সামাজিক মাধ্যমে উগ্রবাদ প্রচার, বিভ্রান্ত মানুষ

দুটি আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, দেশে উগ্রবাদী বক্তব্যের পাঠক-শ্রোতা-দর্শক ক্রমশ বাড়ছে। মানুষ না জেনে, না বুঝে সামাজিক মাধ্যমে এসব তথ্য শেয়ার করছে।

  • গত বছর ১০টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ১০৫৩টি চ্যানেলে উগ্রবাদী তথ্য প্রচার

  • এসব চ্যানেলের গ্রাহক এখন ১ কোটি ১১ লাখ

  • জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলাম বেশির ভাগ চ্যানেল চালাচ্ছে

বাংলাদেশে উগ্রবাদী বক্তব্যের পাঠক-শ্রোতা-দর্শক ক্রমশ বাড়ছে। তরুণদের একটি বড় বাঙালি বা বাংলাদেশি পরিচয়ের চেয়ে ধর্মীয় পরিচয়ে পরিচিত হতে স্বচ্ছন্দ বোধ করছে বেশি। এতে সামাজিক অসহিষ্ণুতা বাড়ছে। বাঙালির উদার ও অসাম্প্রদায়িক চরিত্র মুছে যাওয়ার ঝুঁকি দেখা দিয়েছে।

বাংলাদেশে কর্মরত দুটি আন্তর্জাতিক সংস্থার পর্যবেক্ষণে এসব কথা বলা হয়েছে। তারা ঘনিষ্ঠভাবে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়মিত পর্যালোচনা করে থাকে। স্পর্শকাতর তথ্য বিবেচনায় সংস্থা দুটি নাম প্রকাশ করতে চায়নি।

উগ্র মতাদর্শের প্রচার কতটা বেড়েছে, প্রতিবেদনের তথ্যে তার কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়। এতে বলা হয়, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ১০টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ১ হাজার ৫৩টি চ্যানেল ব্যবহার করে উগ্রবাদী তথ্য প্রচার করা হয়েছে। এসব চ্যানেলের গ্রাহক এখন ১ কোটি ১১ লাখ।

উগ্রবাদী এসব চ্যানেলে প্রচারিত ৫৮৪টি পোস্টে ২৯ লাখ মানুষ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চ্যানেলের সংখ্যা ছিল ৯১৩টি, গ্রাহক ছিল ১ কোটি ৪ লাখ। এসব চ্যানেলের বেশির ভাগ চালাচ্ছে আল-কায়েদার অনুসারী জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলাম। মানুষ কখনো কখনো না জেনে, না বুঝে এসব চ্যানেলের তথ্য শেয়ার করছে।

আরও পড়ুন

পর্যবেক্ষকেরা মনে করেন, দুর্গাপূজার সময় পূজামণ্ডপে হামলা, শিক্ষার্থীদের হাতে মুন্সিগঞ্জে বিজ্ঞানশিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলকে হেনস্তা, ঢাকায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শিক্ষিকাকে টিপ নিয়ে পুলিশ সদস্যের কটূক্তি ও পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে টিপ নিয়ে অপপ্রচার, নরসিংদীতে পছন্দমতো পোশাক পরায় নারীকে মারধর, নড়াইলে কলেজশিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাসকে লাঞ্ছনা—এই সবই এক সুতায় গাঁথা। এর পেছনে অসহিষ্ণুতা ও উগ্র মতাদর্শের প্রভাব রয়েছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক শাহাব এনাম খান প্রথম আলোকে বলেন, অসহিষ্ণুতা ও ধর্মীয়, রাজনৈতিক উগ্রবাদ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এর থেকে মুক্তি পেতে রাজনৈতিক ও সামাজিক সংস্কৃতিতে আমূল পরিবর্তন দরকার। সমাজ থেকে এই সংস্কারের সূত্রপাত হতে হবে। ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া সংস্কারে কাজ হবে না।

পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) প্রধান ও অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর উপস্থিতি এখন কেবল অনলাইনকেন্দ্রিক। তবে তরুণেরা এখন সচেতন। অপপ্রচার চালানোর পরও জঙ্গিগোষ্ঠীতে তারা যুক্ত হচ্ছে না, সহিংসতায় জড়াচ্ছে না। দেশজুড়ে সিটিটিসির চালানো সচেতনতামূলক কার্যক্রমের একটা প্রভাব পড়ছে।

প্রচারের বিষয়, প্রেক্ষাপট

প্রতিবেদনে বলা হয়, উগ্রবাদী এসব চ্যানেলে আলোচনার বিষয়বস্তুর মধ্যে রয়েছে মুসলিমদের ওপর নির্যাতনের খবর, ভারত ও হিন্দু জনগোষ্ঠী, কাশ্মীর পরিস্থিতি, গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা, নারীবাদ, জাতিসংঘ ও বাংলাদেশ সরকারবিরোধী প্রচার।
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দুর্গাপূজা সামনে রেখে ভারত ও হিন্দু জনগোষ্ঠীর প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ আলোচনা বেড়েছে।

আরও পড়ুন

উগ্রবাদী চ্যানেল থেকে এ সময় যত আধার প্রচারিত হয়েছে, তার ৬০ ভাগই ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে। অন্য সম্প্রদায়ের প্রতি দেশ ও দেশের বাইরের মুসলমানদের উসকে দিতে এই সময়কে বেছে নেওয়া হয়েছিল।

প্রতিবেদনে মাঠের পরিস্থিতি ও অনলাইনে উগ্রবাদীদের তৎপরতার একটি তুলনামূলক পর্যালোচনা তুলে ধরা হয়। যেমন গত বছরের ১৩-১৭ অক্টোবর দেশের বিভিন্ন জেলায় পূজামণ্ডপে ভাঙচুর চালানো হয়। ঠিক ওই সময়ে অনলাইনে হিন্দুবিদ্বেষী বার্তার সংখ্যা শীর্ষে পৌঁছায়। টানা পাঁচ দিন ধরে চলা সহিংসতার জন্য হিন্দুরাই দায়ী—অনলাইনে এমন অপপ্রচার ছড়ানো হয়।

এর কয়েক দিন পর গত বছরের ২২ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে আয়োজিত কনসার্টে ‘মেঘদল’-এর জনপ্রিয় একটি গানে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে বলে প্রচার চালানো হয়। মেঘদলকে ইসলাম অবমাননার জন্য দায়ী করে পোস্ট করা হতে থাকে। পোস্টগুলোতে গানের মাধ্যমে মুসলমানদের নির্যাতন করা হচ্ছে—এমন একটা দৃশ্যপট তৈরির চেষ্টা হয়।

গত বছরের ১১ ও ২৮ নভেম্বর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ১৫ জন নিহত হন। ৩০ নভেম্বর আনসার আল ইসলাম পরিচালিত একটি চ্যানেলের ভিডিও বার্তায় বলা হয়, গণতন্ত্র মুসলমানদের দাসত্বের শৃঙ্খলে বাঁধার একটি মাধ্যম। একইভাবে বুয়েটের আবরার হত্যার রায় ঘোষণা ও অভিজিৎ রায়ের হত্যা সম্পর্কে তথ্য চেয়ে ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঘোষণা নিয়ে আনসার আল ইসলাম নিজস্ব মত প্রকাশ করে।

আরও পড়ুন

প্রতিবেদনে বলা হয়, উগ্রবাদ বা জঙ্গিবাদকে উসকে দেয়, এমন চ্যানেলগুলো সম্পর্কে সাধারণ মানুষ জানতে পারছে না। অনেকে না বুঝে এসব চ্যানেলে প্রচারিত তথ্যে প্রতিক্রিয়া দিচ্ছেন বা শেয়ার করছেন।

যেমন তামিম আল আদনানী ‘অভিশপ্ত নারীবাদের ধূর্ত ফেরিওয়ালা’ শিরোনামে নারীবিদ্বেষী বিভিন্ন ভিডিও প্রকাশ করেন। এসব ভিডিওতে নারীশিক্ষা, নারীর স্বাধীনতা, নারী-পুরুষ সমতার পক্ষে আছে এমন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর কথা বলেন তিনি। অনেকের মতো তাঁর এই ভিডিও শেয়ার করেছে পুরুষ অধিকার সংরক্ষণ ফোরাম নামের একটি প্ল্যাটফর্ম।

সিটিটিসি সূত্র বলছে, তামিম আল আদনানী এই মুহূর্তে আনসার আল ইসলামের অন্যতম বক্তা। কয়েক বছর ধরে তিনি আত্মগোপনে।

বাঙালির উদার ও অসাম্প্রদায়িক চরিত্র ঝুঁকিতে

‘আইডেনটিটি, আইডেনটিটি পলিটিকস অ্যান্ড ইলেকশন ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক একটি গবেষণা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার। ২০১৮ সালের মধ্য জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলা এই গবেষণায় বলা হয়, লিঙ্গ, সামাজিক ও ভৌগোলিক অবস্থান, শিক্ষাগত যোগ্যতা ও ধর্মভেদে সিংহভাগ তরুণ-তরুণী বলেছেন, তাঁরা ধর্মীয় পরিচয়ে পরিচিত হতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন।

গবেষণায় ঢাকা মহানগর, রংপুর ও বরিশাল সিটি করপোরেশন, নীলফামারী ও ঝালকাঠি জেলা, কক্সবাজার ও নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা, রাজশাহীর পবা উপজেলা, যশোরের মনিরামপুর উপজেলার খেদাপুরি ইউনিয়ন, নেত্রকোনার কাইলাতি, মৌলভীবাজারের পূর্ব ও পশ্চিম জুড়ি, জাফরনগরের নারী-পুরুষেরা অংশ নেন। গবেষণায় অংশ নেওয়া ২০৮ ব্যক্তির মধ্যে ১৪৫ জনই ধর্মীয় পরিচয়কে এক নম্বরে রেখেছেন।

শান্তনু মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, মানুষ বহুপরিচয়ের। একটিমাত্র পরিচয় দিয়ে নিজেকে বা নিজেদের পরিচিতি করানো ঝোঁক দেখা দিলে সমাজে অবধারিতভাবে ‘‌আমরা’ ও ‘তারা’ দুটি পক্ষ তৈরি হয়। ধর্মের ভিত্তিতে দুটি পক্ষ হওয়ায় ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং ভিন্ন ধারার মানুষ কোণঠাসা হয়ে যাচ্ছে।

শান্তনু মজুমদার আরও বলেন, এই উপমহাদেশে ঘৃণা সৃষ্টিকারীদের আরেকটি কৌশল হচ্ছে ধর্মীয় সংখ্যাগুরুর মনে লাঞ্ছিত-বঞ্চিত-অপমানিত হওয়ার কতগুলো ভিত্তিহীন ক্ষোভ চাগিয়ে তোলা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সুবিধা নিয়ে এই অপশক্তি এই অপপ্রচারটিই চালিয়ে যাচ্ছে।