মুজিব। প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে তাঁরা কথা বলেন। ব্যানার্জি দেখলেন, একপর্যায়ে শেখ মুজিব ও মানিক মিয়ার কথাবার্তার ধরন বদলে গেল। তাঁরা কিছু একটা বলতে বা দেখাতে চাইছেন। ব্যানার্জি জানতে চান তাঁরা উঁচুপর্যায়ের কোনো কর্তৃপক্ষের কাছে কোনো বার্তা পৌঁছাতে চাচ্ছেন কি না। মুজিব মুখ খুললেন। বললেন, এই বৈঠক ডাকার উদ্দেশ্য হলো, তাঁরা ব্যানার্জির মাধ্যমে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটা গোপনীয় চিঠি পাঠাতে চান। মুজিব চিঠিটা ব্যানার্জির হাতে দিলেন। তাঁর মধ্যে তাড়াহুড়ো ছিল। চিঠিটা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহরুকে ব্যক্তিগতভাবে সম্বোধন করে লেখা। ভূমিকার পর সরাসরি একটা কর্মপরিকল্পনার কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। মুজিব বললেন, তিনি বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম পরিচালনা করবেন। মানিক মিয়া ইত্তেফাক-এ লেখনীর মাধ্যমে প্রচারকাজ চালাবেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৯৬৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ১ মার্চের মধ্যে মুজিব লন্ডনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে প্রবাসী সরকার গঠন করবেন। চিঠির শেষ প্যারাগ্রাফে নৈতিক, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সমর্থন ও সাজসরঞ্জাম চেয়ে নেহরুকে অনুরোধ জানানো হয় এবং এ বিষয়ে কথা বলার জন্য মুজিব গোপনে নেহরুর সঙ্গে দেখা করতে চান।*
চিঠি পাঠানো হলো। ভারত তখন চীনের সঙ্গে যুদ্ধে বিপর্যস্ত। দিল্লি থেকে খবর এল, মুজিবকে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে। মুজিব ভাবলেন, ঢাকায় ভারতীয় উপহাইকমিশনের আমলাদের কারণেই দেরি হচ্ছে। ধৈর্য হারিয়ে তিনি কৌশল পাল্টালেন। গোপনে সীমান্ত পেরিয়ে আগরতলায় গেলেন। ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্রলাল সিংহের সঙ্গে তাঁর বৈঠক হয়। আগরতলায় মুজিবকে রেখে শচীন সিং দিল্লি যান এবং নেহরুর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করেন। চীনের সঙ্গে যুদ্ধের পর নেহরু আরেকটি ফ্রন্ট খুলতে চাননি। শচীন সিং আগরতলা ফিরে এসে মুজিবকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তাঁকে সাহায্য দেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়েছে এবং তা ভারতের ঢাকা উপহাইকমিশনকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। নেহরুর পরামর্শ ছিল, এরপর থেকে মুজিব যেন ঢাকায় ভারতীয় দূতাবাসের মাধ্যমেই যোগাযোগ করেন, আগরতলার মাধ্যমে নয়।**
শচীন সিংহের ভাষ্যে এবং অন্যান্য সূত্রে জানা যায়, শেখ মুজিব আগরতলা গিয়েছিলেন ১৯৬৩ সালের জানুয়ারির শেষ দিকে। তিনি সেখানে ছিলেন ১৫ দিন। তাঁর আগরতলা মিশন সম্বন্ধে দলের সহকর্মীরা এবং সরকারের গোয়েন্দারা ছিলেন সম্পূর্ণ অন্ধকারে।
১৯৯১ সালে মফিদুল হক দিল্লিতে শচীন সিংহের সঙ্গে দেখা করলে তিনি ঘটনাটি নিজের হাতে লিখে দিয়েছিলেন। সেই ভাষ্য ফয়েজ আহমদ উল্লেখ করেছেন তাঁর আগরতলা মামলা, শেখ মুজিব ও বাংলার বিদ্রোহ বইয়ে।
এ তো গেল শেখ মুজিবের উদ্যোগের কথা। এর মধ্যে সিরাজুল আলম খানের নিউক্লিয়াস-তত্ত্ব কতটুকু প্রাসঙ্গিক বা গুরুত্বপূর্ণ? সম্প্রতি তাঁর অনুসারীরা, বিশেষ করে তাঁর অত্যন্ত কাছের মানুষ হিসেবে পরিচিত আ স ম আবদুর রব দাবি করেছেন, সিরাজুল আলম খানই সবার আগে স্বাধীনতার কথা বলেছেন। তিনিই স্বাধীনতার রূপকার। বিষয়টি ভেবে দেখার মতো।
নিউক্লিয়াস কিংবা স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের কার্যক্রমের কোনো দালিলিক সূত্র পাওয়া যায় না। যাঁরা ‘বিপ্লবী বাংলা’ নামের মুখপত্রটির কথা বলেন, তাঁরা কেউ আজ পর্যন্ত এর কোনো কপি দেখাতে পারেননি। গোপনীয়তার স্বার্থে এগুলো সংরক্ষণ করা বিপজ্জনক, এটা মেনে নিয়েও বলা যায়, এর কনটেন্ট কী ছিল, তা-ও জানা যায়নি। তবে নিউক্লিয়াসের তৈরি হাতে লেখা এবং সাইক্লোস্টাইল কপি করা একটা প্রচারপত্র আমি দেখেছি। এটা আমাদের দেওয়া হয়েছিল ১৯৭০ সালের অক্টোবরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন রোজার ছুটি চলছে। ডাকসুর সহসভাপতির কামরায় কাজী আরেফ আহমদ আমাকে এবং আরও অনেককে এটি দিয়ে বলেছিলেন, আসন্ন সাধারণ নির্বাচন লক্ষ্য করে প্রতিটি কনস্টিটিউন্সিতে গিয়ে এটার ভিত্তিতে আলাপ করতে হবে এবং একই সঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পক্ষে প্রচার চালাতে হবে। প্রচারপত্রের শিরোনাম ছিল ‘জয় বাংলা’। প্রচারপত্রে বলা হয়, গ্রামে গ্রামে সংগঠন করতে হবে। সংখ্যাগরিষ্ঠতা সত্ত্বেও শাসকগোষ্ঠী যদি ৬ দফা ও ১১ দফাভিত্তিক সংবিধান তৈরি করতে না দেয়, তাহলে ‘বাঙালির মুক্তিসংগ্রামই হবে একমাত্র খোলা পথ’। জাতীয় নেতার (মুজিব) প্রতি শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস এবং আদর্শের প্রতি অবিচল নিষ্ঠা রেখে প্রত্যেক কর্মীকে ‘মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হবে।
এ ধরনের চিন্তা তো আসমান থেকে হঠাৎ করে পড়েনি। এ নিয়ে নিশ্চয়ই অনেক দিন ধরে আলোচনা হচ্ছে, কাজ হচ্ছে। আমি এর গোড়ায় যেতে চাইলাম। সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে সখ্য থাকা সত্ত্বেও তিনি বিষয়টি বারবার এড়িয়ে গেছেন। মুখ খুলতে চাননি। আবার যাদের ডিকটেশন দিয়ে তিনি লেখান, সেগুলো বেশির ভাগই অগোছালো। আমি লেগে থাকলাম।
রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে আমি গবেষণার কাজ করছি ২০১৩ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে। তখন থেকে মাঝেমধ্যে সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে দেখা ও কথা হতো। প্রশ্ন করলে তিনি সরাসরি জবাব দেন না। এ ধরনের আচরণ বা স্টাইলের কারণে ‘রাজনীতির রহস্যপুরুষ’ হিসেবে তাঁর একটি পরিচিতি দাঁড়িয়ে গেছে। তাঁর একটাই কথা, ‘আমি বলতে যাব কেন? তোমরা খুঁজে বের করো।’ এটা রাগের কিংবা ক্ষোভের প্রকাশ হতে পারে। ইদানীং তিনি একটু একটু করে মুখ খুলছেন। আমি আমার বিভিন্ন লেখায় তা উদ্ধৃত করে আসছি।
২০১৪-১৮ সালে আমি তাঁর সঙ্গে বেশ কিছুটা সময় কাটাই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলি। কথাগুলো রেকর্ড করি। তাঁর সঙ্গে আমার কথাবার্তার কিছু অংশ এখানে তুলে ধরলাম:
মহিউদ্দিন আহমদ: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন কোন বছর?
সিরাজুল আলম খান: ১৯৫৮ সালে। ম্যাথমেটিকসে। ফজলুল হক হলে রেসিডেন্ট হলাম। যে রুমে গেলাম, সেটা ছিল ছাত্রলীগের জেনারেল সেক্রেটারির রুম। সারা ইস্ট পাকিস্তানের জেনারেল সেক্রেটারি। রফিকুল্লাহ চৌধুরী হলেন প্রেসিডেন্ট, আজহার আলী জেনারেল সেক্রেটারি। সেই রুমে আমি উঠেছি। বুঝতেই পারো। একজন জেনারেল সেক্রেটারির রুমে—একটা অভাগা ঢুকলেও তো অনেক দিক দিয়ে একটা...
মহি: ভিআইপি!
সিরাজুল আলম খান: হ্যাঁ। রফিকুল্লাহ চৌধুরী আসতেন। আজহার ভাই তো ছিলেনই। উনি পরে ব্যারিস্টারি পড়তে গেছেন। পরে আবার বাংলাদেশবিরোধী হয়ে গিয়েছিলেন। হি ডাইড অ্যাজ আ পাকিস্তানি। বছর পাঁচ-ছয় আগে লন্ডনে মারা গেছেন।
ছাত্রলীগের অফিস সেক্রেটারি ছিলেন সৈয়দ রেজা কাদের। উনিও ওই রুমে।
মহি: এটা কি থ্রি-সিটেড রুম?
সিরাজ: থ্রি-সিটেড রুম। পরে হয়ে গেছে ফোর-সিটেড।
মহি: রুম নম্বর মনে আছে?
সিরাজ: টি ই ফোর। টপ ইস্ট ফোর। পরে আবার টি বাদ দিয়ে দিয়েছে। শুধু ইস্ট ফোর। এক নম্বরে থাকতেন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। তত দিনে বেরিয়ে গেছেন। তখন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী সম্পর্কে ছাত্রদের ধারণা ভালো ছিল। তখনো তিনি পেপারে লিখতেন। চাকরি করতেন। তখন তো ইউনিভার্সিটিতে সবাই ভালো ছাত্র। সৈয়দ রেজা কাদের ভাই তো পলিটিক্যাল সায়েন্সে ছিলেন।
যেকোনো কারণে উইদিন শর্ট পিরিয়ড আমি পরিচিত হয়ে গিয়েছিলাম। টেবিল টেনিস, ক্যারম, ভলিবল খেলতাম। জিমনেসিয়ামে যেতাম। ডিবেটে অংশগ্রহণ করতাম। গানবাজনার আসরে যেতাম। আবার এই হলে ওই হলে ঝগড়া—খেলার সময় এগুলোও করতাম। ছাত্রলীগের সেন্ট্রাল নেতাদের রুম হওয়াতে যারা ছাত্রলীগ করে-টরে...তখনো কিন্তু মার্শাল ল হয়নি। হয়ে যাবে কয়েক দিন পরে। সবার আসা-যাওয়ার ফলে, সিনিয়র-জুনিয়র সবাই, সবার সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেল এবং ভালো ছেলে হিসেবে পরিচিতি হলো।
তখন তো রাজনীতি বন্ধ। ছাত্রসংগঠনগুলো সব বন্ধ। আজহার ভাই চলে গেলেন। রফিকুল্লাহ ভাই প্রেসিডেন্ট। মোয়াজ্জেম ভাই সেক্রেটারি হবেন। পুরোনো আর্টস বিল্ডিংয়ে ইফতার পার্টি করে ৬০-৭০ জন জোগাড় করে, গোপনে সন্ধ্যার পরে আমাদের একটা কমিটি করা হলো। দুই বছরের জন্য। পরের বছর রেজা কাদের ভাই আমার নাম এক্সিকিউটিভ কমিটিতে দিয়ে দিলেন। কমিটির মেম্বার হিসেবে দিলেন। পরের বছর রফিক ভাই চলে গেলেন।
মহি: তাহলে ’৫৯ সালে আপনাকে কমিটিতে নেওয়া হলো।
সিরাজ: ’৬০ সালের শুরুর দিকে। ওই রোজার টাইমে। পরের বছর মোয়াজ্জেম ভাই হলেন প্রেসিডেন্ট, শেখ মণি সেক্রেটারি। আমি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি। অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি হওয়ারও একটা গল্প আছে। যে ছেলেটা অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ছিল, নাজমুল হক, সে আবার রেডিও পাকিস্তানে চাকরি পেয়ে গেছে। সরকারি চাকরি হওয়াতে সে তো আর সংগঠন করবে না। রিজাইন দিয়েছে। আমাকে এক্সিকিউটিভ মেম্বার থেকে অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি বানিয়েছে।
মহি: তাহলে ’৬০ সালের কমিটিতে আপনি এক্সিকিউটিভ মেম্বার। সেখান থেকে অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি।
সিরাজ: প্রথমবার মেম্বার। তারপর নাজমুল হক চলে যাওয়াতে অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি।
মহি: ভারপ্রাপ্ত।
সিরাজ: হ্যাঁ। তার পরেরবার সরাসরি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি।
মাঝেমধ্যে রুমের মধ্যে দেখি যে সৈয়দ রেজা কাদের ভাইয়ের কাছে লোকজন আসে, কথাবার্তা বলে। সবাই ছাত্রলীগের। আমাকে বলে, থাকো তুমি। অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি হওয়ার পরে, মণির গলা থেকে হঠাৎ করে রক্ত বের হলো। ডাক্তার টিবি সাসপেক্ট করে বললেন, ‘তুমি কমপ্লিট রেস্টে যাও।’ তখন আমি অ্যাক্টিং জেনারেল সেক্রেটারি হলাম। অ্যাক্টিং জেনারেল সেক্রেটারি হওয়ার ফলে সারা ইস্ট পাকিস্তানে চিঠি লিখে লিখে যোগাযোগ হতো। রেজা কাদের ভাই আছেন তখনো।
মহি: উনি তখন কী?
সিরাজ: উনি আউটগোয়িং। কিন্তু তখনো হলে থাকেন। আমি সব ধরনের খেলাধুলার সঙ্গে জড়িত থাকতাম।
মহি: তাস খেলতেন?
সিরাজ: ব্রিজ খেলতাম।
মহি: মোয়াজ্জেম ভাই আপনার সম্পর্কে আমাকে একটা ইনফরমেশন দিয়েছেন।
সিরাজ: কী? ব্রিজ খেলতাম?
মহি: মোয়াজ্জেম ভাইয়ের সঙ্গে আপনার পরিচয় কি ফজলুল হক হলে গিয়ে? উনি আমাকে বলেছেন, একটা খবর পেলাম, একটা ছেলে আসছে। তার রুমে সারা দিন তাস খেলা হয়। তার পার্টনার বদল হয়। সে বদল হয় না। আপনি সারা দিন তাস খেলতেন—এ কথাটা কি ঠিক?
সিরাজ: আমাকে খুব তাড়াতাড়ি যে কেউ পিনপয়েন্ট করে ফেলতে পারত। আছে না অনেকে, চোখে পড়ার মতো?
মহি: আপনি কি কলেজে থাকতে ছাত্রলীগের সঙ্গে ছিলেন?
সিরাজ: তখন ঢাকা কলেজে ছাত্রলীগ-ছাত্র ইউনিয়ন ছিল না। পাইওনিয়ার্স পার্টি আর ডেমোক্রেটিক পার্টি। আমরা ছিলাম পাইওনিয়ার্স পার্টিতে। এখানেও ছাত্রলীগাররা ছিল, আবার ডেমোক্রেটিক পার্টিতেও ছাত্রলীগাররা ছিল। আবার এই দুটোতেই ছাত্র ইউনিয়ন ছিল। শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন ডেমোক্রেটিক পার্টিতে ছিলেন। তখন যোগাযোগ ও দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে। কিন্তু কোনো রিলেশন গড়ে ওঠেনি।
মহি: ঢাকা কলেজে আপনার সঙ্গে তো সাক্ষাৎ হওয়ার কথা না। উনি তো আউটগোয়িং আর আপনি ঢুকলেন। দুই বছরের ডিফারেন্স তো?
সিরাজ: দুই বছরের।
মহি: তাহলে ঢাকা কলেজে আপনার সঙ্গে তো তার দেখা হয়নি?
সিরাজ: না, উনি তো পাস কোর্সে পড়েছেন, বিএ পাস করেছেন।
মহি: ও আচ্ছা। তাহলে উনি ঢাকা কলেজ থেকে বিএ পাস করে ফজলুল হক হলে গেছেন?
সিরাজ: হ্যাঁ। অ্যাটাচড ছাত্র ছিলেন।
মহি: হলের রেসিডেন্ট ছিলেন না?
সিরাজ: না। উনি বিএ পাস করে ল পড়েছেন। এমএ পড়লেও পরে পড়েছেন।
মহি: আমাকে উনি বলেছেন, উনি এমএ পড়েছেন হিস্ট্রিতে। তাহলে পরে পড়েছেন হয়তো।
সিরাজ: আগে উনি ল পাস করেছেন। ক্লাস এইট-নাইন থেকেই উনি পলিটিক্যাল। জেলেও গেছেন ক্লাস নাইনে থাকতে।
মহি: ভাষা আন্দোলনের সময়?
সিরাজ: ইয়াঙ্গেস্ট জেলখাটা ছাত্র।
মহি: তাহলে ঢাকা কলেজে উনি করলেন ডেমোক্রেটিক পার্টি আর আপনি করেছেন পাইওনিয়ার্স পার্টি?
সিরাজ: হ্যাঁ। আবার পাইওনিয়ার্স পার্টির লিডার হলেন এম এ আউয়াল। তিনি আবার ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট।
মহি: এম এ আউয়াল তো আরও সিনিয়র? শাহ মোয়াজ্জেমেরও সিনিয়র?
সিরাজ: হ্যাঁ। রফিকুল্লাহ চৌধুরীরও সিনিয়র।
মহি: উনি করতেন পাইওনিয়ার্স পার্টি।
সিরাজ: হ্যাঁ।
মহি: তাহলে ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, এগুলো ঢাকা কলেজে অ্যালাউড ছিল না।
সিরাজ: গভর্নমেন্ট কলেজে খুব স্ট্রিক্ট ছিল।
এর মধ্যে এসে গেল ’৬২ সালের মুভমেন্ট।
মহি: রাজ্জাক ভাইয়ের সঙ্গে আপনার পরিচয়ের ইতিহাসটা তো বলতে হবে।
সিরাজ: সে তো আমার এক বছর-দুই বছরের জুনিয়র। একই হলে আসল। ফজলুল হক হলে ভর্তি হলো। সে ছিল আবার কুস্তিগির, জিমনেসিয়ামে যেত। আমিও জিমনেসিয়ামে যেতাম। সেখানে দেখা।
মহি: হলের জিমনেসিয়াম?
সিরাজ: হ্যাঁ, হলের। ইলেকশন উপলক্ষে যে অ্যাসোসিয়েশনগুলো গড়ে ওঠে, ঢাকা কলেজের কারণে... সে তো প্রথমে হলের এজিএস হয়েছিল। ফজলুল হক হলের এজিএস। তারপর তো শুরু হয়ে গেল কথাবার্তা, আলোচনা।
মহি: রাজ্জাক ভাইয়ের কোন দিকটা আপনাকে আকর্ষণ করেছে? আরও তো অনেকে ছিল?
সিরাজ: হি কুড অর্গানাইজ। খুব সহজে মিশতে পারে। অর্গানাইজ করার সেন্সে আমার চেয়েও হি ওয়াজ বেটার ইন সাম রেসপেক্ট। চিন্তার জগৎটাতে আমি তাকে হেল্প করতাম।
মহি: কোন ডিপার্টমেন্টে পড়তেন তিনি?
সিরাজ: পলিটিক্যাল সায়েন্স।
মহি: তখন ছাত্র ইউনিয়নের নেতা কারা? ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে?
সিরাজ: নেতা অরিজিনালি হলো ফরহাদ ভাই। পরবর্তীকালে এসেছে কাজী জাফর।
সারা বছরই কিন্তু...শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট আসল। হামুদুর রহমান কমিশন, শরিফ কমিশন ইত্যাদি।
মহি: তখন শরিফ কমিশন। একটা কথা বলি, শরিফ কমিশনের রিপোর্ট আপনারা কেউ পড়েছেন?
সিরাজ: পড়েছি মানে, আউটলাইনগুলো জানি।
মহি: ওটাতে এমন কিছু ছিল না। যা ছিল, তা এখন এ দেশে ইমপ্লিমেন্ট হচ্ছে। মানে আইয়ুববিরোধী একটা আন্দোলন করতে চেয়েছিলেন আপনারা?
সিরাজ: না, না, ওই যে তিন বছরের পাস কোর্স? আমরা এটার পক্ষে ছিলাম না।
মহি: কিন্তু তিন বছর হলে অনার্স আর পাস কোর্সের মধ্যে যে একটা ফারাক ছিল, ওটা বন্ধ হতো?
সিরাজ: না। পাস কোর্স দুই বছরেরই হবে। অনার্স হবে তিন বছরের। পাস কোর্স তিন বছরের হবে কেন, এই ছিল কথাটা। কিন্তু ওখানে সেমিস্টার সিস্টেমটা ছিল। এটা বাদ দিতে গিয়ে সেমিস্টার সিস্টেমও বাদ গেল। যে কারণে আমরা পিছিয়ে পড়লাম। সেমিস্টার সিস্টেমটা তো খুবই ইফেকটিভ সিস্টেম।
তো সারা বছর স্ট্রাইক হচ্ছে। আন্দোলন, মিটিং, মিছিল, এসব হচ্ছে, পুলিশের দাবড়া-দাবড়ি হচ্ছে। এর মধ্যেই পশ্চিম পাকিস্তান আমাদের ওপর অত্যাচার করছে, আমাদের শোষণ করছে, এসব ধারণা আস্তে আস্তে আসা শুরু হলো। আমি আর রাজ্জাক এগুলো আলাপ করতাম। খুবই সংক্ষেপে আর সতর্কভাবে। তখন আরেফ জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হলো, বা ইন্টারমিডিয়েট পাস করে বিএ পড়ছে। আন্দোলনে সে-ও যুক্ত ছিল। সে এতখানি চোখে পড়ার মতো না।
মহি: আরেফ ভাইয়ের সঙ্গে আপনার প্রথম যোগাযোগ হলো কীভাবে?
সিরাজ: যখন আমরা সিক্সটি টুতে...শিক্ষা আন্দোলনে। বিভিন্ন কলেজে গিয়ে আমরা যখন ছোট ছোট গ্রুপে আলোচনা করতাম, তখন দেখি যে একটা ছেলে বসে থাকে। বাট হি ইজ ভেরি অ্যাটেনটিভ অ্যান্ড হি ইজ ভেরি রেগুলার। জগন্নাথ কলেজে পড়ত।
গোপীবাগ থাকে হেঁটে এভরি ডে ইকবাল হলে আসা। আবার ফিরে যাওয়া। হি ওয়াজ অ্যান অ্যাসেট ফর বাংলাদেশ পলিটিকস। আমরা তিনজনই একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করেছি। লাইক ওয়ান সলিড রক।
ধীরস্থির ছেলেটা। আন্দোলনগুলোয় আছে। কিন্তু হইচই করার মধ্যে নাই। একটা র্যাপোর্ট। প্রথম র্যাপোর্টটা হলো—আমি আর রাজ্জাক, এরপরের র্যাপোর্টটা হলো আমি আর আরেফ। এর পরে হলো আবুল কালাম আজাদ। পরে প্রাইমারি শিক্ষকদের নেতা হয়েছিল। হতে হতে আমরা একসময় তিনজন, আবার একসময় চারজন বসা শুরু করলাম—এ আন্দোলনগুলো কীভাবে চালানো যায়। কীভাবে ইফেকটিভ করা যায়। ছাত্রলীগকে কীভাবে আরও বেশি অর্গানাইজ করা যায়। এই করার মধ্য দিয়েই স্বাধীনতার কথাটা আস্তে আস্তে আসল। বাট নট ইন আ কংক্রিট টার্ম। একটা লম্বা সময় ধরে বিষয়টা মাথায় ঘুরছে। ’৬২ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরের দিকে, রাত ১১টা-১২টা হবে, আউটার স্টেডিয়ামে কাঠের গ্যালারি ছিল, ভলিবল খেলার জায়গা, মসজিদের ওখানে। ওখানে আমরা আধা ঘণ্টা-এক ঘণ্টার জন্য মিট করতাম। তিন-চারবার মিট করে আমরা উদ্যোগী হলাম। আমাদের কী বয়স—সেটাও বুঝতাম। আরেকটা জিনিস বুঝতাম। ক্যাস্ট্রো কম বয়সে, আলজেরিয়ার বেন বেল্লা কম বয়সে, তিন-চারজন দিয়ে শুরু করেছে। এগুলির খবরাখবর আসতেছে।
’৬২-এর শেষের দিকে আমরা—এখনকার দিনে যাকে ককাস বলে—ঠিক করলাম আমরা সেন্ট্রাল সেল টাইপের কিছু একটা করব। আউটার স্টেডিয়ামে পাঁচ-সাতটা মিটিং দেওয়ার পর আমরা ইকবাল হলের মাঠে বসতাম, টেনিস গ্রাউন্ডে। বললাম, আমরা এই কাজটা শুরু করি। একটা নাম, নিউক্লিয়াস নামে একটা শুরু করা। ছোট আকারে, আমরা এই চারজন মিলে।
মহি: নিউক্লিয়াস শব্দটাই কি তখন ব্যবহার করেছিলেন?
সিরাজ: হ্যাঁ, এ শব্দটাই। হাতে হাত রেখে—বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে হবে।
মহি: চারজনে?
সিরাজ: হ্যাঁ। চারজন থেকে তিনজন এসে গেল কীভাবে, তা একটু বলে রাখি। দুই বছরের মাথায় জেলে গেলাম। আজাদও জেলে গেল। রাজ্জাকও জেলে। আরেফ কিন্তু জেলে যায় নাই। আজাদ বলল যে, সিরাজ ভাই আমি বোধ হয় এটার সাথে থাকতে পারব না। আমাকে বাদ দিয়ে আপনারা কাজ করেন। তবে এটার প্রতি আই উইল রিমেইন সিনসিয়ার। আমি খুব গরিব ঘরের ছেলে।
মহি: জেলে এই আলাপ হলো?
সিরাজ: জেলে। জেলে তো আমরা ২০-২৫ জন একসঙ্গে থাকতাম। মণি, ওবায়দুর রহমান, আমি, রাজ্জাক, আজাদ, ছাত্র ইউনিয়নের অল লিডার্স, বদরুল হক বাচ্চু—পরে জাস্টিস হয়েছিল, হায়দার আকবর খান রনো, রাশেদ খান মেনন, রেজা আলী। আজাদ বলল, আমি গরিব ঘরের ছেলে। আমার ভাইদেরকে পড়াতে হবে।
তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল চিঠির মাধ্যমে। আমি তখন অ্যাক্টিং জেনারেল সেক্রেটারি। বিভিন্ন কলেজে তো ইলেকশন হতো। যারা আসত, তাদের নামে আমি চিঠি দিতাম। যোগাযোগটা হতো। তখন সারা বাংলাদেশে জেলা এবং মহকুমায় চিঠির মাধ্যমে এদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। এখনকার জেলাগুলো সব মহকুমা ছিল তখন।
আজাদকে জোর করে ধরে রাখার তো দরকার নাই। ওটা তো হার্মফুল ফর আওয়ার কজ। আমরা আবার তিনজন। তারপর তো অ্যারেস্ট হয়ে গেলাম। অ্যারেস্ট হওয়ার আগে আমরা তিনজন বসলাম—আমি, রাজ্জাক আর আরেফ। আমরা ছাত্রলীগের মধ্যে একজন-দুজন করে খুব সতর্কভাবে কাজ করব। আমাদের ট্যাকটিসটা ছিল, ঢাকা সিটিতে মেইন কমিটি, ডিস্ট্রিক্টের মেইন কমিটির প্রেসিডেন্ট-সেক্রেটারিকে আমরা টার্গেট করব।
আমরা জেলে যাওয়ার পর, সিটিতে আরেফ এভাবে কাজ করতে থাকল। কলেজ লেভেলের কমিটিগুলোতে সে চেষ্টা করত। এবং করেছেও। দেশের অন্যান্য জায়গায় তার তো যোগাযোগ ছিল না। আমরা এগুলো দেখতাম। কিন্তু জেলে থাকার কারণে বেশি দূর এগোতে পারিনি। জেলে যাওয়ার আগে আমি জেনারেল সেক্রেটারি হলাম। সব কানেকশনগুলো সেট হয়ে গেছে। জেল থেকে বেরিয়ে কনফারেন্স করলাম। মনে আছে, কনফারেন্স হলো ৬ সেপ্টেম্বর। রাজ্জাক জেনারেল সেক্রেটারি হলো।
মহি: এটা সিক্সটি ফাইভে?
সিরাজ: হ্যাঁ। আমি তো আউটগোয়িং। সেদিন লাস্ট বক্তৃতা দিয়ে বললাম, আমি আপনাদের সাথে থাকব, তবে বক্তৃতা-বিবৃতিতে থাকব না। আমি একটা উদ্দেশ্য নিয়ে কথা বলেছি। কারোর বুঝতে পারার কথা না। না বুঝলেও সেটা আমার জানার কথা না। এই শুরু হলো।
জেল থেকে বেরিয়ে আমরা—কখনো নিউক্লিয়াস, কখনো স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ—যেভাবে নামটা সুবিধা হয়, সেভাবে আমরা বলতাম। এর একটা ডিসিপ্লিনও করলাম। ওপরের দিকে আমাকে চিনবে তুমি। কিন্তু নিচের দিকে সবাইকে চিনবে না। এটার একটা সিগন্যালিং নামও ছিল। ওপরের দিকে আর নিচের দিকে। রক্ষীবাহিনীর যে সরোয়ার মোল্লা—ও ছিল রাজ্জাকের রিক্রুট। সে কীভাবে যে নিউক্লিয়াসের হয়েছে—এইটা ‘ওদিব’—ওপরের দিকে বিপ্লবী, আর ‘নিদিব’—নিচের দিকে বিপ্লবী, এই লিংকআপটা হতো।
মহি: আমার কাছে উনি অভিযোগ করেছেন, আমার জাসদের বইয়ে বিভিন্ন জেলায় নিউক্লিয়াসের কনট্যাক্টগুলোর যে নাম দিয়েছিলাম, ফরিদপুরের ছিলেন আমির হোসেন। তখন তো গ্রেটার ফরিদপুর। উনি আমাকে বললেন, ‘আপনি কীসব নাম-টাম দিছেন? নিউক্লিয়াসের লোক তো আমি?’ তাঁকে বললাম, এটা তো আমি জানি না।
সিরাজ: সরোয়ার মোল্লা, খুব সিনসিয়ার ছিল। নিউক্লিয়াস এগোল কিন্তু খুব স্লো প্রসেসে। আমাদের দুইটা টার্গেট ছিল। একটা হলো, ছাত্রলীগকে বদনাম থেকে বাঁচানো। এটা আওয়ামী লীগের একটা স্টুজ হিসেবে পরিচিত হয়ে গিয়েছিল। কোথাও গেলে ছাত্র ইউনিয়ন-এনএসএফের ছেলেরা বলত—দেখছ দেখছ, মন্ত্রীর সাথে এম এ আউয়াল গেল, এটা তো নিকৃষ্ট কাজ। আর ভালো ছাত্ররা ছাত্রলীগ করে না, ছাত্র ইউনিয়ন করে।
ছাত্রলীগে থাকার কারণে দুইটা বদনাম ছিল না আমার। আমি তো ভালো ছাত্র হিসেবে পরিচিত ছিলাম। আর আওয়ামী লীগের সঙ্গে আমার কোনো কানেকশন নাই। আমি নিজেও তো বুঝি, সেটা নাই। মোয়াজ্জেম ভাই আমাকে প্রথম নিয়ে যায় শেখ মুজিবুর রহমান—মুজিব ভাইয়ের কাছে—উনি আলফা ইনস্যুরেন্স ইস্ট পাকিস্তানের জেনারেল ম্যানেজার। তৎকালীন জিন্নাহ অ্যাভিনিউ—এখনকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে অফিস। সামনে একটা সাদা কাগজ। সেখানে কিছু লিখলেন। মোয়াজ্জেম ভাইকে বললেন, তুই তো থাকছিস না। মণি প্রেসিডেন্ট, ওবায়দুর রহমান জেনারেল সেক্রেটারি, অর্গানাইজিং সেক্রেটারি সিরাজুল আলম খান। তারপর অন্য প্রসঙ্গে তিনি চলে গেলেন। বললেন, ভালো করে কাজ কর ইত্যাদি।
আমার কাছে কেন যেন ভালো লাগেনি। প্রথম কথা হলো, ওই যে দুই নম্বর হব না। অর্গানাইজিং সেক্রেটারি মানেই তো দুই নম্বর। এর আগে মোয়াজ্জেম তো এক নম্বর। জেনারেল সেক্রেটারিও এক নম্বর। আগেই মোয়াজ্জেম ভাইয়ের কাছ থেকে আমি জেনে নিয়েছি—ছাত্রলীগ কী। এটা কি প্রেসিডেন্ট-বেইজড অর্গানাইজেশন, নাকি জেনারেল সেক্রেটারি-বেইজড অর্গানাইজেশন। উনি বললেন, এটা জেনারেল সেক্রেটারি-বেইজড অর্গানাইজেশন। হি ইজ দ্য এক্সিকিউটিভ চিফ। প্রেসিডেন্ট তো প্রেসিডেন্টই। ওখানে কোনো কথা বলার তো দরকার নাই। আমি চলে এসেছি। বললাম, হাউ আই কেম ইন কনট্যাক্ট উইথ মুজিব ভাই।
মহি: মোয়াজ্জেম ভাই তো যাবেন ’৬৩ সালে। আপনি তো ’৬৩ সালে সেক্রেটারি হলেন।
সিরাজ: হ্যাঁ। ওখানে দেখলাম, যারা ফরিদপুর আর বরিশাল থেকে এসেছে, ওরা আমার বিরুদ্ধে। আর সবাই আমার পক্ষে, ইনক্লুডিং ঢাকা সিটি। হোল হাউস ঢাকা সিটির নেতৃত্বে আমার পক্ষে। আর অন্য পক্ষে আমি সেক্রেটারি না। ওবায়দুর রহমান প্রেসিডেন্ট। চিটাগাং থেকে সামবডি অথবা অন্য জায়গা থেকে কার কার নাম এসেছে। বাট নট মি। আমি তো সাপোর্টেড বাই শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন। কী কারণে আমাকে নিয়ে দুই পক্ষ হলো, আমি আজও বুঝি না। ইন অ্যানি ওয়ে, পরে তো আমি জেনারেল সেক্রেটারি হলাম।
মহি: ফেরদৌস কোরেশীর সঙ্গেই বোধ হয় এটা হয়েছিল?
সিরাজ: ফেরদৌস কোরেশী আর পরে শুনেছি আবদুল হাই সাচ্চু। ওই যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার। ফেরদৌস কোরেশী তো শেখ মুজিবের পক্ষে বা মণির পক্ষে না। এটা হলো চিটাগাংওয়ালাদের কাজ। ফেরদৌস কোরেশীর একটা সুনামও ছিল। তখন যে বন্যা হয়েছিল, বন্যার জন্য সারা দেশে আমরা সাহায্য নিয়ে গিয়েছিলাম। উনি চিটাগাংয়ের কো-অর্ডিনেটর ছিলেন। তাঁর নামটা সবাই জেনে গিয়েছিল। আমাকে জেনেছিল অ্যাক্টিং সেক্রেটারি হওয়ার কারণে, সবার সঙ্গে আমার যোগাযোগ সেই কারণে। আমি তো সেক্রেটারি হয়ে গেলাম। আবার সেক্রেটারি থেকে বিদায় নিচ্ছি জেল থেকে বেরিয়ে। তারপর তো কাজের ধারা আমরা স্পিডআপ করলাম। আমরা বিপ্লবী বাংলা নামে একটা পেপার বের করলাম। হাতে লিখে। কয়েকটা সংখ্যা করেছিলাম। এগুলি খুব গোপন। কারণ ধরা পড়লেই, মানে বেত মারা। আর জেল তো আছেই। রাজশাহীতে একটা স্কুলের ছেলে একটা গোপন দলের পোস্টার লাগাতে গিয়েছিল—তাকে আটটা বেত মারা হয়েছে। সে যখন জেল থেকে বের হলো, তাকে এক্সিবিট করা হলো—ছাত্র ইউনিয়ন ওটা করল। আমরা পক্ষে ছিলাম। কিন্তু ছাত্র ইউনিয়ন ওই ছেলেকে তাদের পকেটে নিয়ে গেল।
মহি: এই যে আপনারা ক্ল্যানডেসটাইন কাজ করছিলেন, ওই সময় যারা আপনাদের সিনিয়র বা কনটেম্পোরারি ছিল, বিশেষ করে মোয়াজ্জেম ভাই বা মণি ভাই, এঁদেরকে কনফিডেন্সে নিলেন না কেন? আমি মোয়াজ্জেম ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। উনি বলেছেন, পূর্ববঙ্গ মুক্তি ফ্রন্ট। উনি তারিখ বলতে পারেননি। মনে হয়, ১৯৬১ সালের শেষ দিকে অথবা ১৯৬২ সালের শুরুর দিকে।
সিরাজ: হতে পারে।
মহি: একটা লিফলেট। শেখ মুজিব তাঁকে দিয়েছেন। উনি আমাকে বলেছেন—আমি পাঁচজনের টিম করলাম—আমি, মণি, ওবায়েদ, সিরাজ, আরেকজন...
সিরাজ: সৈয়দ আকবর। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার।
মহি: না, উনি বলেছেন ফরিদপুরের একজন—আনিস। এই পাঁচজন মিলে আপনারা বিভিন্ন এমবাসির সামনে ফেলে এসেছেন।
সিরাজ: এমবাসি না, হলে হলে।
মহি: এটা কি শেখ মুজিবের সঙ্গে আপনার দেখা হওয়ার আগে?
সিরাজ: আগে-পরে, টাইমটা ঠিকমতো বলতে পারব না।
কিন্তু মাথায় তো পোকা আছে। মোয়াজ্জেম ভাই হঠাৎ আমাকে আর মণিকে ডাকলেন হসপিটালে ব্রাদার-সিস্টাররা যেখানে থাকেন, তাঁদের চিফের বাসায় ছিলেন। আজিমপুর কলোনিতে। আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, সারেন্ডার করতে হবে। পেপারে নাম দিয়েছে সারেন্ডার করার জন্য। তাদের নামে তখন হুলিয়া। বললেন, সারেন্ডার করব।
মহি: এটা মোয়াজ্জেম ভাই বললেন?
সিরাজ: হ্যাঁ। বললেন, দেশ থেকে একটু ঘুরে আসি। মুন্সিগঞ্জ থেকে। এ ব্যাপারে প্রশ্ন করায় বললেন, পরে জানাব। বের হয়ে এসে মণি বলল যে তোরা ঢোকার আগে উনি আমার সঙ্গে কথা বলেছেন, উনি এটার সঙ্গে থাকবেন না।
মহি: মোয়াজ্জেম ভাই থাকবেন না? এটা মণি ভাইকে আগেই বলেছিলেন?
সিরাজ: আগে মানে ওই বৈঠকের আগে। এই ওনার ডিসঅ্যাসোসিয়েশন হয়ে গেল। আর মণির ডিসঅ্যাসোসিয়েশন হলো—তার গলায় রক্ত। আর সে বিয়ে করে ফেলল। সেরনিয়াবাত সাহেবের মেয়ে। ওদের একই বংশের মধ্যে বিয়ে হয়, জানো তো? আমি পড়ে গেলাম একা। কিন্তু মাথায় তো পোকাটা ঢুকে গেছে। ওইটার সাথে আর ওরা নাই। আমরা যেটা শুরু করলাম, একেবারে লিংকবিহীন। আমাদের নিউক্লিয়াসটা শুরু করলাম।
আমি তখন গুরুত্ব দিলাম নিজের ওপর, আরও পড়াশোনা করার। ইংরেজি পড়ার সঙ্গে যুক্ত হলাম। এবং পড়ার সাথে একটা মিশে যাওয়া, এটা শুরু হয়ে গেল। রাজ্জাকও চেষ্টা করত। কাজী আরেফ ঠিক পড়তে পারত না। কিন্তু আমরা পড়ার পরে তার সঙ্গে আলাপ করতাম। হি ওয়াজ লিসনার, কম কথা বলত। খুব কড়া ধরনের অর্গাইনাইজার ছিল। আমি তো একটু লিবারেল। ও এর মধ্যে নাই। নিউক্লিয়াসের মধ্যে ভেটো পাওয়ার ছিল। এই ভেটো পাওয়ারের কারণে—সে-ই বেশি ভেটো দিত। কত সিদ্ধান্ত যে নিতে পারিনি তার জন্য? আর সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হতো। এক মাস, দুই মাস। যেমন জয় বাংলা স্লোগান। সিদ্ধান্ত নিতে আমাদের এক সপ্তাহ দেরি হয়েছিল। আমরা এটা মিস করে যাচ্ছিলাম। আমি গুরুত্ব দিয়ে বললাম, যদি ভেটোর কারণে আরও দেরি হয়ে যায়, তাহলে আন্দোলনের গতি কিন্তু মিস হয়ে যাবে।
মহি: ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন ছিল?
সিরাজ: তখন থেকেই ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে আই হ্যাভ আ কর্ডিয়াল রিলেশন। এমনিতেই সবার সঙ্গে আমার একটা কর্ডিয়াল রিলেশন ছিল।
মহি: ফরহাদ ভাই তো অন বিহাফ অব কমিউনিস্ট পার্টি ছাত্র ইউনিয়নের কাজ কো-অর্ডিনেট করতেন।
সিরাজ: করত এবং হি ওয়াজ দ্য গাইড।
মহি: ওনার সঙ্গে আপনার ঘনিষ্ঠতা হলো কীভাবে?
সিরাজ: আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকতেন উনি। আর এরা জানত যে আই অ্যাম দ্য মেইন ম্যান ইন ছাত্রলীগ। ছাত্র ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট-সেক্রেটারি হিসেবে যারা ছিল, ওরা, মাধ্যম হিসেবে কাজ করত। কোথায় দেখা হবে?—ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটির আহসানউল্লাহ হলে।
মহি: আপনি অনেক দিন আগে আমাকে একটা স্টোরি বলেছিলেন। চিকা মারার গল্পটা।
সিরাজ: হয়েছে কী, ছাত্রলীগের দু-তিনজন, আমিসহ, আর ছাত্র ইউনিয়নের সাইফুদ্দিন মানিক আর রেজা আলী। আমরা ছাত্রলীগ আর ছাত্র ইউনিয়ন একসঙ্গে যেতাম। খুব ফ্রেন্ডলি ছিলাম। হাতে থাকত রঙের বালতি আর ব্রাশ। দুই পার্টির জন্য দুইটা। আর পুলিশের গাড়ি আসে কি না, অবজারভেশন পোস্ট থাকত। একবার আমরা ইকবাল হল থেকে বেরিয়ে এস এম হলের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি—ও, এগুলোতে তো গতকাল মারা হয়েছে। এরপর লক্ষ্য হলো আর্কিটেকচার বিল্ডিং। এখানে বিরাট একটা পুকুর ছিল। নতুন আর্কিটেকচার বিল্ডিং হবে। এ জন্য দেড়-দুই বছর ধরে ইট আনা হচ্ছে। ইট জমা হচ্ছে। দেয়ালে লেখা শুরু হয়। হঠাৎ একটা ইঁদুর যায়। ইঁদুর-জাতীয় কিছু—চিকা। সামনে দিয়ে চলে গেল। বললাম, এটারে মারি। তো এটা তো ইটের মধ্যে ঢুকে গেছে। চারদিকে ঘিরে দাঁড়ালাম—হুস হুস করছি। এইটা তো আর বের হয় না। ভোর সোয়া পাঁচটা-সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে। আচ্ছা, বাদ দাও, আজ আর করব না। আবার হয়তো দুদিন পরে প্রোগ্রাম হলো। প্রোগ্রামটা হতো বিকেল বেলা, ইকবাল হলের ক্যানটিনে। আমরা তো বলতে পারব না, গোপনে রাতে দেয়ালে রং দিয়ে লিখতে যাচ্ছি। বলতাম, ওই যে, ওই যে, চিকাটাকে মারতে হবে না? এরপর যেদিনই যেতাম কী কাজ, চিকা মারা। চিকা মারতে বের হব ওই টাইমটায়। ইট ওয়াজ সো পপুলার! ইনস্পায়ার্ড ফিল করত সবাই। ওখান থেকেই চিকা মারা কথাটা এসেছে।
মহি: এটা কোন সময়? আপনি অ্যারেস্ট হওয়ার আগে?
সিরাজ: হ্যাঁ। আমি তো লাস্ট ম্যান, অ্যারেস্ট হলাম।
মহি: আপনার সঙ্গে কি বাদশা ভাই (আমিনুল হক বাদশা) ছিলেন?
সিরাজ: হ্যাঁ, ও লিখে দিত। আমাদের মধ্যে লেখার একমাত্র লোক ছিল বাদশা। আমরা ডিপেন্ড করতাম ছাত্র ইউনিয়নের ওপর। সাইফুদ্দিন মানিকও লিখতে পারত, আর আর্ট কলেজ থেকে তিন-চারজন নিয়ে আসত।
মহি: হাশেম খান তো আপনার কনটেম্পোরারি?
সিরাজ: তাকে আমরা অনেক সময় বলতাম। তখন একসঙ্গে তিন শ, চার শ, পাঁচ শ পোস্টার ওখানে প্রোডাকশন হতো। তারপর ডিস্ট্রিবিউশন হয়ে যেত। সব আমাদের ছেলেরা করত। কেউ জানে না। কীভাবে শহীদ মিনারে একুশ তারিখ সকালে ফুল আসল, ঝাড়-পোঁছ করল, গরুর গোবরের সঙ্গে মানুষের পায়খানাও পরিষ্কার করল, কেউ কোনো দিন জানে নাই। এন এম হারুন জানে। মওলা ছিল।
মহি: কামরুল আলম খান খসরুর ওস্তাদ মওলা।
সিরাজ: খসরুর শাগরেদ মওলা। আর আর্টিস্ট ছিলেন গোলাম মওলা ভাই। আমাদের লিডাররা তো কেউ বের হতেন না। আমরা কী করতাম? তখন তো ফুল পাওয়া যেত না। বোটানিক্যাল গার্ডেন থেকে ফুল আনতাম। পরে কয়েকটা বাড়িতে গিয়ে চুরি করে নিয়ে আসতাম। বোটানিক্যাল গার্ডেনের যিনি ইনচার্জ ছিলেন, তিনি পরদিন ফুল চুরি হয়ে গেল বলে নাইটগার্ডকে খুব গালাগাল করতেন। কিন্তু আমরা নাইটগার্ডকে তো বাগায়া ফেলেছি। রাত বারোটা-একটার দিকে ধুয়েমুছে ফুলগুলো ওখানে রেখে আসতাম। তখন তো ওভাবে মিছিল-টিছিল আসত না। দু-একটা হল থেকে প্রভাতফেরি হতো। ফুল দিয়ে শেষ। এগুলো লাইনআপ করে ফুলগুলো দেওয়া। কেউ তো জানত না, কোথা থেকে কী হচ্ছে। সবাই তো সকাল সাতটা-আটটা-নয়টায় গিয়ে ফুল দিচ্ছে।
রাজ্জাক থাকত অনেক সময়। ও তো ঘুমপাগল ছিল। ঘুমাতে হবেই, রাত তিনটা-চারটা হলেও। কাজটাজ শেষ করে ঘুমাতে যেত। তার তো অন্য রকম একটা অর্গানাইজিং ক্যাপাসিটি ছিল।
মহি: ছয় দফা দেওয়ার সময়টার কথা বলুন।
সিরাজ: ’৬৫-এর যুদ্ধ একটা বিষয় শো করেছে। ইস্ট পাকিস্তানকে ভারত আক্রমণ করল না, এটা দখলও করল না।
মহি: ভারতের মার্সির ওপর থাকল।
সিরাজ: না। মানে হলো, পূর্ব পাকিস্তান একা থাকতে পারে। এই একটা ধারণা। পূর্ব পাকিস্তানকে যদি একা থাকতে হয়, ইন্ডিয়া তো কিছু করবে না? এই একটা বিষয় মাথার মধ্যে ঢুকে গেল। কিন্তু খুব একটা ফাইনাল সিদ্ধান্ত আকারে, তা না।
ছেষট্টিতে যখন ছয় দফা দিল, একদিন দেখলাম ইত্তেফাক-এ থার্ড কলামের মাঝে সাত-আটটা লাইনে—শেখ মুজিবের ছয় দফা। মানে একটা ইমপোরট্যান্ট নিউজকে নেগলেক্ট করে যেভাবে দিতে হয়। ফার্স্ট পেজে দিতে হবে কিন্তু নেগলেক্ট করে। নিউজটা পড়লাম। মণি ডেকে নিয়ে বলল, দোস্ত, চল, এক জায়গায় যাব। গেলাম। মুজিব ভাইয়ের অফিসে। আলফা ইনস্যুরেন্সে। বলল, তুই বস, আমি আসছি। সে ফিরে এসে একটা কাগজ দিল আমাকে। টাইপ করা। ওটা পড়ে—আমি জানি না আমার কী হয়েছে, আমি চলে এলাম।
মহি: শেখ মুজিব তখন অফিসে নেই?
সিরাজ: অফিসে আছে।
মহি: লাহোর যাওয়ার আগে তাহলে?
সিরাজ: না, লাহোর থেকে আসার পরে। আমি কীভাবে যে ইকবাল হলে চলে আসলাম, কীভাবে যে রাজ্জাককে খবর দিলাম, আরেফকে কীভাবে খবর দিলাম, আর হুঁশ নাই। বললাম, পড়ো। রাজ্জাক বলল, ‘এই তো পাইয়া গেছি।’
ছাত্রলীগ কনফারেন্সগুলোকে রিক্রুটের কাজে ব্যবহার করতাম। রাজ্জাককে সারা দেশে ট্যুরে পাঠাতাম। সেন্ট্রাল কনফারেন্সের আগে বিভিন্ন জেলায় কনফারেন্স হয় না? আর সিটিতে কাজী আরেফ। প্রত্যেক ডিস্ট্রিক্টে প্রেসিডেন্ট-সেক্রেটারির মধ্যে কমপক্ষে একজনকে আমাদের রিক্রুট হিসাবে। হয়তো নিউক্লিয়াস না বলে। তারা বুঝে যেত যে একটা ভালো কাজের সঙ্গে, কঠিন কাজের সঙ্গে তারা যুক্ত হচ্ছে। ভবিষ্যতে এ ধরনের কাজ তাদের করতে হবে, এটা তারা বুঝে গেছে।
আমরা তো সব সময় খুঁজতাম, কোথায় কোথায় পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের ডিফারেন্স বা পার্থক্য। ছয় দফা পাওয়ার পরে, আমরা তিনজন কতবার যে পড়েছি। মনে হলো একটা স্বপ্ন দেখার মতো। এটাই তো হলো একমাত্র ডকুমেন্ট, যেটা দেশকে স্বাধীন করার প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। কিন্তু এটা তো সেভাবে প্রচার করার বিষয় না। আওয়ামী লীগও এটাকে নিয়ে এগোতে পারল না। কোনো বিবৃতি দিল না আওয়ামী লীগ।
তখন মাজহারুল হক বাকী হলো ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট।* তার সঙ্গে আমার আলাদা একটা সখ্য থাকার কারণে...।
সে তো কোনো অবস্থায়ই শেখ মুজিবকে টলারেট করতে পারে না। একটা স্টেটমেন্ট দিয়ে এটা ছাপাতে তাকে কনভিন্স করলাম।
এদিকে আইয়ুব খান একটা ট্যাকটিকস নিয়েছে। তখন একটা প্রো-চায়নিজ এক্সিস ঘটানোর চেষ্টা করছে। করতে গেলে ইন্টারনালিও তো এটা খাওয়াতে হবে। সে মাওলানা ভাসানীকে চুজ করল। আইয়ুব খান ছয় দফার বিরুদ্ধে কঠিন একটা বক্তব্য দিয়েছিল—প্রয়োজনে অস্ত্রের ভাষা দিয়ে এটা মোকাবিলা করা হবে। পলিটিক্যালি হি ইউজড মাওলানা ভাসানী। মাওলানা ভাসানী বলল, একটা শর্ত। আমার সব নেতা যারা আন্ডারগ্রাউন্ডে আছে, তাদের মুক্তি দিতে হবে। ছয়জনকে—আসহাবউদ্দিন চিটাগাংয়ের, মোহাম্মদ তোয়াহাসহ আরও দু-তিনজন যারা আছে, আর ভুলক্রমে হলো প্রফেসর মোজাফফর আহমদ। তার নামটাও উনি দিয়েছিলেন। এরা জেলে ছিল। রিলিজ হলো।
তখন ছাত্র ইউনিয়ন ব্রেক হয়ে গেছে। মেনন গ্রুপ তো আরও বেশি খ্যাপা ছিল। মাওলানা ভাসানীর কারণে তখন তারা অ্যান্টি-মুজিব স্টেপটা নিচ্ছে। যেহেতু ভাসানী বলেছে। তাদের এই স্ট্যান্ড, আর আমাদের হলো এর পক্ষে স্ট্যান্ড। তাদের এটা গুরুত্ব পেল কালচারাল ফ্রন্টে। তখন বিএনআর ছিল—ব্যুরো অব ন্যাশনাল রিকনস্ট্রাকশন। যারা প্রতিষ্ঠিত, তারা সবাই এটার নেতা। প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিকেরা পাকিস্তানভিত্তিক সমাজতন্ত্র করবে। আর শেখ মুজিব দেশটাকে ইন্ডিয়ার হাতে তুলে দিতে চাচ্ছে—এই প্রচার। এ জন্য লব্ধপ্রতিষ্ঠ কোনো শিল্পী-সাহিত্যিককে আমরা পাইনি। যাদেরকে পেলাম, তারা হলো, আল মুজাহিদী, মাহবুব তালুকদার, নাসিরুল ইসলাম বাচ্চু, আমিনুল হক বাদশা।
বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে আমরা কামরুদ্দীন আহমদ আর আহমদ শরীফের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতাম। আর ইউনিভার্সিটিতে পলিটিক্যাল সায়েন্সের নূর মোহাম্মদ মিয়া।
কে এই আন্দোলনের নেতা হবে, এটা আমরা বহু চেষ্টা করলাম। হামিদুল হক চৌধুরীর সঙ্গেও দেখা করলাম। ফজলুল কাদের চৌধুরীর সঙ্গেও দেখা করলাম। এস এম সোলায়মান—কৃষক-শ্রমিক পার্টি, তার সঙ্গেও দেখা করলাম।
আওয়ামী লীগও দুই ভাগে ভাগ। আতাউর রহমান খান থাকলেন এনডিএফে। আর এদিকে হলো শেখ মুজিব। ছিটেফোঁটা ছিল চিটাগাংয়ের এম এ আজিজ, খুলনায় শেখ আজিজ, ফরিদউদ্দিন, সোহরাব হোসেন—ডিস্ট্রিক্ট নেতা বলা হতো এদের। আসলে এরা হলো থানাপর্যায়ের নেতা। সবাই চলে গেছে, হয় সালাম খানের সঙ্গে অথবা এনডিএফ—আতাউর রহমান খানের সঙ্গে। আর শক্তি হলো ছাত্রলীগ। আমরা ছাত্রলীগকে কন্ট্রোল করতাম।
পরে দেখলাম যে নিউক্লিয়াস দিয়ে তো আর উইং করা যায় না, ২০-৩০-৪০-১০০ জনকে মেম্বার করা যায় না। তখন আমরা এটাকে পলিটিক্যাল উইং আর মিলিটারি উইং করলাম। তখন আমাদের মধ্যে ভিয়েতনাম ওয়ারের একটা ইনফ্লুয়েন্স আসল।
এভাবে গড়াতে গড়াতে, আমাদের শক্তি বেশ। রাজ্জাকের সেক্রেটারিশিপে আমাদের শক্তি তখন, ঢাকায় আমাদের ৪০০-৫০০ পর্যন্ত মেম্বারশিপ।
মহি: ফেরদৌস কোরেশী আপনাদের সঙ্গে থাকলেন না কেন?
সিরাজ: উই ডিডনট ফিল, তার থাকা না-থাকা। একজনের একটা মাইন্ড থাকে তো? তার ছিল না। ওবায়দুর রহমানের ছিল না। আর এটা গোপন সংগঠন তো। যে এটা না জানবে, সে কিছুই জানবে না। অনেকে বলে না, আমরা জানতাম না। গোপন সংগঠন, তুমি জানবা কেমন করে? নূরে আলম সিদ্দিকী বলে না অনেক সময়? গোপন জিনিস সে জানবে কী করে?
ছয় দফা মুভমেন্টকে আমরা কোনো অবস্থায় দাঁড় করাতে পারছিলাম না। আমাদের চিন্তা হলো, ছয় দফা যদি পেতে হয়, তাহলে এটাকে একটা পিপলস ক্যারেক্টর দিতে হবে। কীভাবে সম্ভব? আমরা সারা দেশের ক্রস-সেকশন অব পিপল—তখন তো শ্রেণি-পেশা বলা হতো না? ক্রস-সেকশন অব পিপলকে যদি দাবিদাওয়াভিত্তিক একটা পলিটিক্যাল সাইড নিয়ে আসতে চাই, তাহলে ইট ক্যান ব্রিং সাম রেজাল্ট। আমাদের নিউক্লিয়াসে এ আলোচনাটা হলো। আমরা ছাত্র ইউনিয়নকে এটা দেওয়ার চেষ্টা করলাম। ফরহাদ ভাই তখন কমিউনিস্ট পার্টি অর্গানাইজ করছেন। আন্ডারগ্রাউন্ডে। উনি তো খুবই ভালো মানুষ। এত উঁচু পর্যায়ের চিন্তার মানুষ খুব পাওয়া যায় না। সো পোলাইট, সো কনভিন্সিং! ‘হ্যাঁ হ্যাঁ প্রো-পিপল হতে পারে।’ বললাম ঠিক আছে, আমরা স্বায়ত্তশাসনের দাবিটা দিই? স্বায়ত্তশাসন বলাতে ওরা খুব খুশি হয়ে গেল। এক নম্বরেই স্বায়ত্তশাসন। এটা ১৯৬৮ সালের শেষের দিকে। এই হ্যান্ডলিংটা আমি করাচ্ছি ছাত্রলীগকে দিয়ে। রউফ প্রেসিডেন্ট, খালেদ মোহাম্মদ আলী সেক্রেটারি। যখন স্বায়ত্তশাসনের কংক্রিট প্রস্তাব আসল, ওরা বেঁকে বসল। না, হবে না, ছয় দফা দিয়ে হবে না। এটা আমেরিকান প্রোগ্রাম। বহু সময় যায়। আলোচনা হয়। কোনো অবস্থাতেই তাদের মানানো যায় না। ঠিক আছে ছয় দফার কথা না দিয়ে আমরা টার্মগুলো ব্যবহার করি?
হ্যাঁ, এসব টার্মনোলজিতে এমন সব কথা আছে, তখন এটা তো আর স্বায়ত্তশাসন থাকে না। অন্য কিছু হয়ে যায়। তাহলে যে জায়গাটায় অন্য কিছু হয়ে যাবে, সেটা বাদ। তাহলে তিন নম্বরটা—দুই মুদ্রা?
আমি বললাম, দুই মুদ্রা বাদ। আমি উদাহরণ দিলাম। যদি একটা পরীক্ষায়—অনেক সময় প্রশ্ন থাকে—এইটা অথবা ওইটা। আমি যদি ‘অথবা’টা নিই, আমার অসুবিধা কিসের? আমি তো উত্তর দিচ্ছি। প্রথম প্রশ্নের উত্তরটা না হয় দিলাম না? আলাদা মুদ্রা বা এখানকার টাকা ওখানে যেতে পারবে না। এখানকার হিসাব এখানে থাকবে। রাজি হয়ে গেল। ছয় দফা শব্দটা না থাকলেও এক-দুই-তিন-চার-পাঁচ-ছয় করে রেখেছি। ছাত্রলীগকেও বলতে সুবিধা হবে, ছয় দফাভিত্তিক এগারো দফা। পরে বিভিন্ন দাবিদাওয়া মিলিয়ে হলো এগারো দফা।
এগুলো আবার পাস-টাস করাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে।
মুজিব ভাই তো জেলে। অল লিডারস আর ইন জেল।
মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে মাঝে আই ওয়াজ ক্লোজ। খুবই ক্লোজ। আমিও লাইক করতাম। উনিও লাইক করতেন। এমন কিছু কাজ উনি করতেন—একটা উদাহরণ দিই। একটা ঘূর্ণিঝড় হলো। ঝড়ের পরে কিছু সাহায্য যাবে, আওয়ামী লীগ থেকে লিডার নিয়ে যাবে। ২০০-৩০০ টাকার জিনিস কিনতে হবে। বললেন, ‘সিরাজ, তুমি এগুলো কিনে নিয়ে আসো।’ আমি তো এগুলো চিনি না। ঢাকা শহরে গাজী গোলাম মোস্তফা ছাড়া দুই কসাই—রশিদ, আরেকজনের কী যেন নাম...। কসাই মাঝে মাঝে মাংস দিয়ে আসত মুজিব ভাইয়ের বাসায়। বললেন, ‘আমি রশিদকে দিচ্ছি। তুই তার সঙ্গে যাবি।’ গিয়ে দেখলাম, তার লাগে, পেরেক লাগে, হাতুড়ি লাগে, কিছু কাঠ লাগে—ঘরবাড়ি বানাতে যা যা লাগে আরকি। ৩০০ টাকা তো তখন বিরাট টাকা।
৬৭-৬৮ টাকা বাঁচল। দুপুরে খেলাম। আমার পয়সায় খেলাম আমি। মালপত্র মুজিব ভাইয়ের বাসায় রাখলাম। ৬৮ টাকা ফেরত দিলাম। রশিদরা কিছু খেয়ে এসেছে। তারা এসে মুজিব ভাইকে বলে, ‘মুজিব ভাই, একটা মানুষ পাইছেন। এ রকম খাঁটি পার্টি পাইবেন না।’ অর্থাৎ আন্তরিক আর অনেস্ট-এ হলো ফার্স্ট। আমার ধারণা হলো আরকি। এটাই ফার্স্ট কি না, জানি না। আমার সম্পর্কে তাঁর ধারণা উঁচু পর্যায়ে হয়ে যাওয়া।
মহি: কোন ইয়ারে? সিক্সটি ফাইভের আগে না পরে?
সিরাজ: পরে।
মহি: উনি অ্যারেস্ট হওয়ার আগে?
এই হলো এক। দ্বিতীয় হলো, তাঁর অফিসে যাওয়া-আসা করতাম। অফিস ছিল ১৫ নম্বরে, ৫১-তে না।
মহি: ১৫ পুরানা পল্টন।
সিরাজ: হ্যাঁ। তিন রুম। তিনি বক্তৃতা দিচ্ছেন বিভিন্ন জায়গায়। অ্যারেস্ট হচ্ছেন। আবার জামিন নিয়ে বক্তৃতা দিচ্ছেন। একদিন আমাকে গাড়িতে করে ধানমন্ডিতে নিয়ে এলেন।
বললেন, কালকে নারায়ণগঞ্জে মিটিং।
আমি কি যাব সেখানে?
না, যাইস না। আমাকে অ্যারেস্ট করবে। আর আমাকে বেইল দেবে না। কারণ, ওখানে বেইল করার লোক নাই। আমাকে ১১০০-১২০০ টাকা দিলেন। কাজ করবি। যোগাযোগ থাকবে।
কার মাধ্যমে যোগাযোগ?
এছলাম। তোর ভাবির কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে নিস।
ইসলাম আরকি। উনি বলতেন এছলাম।
এ রকম আরও কয়েকবার গাড়িতে উনি আমাকে হলে নামিয়ে দিতেন। আমি তখন এস এম হলে থাকি। একদিন বললাম, মুজিব ভাই আমার একটা ইচ্ছা আছে, আওয়ামী লীগকে...
বল, বল?
গাড়িতে আমি সাধারণত সামনে বসতাম। উনি পেছনে, গাড়ি থামিয়ে বললেন, তুই পেছনে আয় তো? তারপর গাড়ি যাচ্ছে আবার। বললাম, আওয়ামী লীগকে ইংল্যান্ডের লেবার পার্টির মতো করলে কেমন হয়? লেবার পার্টি সম্পর্কে আমার যে ভালো ধারণা আছে, তা-ও না। কিছু একটা ধারণা ছিল। যে, এটা মানুষের উপকার করে, শ্রমিকশ্রেণির। বললেন, খুব ভালো, করতে পারবি? কর। কোনো অসুবিধা নাই। উনি আমাদের নিউক্লিয়াসের কোনো কিছু ঘুণাক্ষরেও জানেন না।
এই কথা হলো নারায়ণগঞ্জের মিটিংয়ের আগের দিন। তারপর তো উনি জেলে চলে গেলেন।
সিক্সটি সিক্সের সাতই জুন। তাজউদ্দীন ভাইকে তো জেলে নিয়ে গেল। মিজান চৌধুরী হলেন অ্যাক্টিং সেক্রেটারি। হরতাল হবে ৭ জুন। মণি এসে জয়েন করল। আদমজীতে অ্যারোমা টি একটা সেকশন খুলেছিল। সে এটার দায়িত্বে। গাড়িতে করে, গাড়ি মানে সাইকেলে ভ্যান লাগিয়ে ঘোরে না?
মহি: যেভাবে আইসক্রিম বিক্রি করে?
সিরাজ: হ্যাঁ। এটার পেছনে চড়ে আর সাইকেল নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় চা দিয়ে আসত। মধুর ক্যানটিনে, বিভিন্ন হলের ক্যানটিনে...
মহি: ডিস্ট্রিবিউটর?
সিরাজ: হ্যাঁ। কমার্শিয়াল সাইড দেখত। ১০০ না ২০০ টাকার চাকরি। এসে বলল, দোস্ত, কাজ করে নিই।
কী বলবি বল?
আমি কীভাবে করব। আমার যোগাযোগ নাই।
তখন আমার একটা ৫০ সিসি হোন্ডা আছে। এর আগে একটা ডিসিশন ছিল, শ্রমিকদের মধ্যে আমাদের কাজ করতে হবে। তো যোগাযোগটা কীভাবে হবে? আমি তো কিছুই চিনি না। অনলি কানেকশন হতে পারে নোয়াখালী কানেকশন। মানুষ যেমন, বিভিন্ন কানেকশনকে গুরুত্ব দিয়ে ঢোকে, এই সেন্সে। তেজগাঁওতে পেয়ে গেলাম। রুহুল আমিন ভূঁইয়া না। অন্য একজন। আদমজীতে পেয়ে গেলাম আজিজুল হক, আওয়ামী লীগের ভক্ত। আমার দুই বছরের সিনিয়র। আর ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরিয়া হিসেবে তখন আছে ডেমরা, আর শাহজাহান ভাইয়ের পোস্তগোলা। হ্যাঁ। সামান্য কিছু চটকল, ম্যাচ ফ্যাক্টরি এই। নোয়াখালী কানেকশন। বলল যে আমরা তো এটা করতে পারব না। আমাদের বড় নেতাদের বলতে হবে। কে বড় নেতা? রুহুল আমিন ভূঁইয়া, আবদুল মান্নান। এখানে পোস্তগোলায় পেলাম মেসবাহকে। সে বলল, তারও কিছু কানেকশন আছে। তার কানেকশন নিয়ে মুভ করে তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বললাম। আওয়ামী লীগ অফিসে তাদের নিয়ে আসলাম। মিজান ভাইয়ের সঙ্গে কথা বললাম। তারা মিজান ভাইকে বলল, কিছু টাকা খরচ করতে হবে। কত টাকা খরচ করতে হবে? ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকা। তখন তো এটা অনেক টাকা। বললেন, আপনারা কাজ শুরু করেন। সিরাজ তো যোগাযোগ রাখবে। সিরাজ, তুমি এদের পেছনে লাগো। টাকা আমি জোগাড় করব। যেভাবেই হোক।
টাকা সংগ্রহ হলো। কেউ ১০০, কেউ ২০০। আদমজীতে সাদুকে পেয়ে গেলাম। সাইদুল হক সাদু, গাট্টাগোট্টা। চেহারাসুরতও সে রকম। বলিষ্ঠ, পেটানো শরীর। কী কারণে আমি তাকে লাইক করে ফেলেছি। আজিজ ভাইকে বললাম। ‘গুন্ডা মার্কা, প্রস্টিটিউশনে পড়ে থাকে, এটাকে নিয়ে কী করবেন?’ বললাম, কাজ হলেই তো হলো।
একটা ভিন্ন ধরনের প্রচার-প্রপাগান্ডায় আমরা নেমে গেলাম। প্রথম যেদিন নামলাম, মোয়াজ্জেম ভাই বাইরে, মিজান ভাই বাইরে। হরতালটা ডাকা হবে কীভাবে? বায়তুল মোকাররমের ওখানটা, মোয়াজ্জেম ভাই বলে, ‘সিরাজ, তুই কর।’ আমার তখন গা কাঁপতেছে। বললাম, কী বলব? ‘বল, বল?’ তখন আমি তো বক্তৃতা-টক্তৃতা দিই। একটা দোকান থেকে টুল নিয়ে এসে দাঁড়িয়ে বললাম, এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে, পূর্ব পাকিস্তানের দাবির পক্ষে, রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিতে সাতই জুন হরতাল। লোক ছিল ৭-৮ জন। ১৫-২০ জন হলো এসবির লোক।
তখনো বায়তুল মোকাররম মসজিদের সিঁড়িগুলো হয়নি। অত দূর পর্যন্ত যেতে মোয়াজ্জেম ভাই বললেন—ভাগ। আর একটু হলে অ্যারেস্ট করে ফেলবে। ভেগে চলে আসলাম। আমাদের নিউক্লিয়াসে যেহেতু ১০০-২০০-৩০০ মেম্বার হয়ে গেছে, আমরা স্টুডেন্টদের মধ্যে প্রচার শুরু করলাম। তেজগাঁওয়ে তো স্কুল আছে। স্টুডেন্টদের বললাম, কোথায় কোথায় শ্রমিক আছে, আমাদের খোঁজ দাও। আদমজীতে কলেজ আছে। তাদের খোঁজ দাও। সেভাবেই আমরা যোগাযোগ করেছি। নোয়াখাইল্যা আর ছাত্রলীগের কানেকশনে।
ডিস্ট্রিক্টেও ছড়িয়ে গেল। যে হরতাল হলো, আনপ্রিসিডেন্টেড। মনে হলো, যেন একটা পাখিও ওড়েনি। আর সারা ঢাকার রাস্তায় ইট পেতে দেওয়া হয়েছে। তখন তো গাছ কাটার অভ্যাস হয়নি। আদমজীর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে—সাদু তোমাদের ওপর নির্ভর করছে ঢাকার হরতাল। বলল, ‘মুসলমান হিসাবে কথা দিলাম—হবে। আপনাকে কোথায় খুঁজব।’ আওয়ামী লীগ অফিসে। রাতে থাকলাম মঞ্জুদের (আনোয়ার হোসেন মঞ্জু) বাসায়। তখন বেশির ভাগ সময় মঞ্জুদের বাসায় থাকতাম। ওর একটা প্রিন্স গাড়ি ছিল। ওটায় চড়ে আমরা ঘুরতাম।
রাস্তায় এমনভাবে ইট বসানো। ইট সরিয়ে সরিয়ে গেলাম, হরতাল কেমন হয়েছে জানার জন্য। কাছে কী আছে? তেজগাঁও। যেভাবে ইট ছড়ানো, বহু কষ্টে—সোনারগাঁও হোটেল তো তখন ছিল না, ওই পর্যন্ত আসতে দেখলাম, ছাত্ররা মিছিল বের করার চেষ্টা করছে। তেজগাঁওয়ে গুলিতে শ্রমিক মারা গেছে—মনু মিয়া নাম। পরে পেপারে ছাপা হওয়ায় নাম জেনেছি।
তারপর আওয়ামী লীগ অফিসে গেলাম। হঠাৎ পুলিশের একটা জিপ আসল। আমরা তো কোনো অবস্থায় অ্যারেস্ট হব না। ভেতরে এসে বলল, সিরাজুল আলম খান কার নাম? বললাম, আমার নাম। ওখানে দেখলাম, তার সঙ্গে জিপে এসেছে সাদুর সঙ্গের এক লোক। পুলিশ বলল, এই শ্রমিক এসেছে আপনার সঙ্গে কথা বলতে। দেখলাম, তার নাম শফি। বলে যে আমরা মিছিল নিয়ে যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত এসেছি। সাদু ভাই বলেছে, আপনাকে নিয়ে যেতে।
পুলিশ অফিসারটা বলছে, ‘আমরা বলেছি হরতাল হয়ে গেছে। ওরা বলে যে উনি না বললে আমরা যাব না।’
২০ থেকে ২২ হাজার লোকের মিছিল। হাতে হলো আগুনের লুয়া। তখন তো মশাল বলত না।
আদমজী এমনিতেই তো জুট মিল। পাটের কোনো অভাব নেই। কাঠের কোনো অভাব নেই। পেট্রলপাম্প আছে। তেলের কোনো অভাব নেই। তিন থেকে চার হাজার লোকের হাতে লাঠি। মাথায় পাট, তাতে আগুন। একটু অন্যমনস্ক হলেই সারা ঢাকায় আগুন জ্বলে যাবে। এই রকম অবস্থা। পুলিশ অফিসার আমাকে এটা বলেছে, ‘আমি চিনি না আপনাকে, যে-ই হোন, ওখানে গিয়ে তাদের থামান।’
গেলাম। সবাই সেখানে বসে আছে। কিছু লেবু দেওয়া হয়েছে। লেবুর শরবত খাচ্ছে, ১৩ মাইল হেঁটে আসার পর। বললাম, মিছিল হয়েছে। এখন তোমরা যাও। সবাই জিন্দাবাদ দিয়ে দিয়ে আবার চলে গেল। মোট খরচ হয়েছে দেড় শ টাকা। লেবুর শরবত। আর তো কিছু দেওয়া যায় না। অনেকেই বাধ্য হলো হরতালের খবর দিতে, কীভাবে ডিভাস্টেটিং হরতাল হলো।
তখনই আমাদের ধারণা হলো, ইয়েস, শ্রমিকদের অর্গানাইজ করতে পারলে ইট ক্যান বি ডান। আত্মবিশ্বাস এসে গেল। শ্রমিক সংগঠন থাকলে, ইট ক্যান বি ডান। এটা তো বলতে গেলে একেবারে ওয়ানম্যান শো, আমার দ্বারা। আর আমার মোটরসাইকেল আর মেসবাহ। আর পেয়ে গেলাম সিনিয়র লোকগুলোকে। মান্নান ভাই তো সমাজবাদী দলের। তাঁকে বললাম, শ্রমিকনেতা থাকবেন। শ্রমিকনেতা থেকে যদি একজন পার্লামেন্ট মেম্বার হতে পারেন, আপনি কত কথা সামনাসামনি বলতে পারবেন? সারা দেশের লোক জানবে? এ কথাগুলো উনি অ্যাপ্রিসিয়েট করলেন। এই তো হলো শ্রমিক সংগঠন করার গোড়ার কথা। নাম না দিয়ে নিউক্লিয়াস, সেল সেল সেল। একেকটা ইন্ডাস্ট্রিতে পাঁচটা, সাতটা, দশটা পর্যন্ত সেল। আদমজীতে তো ২০-২৫টা সেল বানিয়ে ফেলেছি।
আর এদিকে হলো ছয় দফাকে এগারো দফায় পরিণত করা। এক দিকে আন্দোলন, আরেক দিকে সংগঠন। এই জায়গাটায় আসতে ১৯৬৯ এসে গেল।
মহি: শেখ মুজিব যে টাকা দিলেন, কত টাকা?
সিরাজ: ১১০০-১২০০, তাদের খরচের জন্য। ওই কথা, তোর ভাবির সঙ্গে যোগাযোগ রাখিস। আর ইসলাম হলো মূলত পোস্টার লেখার লোক। মাঝেমধ্যে ১০০-২০০ পোস্টার লিখে দিত সে। আমরা আমাদের লোকের মাধ্যমে এটা লাগাতাম।
মহি: ওনার পুরো নাম নুরুল ইসলাম নাকি? নাম শুনেছি।
সিরাজ: হ্যাঁ। একটা বইও লিখেছে। আমার একটা নিক নেম ব্যবহার করা হতো। ভাবির কাছে ফোন করার জন্য—ইটালা—মানে ইটওয়ালা। তখন বাড়ির কনস্ট্রাকশন হচ্ছে তো। ইট সাপ্লাই হতো। তো ফোনে কে বলছেন আপনি? ইটালা বলতেছি। ও আচ্ছা, ঠিক আছে আসেন। কোনো জরুরি খবরটবর থাকলে, ওয়ানস ইন আ মান্থ।
ঢাকার বাইরে জেলাগুলোতে আমরা একটা ফরমেশনে চলে গেলাম। ছাত্রলীগ হলো মেইন অর্গানাইজেশন। তারপর আন্ডারগ্রাউন্ড বা ব্যাকআপ নিউক্লিয়াস। শ্রমিক সংগঠনের ওপর জোর দেওয়া হলো। আওয়ামী লীগের স্ট্রাকচার তো নাথিং।
মহি: আপনাদের নিউক্লিয়াসের এক্সপানশনটা কখন শুরু হলো?
সিরাজ: তখন থেকেই। পার্টিকুলারলি সিক্সটি ফাইভে, যখন জেল থেকে বের হলাম। এর আগে আমাদের সদস্যসংখ্যা কত? ২০-২৫-৩০-৪০-৫০। আর জেলে যাওয়ার পর, আরেফ একা কাজ করত।
তুমি বুঝতে যে, আমার সঙ্গে তোমার চলাফেরার মধ্যে একটা আনন্দ আছে। আর আমিও তোমাকে চুজ করছি। বাট আই অ্যাম নট টেলিং ইউ এভরিথিং যে, এটা একটা গোপন সংগঠন। তুমি তো বুঝেই ফেলবে যে, হাউ ইমপোরট্যান্ট ইট ইজ। একটা সময় বোঝা যাবে যে উই আর ওয়ার্কিং ফর আ কজ।
মহি: আচ্ছা আবদুল আজিজ বাগমার—এদের ব্যাপারটা কী? এই যে অপূর্ব সংসদ?
সিরাজ: শুনেছি পরে। সে তো আমারে ধরায়া দিছে। এসবির এজেন্ট ছিল। আই ওয়াজ দ্য লাস্ট ম্যান টু বি অ্যারেস্টেড ইন নাইনটিন সিক্সটি থ্রি। একসঙ্গে নিয়ে গেল হলে। ইঞ্জিনিয়ারিং হলে। ইঞ্জিনিয়ারিং হলগুলো তখন আন্ডারকনস্ট্রাকশন। সেখানে তার পরিচিত এক রুমে থাকলাম। অন ফোর্থ ডে—বুঝলাম সে কাজটা করিয়েছে। ভুল বোঝার কোনো কারণ নাই—করিয়েছে। আবার ভুলও হতে পারে, অন্য কোনোভাবে সে হয়তো, কেউ হয়তো তাকে ফলো করেছে। তারপর এখানে এসে আমাকে ধরল। এটা হতে পারে। এমনি খারাপ ছিল না। খুব সোশ্যাল, অ্যাকটিভ ছিল। আরও অনেকে এ রকম এসেছে। সেগুলি আমরা অন্যভাবে কভার করতে পেরেছি। আসলে বাংলাদেশ স্ট্রাগল—এগুলো লিখতে গেলে, আমাদের সাইডটা—ইটস আ বিগ বিগ...
মহি: অনেক ডাইমেনশন, অনেক ডিটেইলস।
সিরাজ: আমাদের এই বয়সে, আমি তো বুঝি, আমাকে কী কষ্ট করতে হয়েছে। আমি তো অনেক সুঠাম দেহের, অনেক তেজি মানুষ। অনেক কষ্ট সহ্য করার মানুষ কিন্তু। যেটা খুব কম লোকের মধ্যে আছে। এই আমি এবং আমার মতো যারা নিউক্লিয়াসের সঙ্গে জড়িত ছিল, কঠোর পরিশ্রম, কঠোর। মাইলকে মাইল হাঁটা, ফর নো রিজন। শাজাহান সিরাজ তো প্রায়ই বলে, দাদার সঙ্গে চার-পাঁচ মাইল হাঁটা, আবার ফিরলাম, বুঝলাম না যে হাঁটছি। কী জন্য হাঁটছি, বুঝি নাই। পরে বুঝেছি, এই হাঁটার কারণে আমার যে ইন্টারেস্ট এবং ক্ষমতা, এগুলোর প্রমাণ পেয়ে গেছে সে। দেন হি ওয়াজ আসকড টু জয়েন আ সিক্রেট মুভমেন্ট—স্বাধীনতা। সরাসরি নিউক্লিয়াসের মেম্বার করার তো সুযোগ কম। ডিস্ট্রিক্টে ডিস্ট্রিক্টে একজন করে, তারা তখনো জানে না, নিউক্লিয়াস কী। পরে জেনেছে।
মহি: জাস্ট কনট্যাক্ট পারসন?
সিরাজ: কনট্যাক্ট পারসন।
আমাকে ফজলুল হক হল থেকে এক্সপেলড করেছিল। তারপর ঢাকা হলে গেলাম। সেখান থেকেও এক্সপেল করল আমাকে। দুই জায়গায় একই রকম লেখা। ল্যাঙ্গুয়েজটা হলো সে কী করে, এটা আমরা বুঝি না। ঢাকা হলের প্রভোস্ট লিখেছে, হাউস টিউটর লিখেছে, প্রভোস্ট সাইন করেছে—হোয়াই সিরাজুল আলম খান কামস লেট এভরি নাইট। উই ডোন্ট নো। বাট মে বি দ্য রিজন ইজ নোন টু হিম। খুব সুন্দর একটা সেনটেন্স। কী করে, সে নিজেই জানে, আর কেউ জানে না। আমাকে এক্সপেল করে দিলেন। এখন কেউ না দেখলে, না জানলে তো বুঝবে না। রাত বারোটা-একটা পর্যন্ত ওইসব রেস্টুরেন্টে বসে, ওই যে গুলনার রেস্টুরেন্ট, ইসমাত রেস্টুরেন্ট। এগুলো ছিল সেক্রেটারিয়েটের উল্টো দিকে।
মহি: তোপখানা রোডে?
সিরাজ: হ্যাঁ। এখন তো অন্য কিছু হয়ে গেছে। তারপর তো ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে আমাকে এক্সপেল করল।
মহি: ওটা ১৯৬৪ সালে।
সিরাজ: আমি তো পরীক্ষা দিলাম ’৬৩ সালে।
মহি: আপনাকে তো এক্সপেল করল কনভোকেশনের দিনে গন্ডগোলের কারণে?
সিরাজ: অথচ ওই দিন আমি ছিলাম না।
মহি: আপনাকে দুই বছরের জন্য এক্সপেল করেছিল। আপনাদের মধ্যে একজন মামলা করেছিল—জাকির আহমদ।
সিরাজ: হ্যাঁ, পরে জাস্টিস হয়েছিল।
মহি: তার মামলাটা করেছিলেন এস আর পাল। আপনাদের পক্ষে ইকবাল হলের একজন কর্মী ছিলেন, সিরাজুল হক। উনি আমাকে বলেছিলেন। উনি পরে বিএনপিতে গেছেন। আমার আওয়ামী লীগকে নিয়ে লেখা বইয়ে তো সবগুলো নাম দিয়েছি। নামগুলো আমি পেয়েছি অলি আহাদের বইয়ে। সেখানে অবশ্য নামের বানান-টানানে কিছু ভুল আছে।
সিরাজ: অলি আহাদ আমাকে ভীষণ পছন্দ করতেন। ল্যাঙ্গুয়েজ মুভমেন্টে তো হি ওয়াজ দ্য মেইন ম্যান। ’৯২ সালে আমি যখন অসুস্থ, অপারেশন হলো স্পাইনাল কর্ডে, অলি আহাদ ভাই দেখতে এসেছিলেন। আউট অব দ্য ওয়ে। ধানমন্ডিতে ২ নম্বর রোডে উনি একটা রুম ভাড়া করে থাকতেন। আমাকে বেশ কয়েক দিন নিয়ে গেছেন। দেখতাম, অনেক বই। শেখ সাহেবের জন্য এঁরা রাজনীতিতে থাকতে পারলেন না। এটা কি তার নিজস্ব কারণে, নাকি সুদূরপ্রসারী একটা চিন্তা আছে তাঁর মাথায়, সে কারণে; সেটা আমি এখনো বের করতে পারিনি। আমি ’৪৮, ’৫৪, ’৫৫ সালের কথা বলছি।
আমরাও অ্যাগ্রেসিভ ছিলাম। স্বাধীনতার প্রশ্নে নিউক্লিয়াস যে কাজ করছিল, এ কাজে যদি কেউ হ্যাম্পার করে, নির্মম হতে পারতাম, মারপিট করে, কেউ দাঁড়াতে পারত না। এ রকম একটা শক্তি ছিল। বিশেষ করে, মিছিলগুলোতে ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে। ওদের স্লোগান ছিল জয় সর্বহারা, আমাদের হলো জয় বাংলা। ওদের হলো শ্রমিক-কৃষক অস্ত্র ধরো, আমাদের হলো বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো। একটা হলো ক্ল্যাসিক মুভমেন্ট অব সমাজতন্ত্র, আরেকটা হলো ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্ট। এগুলো এস্টাবলিশ করতে কত-কী যে করেছি? এবং কামরুল আলম খান খসরু আর মোস্তফা মোহসীন মন্টুর অবদান অসম্ভব! এরা তো ১৯৬২ সাল থেকে আমার সঙ্গে। আর এই মুভমেন্টগুলোর সুযোগে ছাত্রলীগ থেকে বিরাট বাহিনী বের করে নেওয়া হয়েছিল আন্ডার দেয়ার কমান্ড।
কামালউদ্দিন ফিরু। কী ডেয়ারিং। খসরুর সামনে কেউ দাঁড়াবে। আনথিংকেবল! যেভাবে তার গ্যাংগুলিকে সে অর্গানাইজ করত। তার আন্ডারে ঢাকায় আমাদের মিনিমাম একেবারে হেলেফেলে হলেও ৬০ জন—আপ টু ওয়ান হানড্রেড। স্ট্যান্ডবাই থাকত। হল-বেসিস, কলেজ-বেসিস, পাড়া-বেসিস। আমাদের খুব বেশি পয়সা খরচ করতে হতো না। মিনিমাম কস্ট। সবাই তো যার যার বাড়িতে থাকত। হলে যারা আছে, তাদের বাপ তো বাড়ি থেকে টাকা পাঠায়। সে জন্য বেশি পয়সা লাগত না, আনলেস স্পেশাল কোনো অকেশনে যদি কিছু খরচটরচ করতে হতো। খসরু একজনই। মহিউদ্দিনও ছিল। একটু ভীরু ছিল সে। ফিরু ছিল খুব সাহসী। ও প্রথমে এনএসএফের সঙ্গে যুক্ত ছিল।
মহি: পরে নিউট্রাল করেছেন।
সিরাজ: পরে তো খসরু-মন্টু-ফিরু-মহিউদ্দিন। এরা এখন অনেকেই সেলফ সেন্টারড হয়ে গেছে। চিন্তাগুলো অত প্রসারিত হয়নি বা আমাদের সমাজজীবনের কারণে, দে হ্যাভ টু বি ফ্যামিলি ম্যান। কিন্তু আমার জীবনে অনেক সুন্দর সুন্দর মানুষকে পেয়েছি। কাউকে কাউকে মনে হয়েছে আমার চেয়েও ভালো মানুষ। এমনিতে আমি তো খারাপ মানুষ না—এটা আমি বুঝি। কারও সঙ্গে খারাপ কথা বলি না। কোনো অবস্থাতে খারাপ চিন্তাই আমি করি না। তোমার কোনো অনিষ্ট হতে পারে—ইট ইজ নট ইন মাই প্ল্যান, ইন মাই থিংকিং প্রসেস। কমবেশি একটা ফিলসফিক্যাল মাইন্ড তো গড়ে উঠেছে। আর এমনিতেই আমি লিবারেল-মাইন্ডেড ম্যান।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের আছে একটি বিস্তৃত পটভূমি। বিভিন্ন সময়ে এ লক্ষ্যে নানান উদ্যোগের কথা জানা যায়। অনুসন্ধানী গবেষণা যত বেশি হবে, ততই এর গভীরে যাওয়া যাবে, জানা যাবে এর পেছনের মানুষগুলোর স্বপ্ন, লড়াই আর তিতিক্ষার কথা।
আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের সময় থেকেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের ওপর অনেক বাঙালির আস্থায় চিড় ধরেছিল। এমনকি যাঁরা নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পথে হাঁটতেন, তাঁদের কারও কারও মধ্যেও। ঘটনা পরম্পরায় দেখা যায়, ওই সময় থেকেই আওয়ামী লীগের তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নানামুখী উদ্যোগ ছিল।
শেখ মুজিবের অনুসারীরা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক কাঠামোর মধ্যে থাকলেও সেখানে একাধিক স্রোতোধারার সন্ধান পাওয়া যায়। আওয়ামী লীগ তখন পুরোপুরি নিষ্ক্রিয়। স্বাধীনতার কথা প্রকাশ্যে প্রচার করার অনুকূল পরিবেশ ছিল না। এমনকি গোপন প্রচারের পক্ষেও জোরালো কোনো প্রবণতা দৃশ্যমান হয়নি। কিছু কিছু সাহসী তরুণ এ লক্ষ্যে কাজ করতেন গোপনে, সতর্কতার সঙ্গে। এ ক্ষেত্রে কেবল একটি প্রক্রিয়া বহমান ছিল, এমনটি বলা যাবে না। এ হলো নদীর জলধারার মতো। একটির সঙ্গে আরেকটির সংযোগ নেই। যেমন তিতাস জানে না তিস্তার কথা, কংস জানে না কুমারের কথা। জানাজানি হয় তখনই, যখন তারা এক মোহনায় মেশে।
দেখা যাচ্ছে, অনেক প্রক্রিয়ার কেন্দ্রে ছিলেন শেখ মুজিব অথবা তাঁকে অবলম্বন করেই আবর্তিত হয়েছে একাধিক ধারা। এই পরিক্রমার একটি সুনির্দিষ্ট মাইলফলক হলো ছয় দফা, যা ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ঝোড়ো হাওয়ার সূচনা করেছিল। তারপর শুধুই এগিয়ে যাওয়া। কিন্তু পথটি সহজ ছিল না। বাংলাদেশের স্বাধীনতার লড়াইয়ের প্রেক্ষাপট বোঝার জন্য এ প্রক্রিয়াগুলোর সুলুকসন্ধান খুবই জরুরি। সিরাজুল আলম খানের নিউক্লিয়াস তেমনই একটি উদ্যোগ। এখানে তার সূচনা পর্বের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ কথোপকথনের মাধ্যমে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
যেকোনো প্রক্রিয়া বা উদ্যোগের সঙ্গে যাঁরা জড়িয়ে আছেন, তাঁদের বয়ানে অনেক সময় নিজের সম্পর্কে অতিরঞ্জন কিংবা অন্যকে খাটো করে দেখার চেষ্টা থাকে। ইতিহাসের সত্য বের করার জন্য দরকার সবাইকে নির্মোহভাবে পাদপ্রদীপের আলোয় তুলে আনা। যাঁর যা প্রাপ্য, তাঁকে তা দিতেই হবে। তা না হলে ইতিহাস হবে না, তৈরি হবে মিথ।