আইনি লড়াই
সম্পত্তির জন্য ৫৬ বছরের অপেক্ষা
সম্পত্তি ফিরে পেতে পাকিস্তান আমলে মামলা করেন ঢাকার নবাবগঞ্জের এক ব্যক্তি। তিনি ও তাঁর বড় ছেলে মারা গেছেন। রায় হতে পারে আজ।
সম্পত্তির দখল পেতে সেই পাকিস্তান আমলে মামলা করেছিলেন ঢাকার নবাবগঞ্জের নিবারন প্রামাণিক। এরপর দেশ স্বাধীন হয়েছে, সব মিলিয়ে কেটে গেছে ৫৬ বছর। মামলার আর নিষ্পত্তি হয়নি। ইতিমধ্যে মারা গেছেন নিবারন প্রামাণিক। পরে তাঁর দুই ছেলে এই মামলার পক্ষভুক্ত হন। তাঁদের একজন কিছুদিন আগে মারা গেছেন। অন্যজনের বয়সও আশি পেরিয়েছে।
নিবারন প্রামাণিকের করা সেই মামলা নিম্ন আদালত, জজ আদালত, হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগ হয়ে এখন হাইকোর্টে রায়ের অপেক্ষায় রয়েছে। ঘটনার শুরু ১৯৫০ সালে। ওই বছর দাঙ্গার সময় ঢাকার নবাবগঞ্জ থেকে যশোরে চলে যান নিবারন প্রামাণিক। তিনি ছিলেন কৃষক। নবাবগঞ্জ ছাড়ার সময় ১০ একরের বেশি সম্পত্তি নিজের ভাগনেকে দেখভালের দায়িত্ব দিয়ে যান। দুই বছর পর ফিরে এসে সম্পত্তি আর ফেরত পাননি, পরে আদালতের দ্বারস্থ হন তিনি। সেটি ১৯৬৪ সালের কথা। নিম্ন আদালতে করা ওই মামলায় সম্পত্তি যাতে কেউ বিক্রি করতে না পারে, সে জন্য অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা চাওয়া হয়েছিল।
আইনজীবীর তথ্য অনুযায়ী, পাকিস্তান আমলে করা ওই মামলায় ১৯৮৩ সালে নিম্ন আদালত অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা দেন। যাতে মামলার বিবাদী (নিবারনের ভাগনে গৌর চন্দ্র মণ্ডল) জমি বিক্রি করতে না পারেন। তবে ১৯৯১ সালে ভাগনে বিনিময় দলিলের মাধ্যমে ৯৮ শতাংশ জমি আবদুল জলিল নামের এক ব্যক্তির কাছে হস্তান্তর করেন। এর দুই বছর পর ১৯৯৩ সালে মারা যান নিবারন।
মামলার শুনানি শেষে ১৯৯৯ সালের ৩১ জানুয়ারি তৎকালীন সাব–জজ আদালত নিবারনের পক্ষে রায় দেন। রায় অনুসারে নিবারন ওই জমির (সিএস খতিয়ান অনুযায়ী) মালিক। এর আগে নিবারনের ছেলে লক্ষ্মণ প্রামাণিক ও পরেশ প্রামাণিক মামলায় বাদী হিসেবে পক্ষভুক্ত হন। নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে নিজের কেনা ৯৮ শতাংশ সম্পত্তি ফিরে পেতে জজ আদালতে আপিল করেন আবদুল জলিল। এ আপিল আংশিক মঞ্জুর করে ২০০০ সালের ২৭ এপ্রিল রায় দেন আদালত। রায় অনুসারে, ৪৯ শতাংশ সম্পত্তির স্বত্ব ভাগনে গৌর চন্দ্র মণ্ডলের। এই ৪৯ শতাংশ তিনি বিনিময় করতে পারেন। লক্ষ্মণ ও পরেশ প্রামাণিকের ৫ একর জমির দাবি থেকে ওই ৪৯ শতাংশ বাদ যাবে বলে রায় এসেছে।
তবে নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে দুই পক্ষই ২০০০ সালে হাইকোর্টে রিভিশন আবেদন করে, প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট রুল দেন। ২০১৪ সালের ৩ জুন হাইকোর্ট রুল খারিজ করে রায় দেন। অর্থাৎ জজ আদালতের দেওয়া সিদ্ধান্ত বহাল থাকে। এর বিরুদ্ধে ২০১৬ সালে আপিল বিভাগে আবেদন করেন লক্ষ্মণ প্রামাণিক ও তাঁর ভাই। এর ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালের ২৩ অক্টোবর আপিল বিভাগ মামলাটি হাইকোর্টে পুনঃশুনানির জন্য পাঠান। বিচারপতি এস এম মজিবুর রহমানের একক হাইকোর্ট বেঞ্চে ওই দেওয়ানি রিভিশন আবেদনের ওপর শুনানি হয়। হাইকোর্টের এই বেঞ্চের আজ রোববারের কার্যতালিকায় মামলাটি রায়ের জন্য ৩৮ নম্বর ক্রমিকে রয়েছে।
লক্ষ্মণ-পরেশদের পক্ষে হাইকোর্টে মামলা পরিচালনার জন্য ২০১৮ সালে আইনজীবী চঞ্চল কুমার বিশ্বাসকে দায়িত্ব দেন সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড কমিটি। চঞ্চল কুমার বিশ্বাস গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, আইনি লড়াই চালতে গিয়ে লক্ষ্মণ-পরেশ প্রায় নিঃস্ব হয়ে পড়েন। এ অবস্থায় ২০১৮ সালে লক্ষ্মণ প্রামাণিক সুপ্রিম কোর্টের লিগ্যাল এইড অফিসে আবেদন করেন, তখন তাঁদের পক্ষে মামলা পরিচালনার দায়িত্ব তাঁকে দেয় লিগ্যাল এইড। মামলাটি আজ রায়ের জন্য রয়েছে।
নিবারন প্রামাণিকের ছেলে পরেশ প্রামাণিক থাকেন নবাবগঞ্জের নয়নশ্রী ইউনিয়নের শৈল্যা গ্রামের নিজ বাড়িতে। নব্বই পেরিয়ে যাওয়া মানুষটি এক সময় কাঠমিস্ত্রির কাজ করতেন। তাঁর বড় ৯২ বছর বয়সী লক্ষ্মণ চলতি সেপ্টেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে মারা গেছেন বলে স্বজনেরা জানান।
বয়স ও অসুস্থতার কারণে পরেশ প্রামাণিকের কথা এখন স্পষ্ট নয়। গতকাল মুঠোফোনে তিনি যা বলেছেন, সেটি অনেকটা এ রকম—বাবা মারা গেছেন, ভাইও মারা গেছেন। তাঁরা রায় দেখে যেতে পারেননি। মরার আগে তিনি রায় দেখে যেতে চান।