সবার ওপরে ফেসবুক
>সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক বেশি সময় কাটান তরুণেরা
ফেসবুকই সবচেয়ে জনপ্রিয় মাধ্যম
মতামত প্রকাশ, ব্যক্তিগত সম্পর্ক, দেশ-বিদেশের খবর, বিনোদন, কেনাকাটা—যাপিত জীবনের প্রায় সবকিছুর জন্য তরুণ–তরুণীরা নির্ভর করছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ওপর। আর তাঁদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুক। প্রতি ১০ জনে ৯ জন তরুণ-তরুণীর কাছেই ফেসবুকের জুড়ি নেই।
প্রথম আলোর তারুণ্য জরিপে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। পেশাদার জরিপ সংস্থা ওআরজি-কোয়েস্ট রিসার্চ লিমিটেড পরিচালিত এই জরিপে সারা দেশের ১৫ থেকে ৩০ বছর বয়সী ১ হাজার ২০০ তরুণ-তরুণীর মতামত নেওয়া হয়েছে।
এবারের জরিপে অংশ নেওয়া তরুণ-তরুণীদের ৯৩ দশমিক ৯ শতাংশ বলছেন, ফেসবুক একমেবাদ্বিতীয়ম্। তাঁরা প্রতিদিন গড়ে ৪৬ মিনিট সময় কাটাচ্ছেন ফেসবুকে। শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে এবং তরুণীদের তুলনায় তরুণদের মধ্যে ফেসবুকের জনপ্রিয়তা বেশি। ২০১৭ সালের জরিপে ৯৪ দশমিক ৭ শতাংশ তরুণের কাছে ফেসবুক জনপ্রিয় ছিল।
ফেসবুক তরুণ-তরুণীদের আসক্তিতে পরিণত হচ্ছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সাবেক সভাপতি এ কে এম ফাহিম মাসরুর। বিডি জবসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহিম প্রথম আলোকে বলেন, ফেসবুকের এই আসক্তি আশঙ্কাজনক। তরুণ-তরুণীদের বড় একটা সময় ফেসবুক ব্যবহারের মতো অনুৎপাদনশীল কাজে চলে যাচ্ছে। ইন্টারনেটের অনেক ইতিবাচক বিষয় আছে, সেগুলো তাঁদের সামনে তুলে ধরতে হবে।
তারুণ্য জরিপে দেখা যায়, মার্ক জাকারবার্গের অনবদ্য সৃষ্টি ফেসবুকে আস্থা রাখেন ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সী ইন্টারনেটে নির্ভরশীল তরুণ-তরুণীদের সবাই। তবে ২৫ থেকে ৩০ বছর বয়সীদের মধ্যে ফেসবুকের জনপ্রিয়তা তুলনামূলক কম। এই বয়সী ৮৬ দশমিক ৫ শতাংশ তরুণ-তরুণীর কাছে ফেসবুক সবচেয়ে জনপ্রিয়।
শুধু বাংলাদেশে নয়, পুরো বিশ্বেই একাধিপত্য ফেসবুকের। গত মাসে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তিন মাসে তাদের মাসিক ব্যবহারকারী বেড়ে ২৪৫ কোটিতে পৌঁছেছে। বর্তমানে দৈনিক ১৬২ কোটি মানুষ সক্রিয়ভাবে ফেসবুক ব্যবহার করছেন।
অবশ্য ফেসবুকের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সম্প্রতি প্রশ্ন উঠেছে। ফেসবুকের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ, তারা ব্যবহারকারীদের তথ্য গোপনে হাতিয়ে নিয়ে ব্যবসায়িক উদ্দেশে বিক্রি করে দিচ্ছে। কেমব্রিজ অ্যানালিটিকাসহ নানান কেলেঙ্কারিতে জড়িয়েছে হয়েছে সামাজিক যোগাযোগের এই মাধ্যম। তবে এ–ও সত্যি, ফেসবুকের বিকল্প এখনো তৈরি হয়নি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একজনের ফেসবুক বন্ধুতালিকায় নানা ধরনের মানুষ থাকেন। সেখানে অন্যদের দেওয়া নানা ধরনের পোস্ট থেকে তরুণ-তরুণীরা মনঃকষ্টে ভোগেন। তাতে ব্যবহারকারীদের মধ্যে একধরনের মানসিক চাপ তৈরি হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোয় আসক্তির ফলে তাঁরা বেশি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছেন বলেও তাঁরা মনে করেন।
প্রথম আলোর জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশি তরুণদের পছন্দের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে আছে ইউটিউব। ভিডিও শেয়ারিং এই ওয়েবসাইট ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ৫২ দশমিক ৮ শতাংশ তরুণ-তরুণীর কাছে জনপ্রিয়। দুই বছরের ব্যবধানে ইউটিউবের জনপ্রিয়তা অনেকটাই বেড়েছে। ২০১৭ সালেও প্রথম আলোর উদ্যোগে এই জরিপ হয়েছিল। ২০১৭ সালে ৩৩ দশমিক ৩ শতাংশ তরুণ-তরুণীর সামাজিক মাধ্যমের পছন্দের তালিকায় ইউটিউব ছিল।
জরিপে দেখা যায়, ইউটিউব ব্যবহারে তরুণেরা এগিয়ে। তরুণীদের তুলনায় ইউটিউবে অনেক বেশি মজে থাকেন তরুণেরা। প্রায় ৬২ শতাংশ তরুণ জনপ্রিয়তার দৌড়ে ইউটিউবকে এগিয়ে রেখেছেন। তরুণীদের ক্ষেত্রে তা ৩২ শতাংশ। ফেসবুকের মতো ইউটিউব পছন্দের ক্ষেত্রেও ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণ-তরুণীর আধিক্য বেশি।
জনপ্রিয়তার মিটারে মেসেজিং অ্যাপ ইমো আছে তৃতীয় স্থানে। ৪৬ দশমিক ৮ শতাংশ তরুণ-তরুণীর কাছে জনপ্রিয় এই অ্যাপ। তবে ২৫ থেকে ৩০ বছর বয়সীদের মধ্যে ইমো বেশি জনপ্রিয়। গ্রামাঞ্চলের তুলনায় শহরে এর জনপ্রিয়তা কম। গত দুই বছরে তাঁদের কাছে জনপ্রিয়তা হারিয়েছে ইমো। ২০১৭ সালে ইমো জনপ্রিয় ছিল ৫৬ দশমিক ৮ শতাংশের মধ্যে। এবার তা নেমে গেছে ৪৬ দশমিক ৭ শতাংশে।
জনপ্রিয়তার বিচারে চতুর্থ অবস্থানে থাকলেও হোয়াটসঅ্যাপে মন দেওয়া তরুণ-তরুণীর সংখ্যা বেশ কম, ১৩ শতাংশের কিছু বেশি। তবে শহর এলাকায় এই মেসেজিং অ্যাপ ব্যবহারের হার বেশি। প্রযুক্তি বিশ্লেষকদের মতে, সুরক্ষিত উপায়ে বার্তা আদান–প্রদানের সুবিধাই হোয়াটসঅ্যাপের জনপ্রিয়তা বাড়ার মূল কারণ। বলা হয় হোয়াটসঅ্যাপে এন্ড টু এন্ড এনক্রিপশন ব্যবহার করা হয়। এই ফিচার থাকায় একজন ব্যবহারকারীর পাঠানো বার্তায় অনাকাঙ্ক্ষিত নজরদারি চালানো সম্ভব হয় না। তবে ইদানীং এই দাবির যথার্থতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
জরিপে দেখা গেছে, এ দেশের তরুণ-তরুণীদের মধ্যে খুব কমসংখ্যকই ইনস্টাগ্রাম, টুইটার ও গুগল প্লাসে ঢুঁ মারেন। ছবি শেয়ারের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ইনস্টাগ্রামে আগ্রহ তুলনামূলকভাবে বেশি ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সীদের মধ্যে। মাইক্রোব্লগিং সাইট টুইটারেরও একই অবস্থা।
২০১৭ ও ২০১৯ সালের জরিপের তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, ইউটিউব ছাড়া বাকি সব সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম এ দেশের তরুণ-তরুণীদের কাছে জনপ্রিয়তা সামান্য হলেও হারিয়েছে। যেমন ২০১৭ সালের জরিপের তুলনায় এবার ইউটিউবের জনপ্রিয়তা বেড়েছে প্রায় ২০ শতাংশ। অন্যদিকে ফেসবুক যৎসামান্য জনপ্রিয়তা হারিয়েছে। ইমো ও হোয়াটসঅ্যাপের জনপ্রিয়তাও নিম্নগামী।
কোন মাধ্যমে কত সময়
এবারের জরিপে দেখা গেছে, তরুণ-তরুণীরা প্রতিদিন গড়ে ৪৬ মিনিট সময় কাটান ফেসবুকে। এর তুলনায় ইউটিউবে ৫ মিনিট সময় কম দেন তাঁরা। গতবারের তুলনায় সময় কাটানোর এই হার কাছাকাছি, খুব বেশি হেরফের হয়নি এ ক্ষেত্রে। তবে ইমোতে সময় কাটানো বেশ কমিয়ে দিয়েছেন তাঁরা। সেই প্রভাবই পড়েছে ইমোর জনপ্রিয়তায়।
জরিপে দেখা গেছে, বর্তমানে ফেসবুকে আকৃষ্ট মোট তরুণ-তরুণীর মধ্যে ৪২ শতাংশের বেশি প্রতিদিন গড়ে আধা ঘণ্টা সময় ফেসবুকে দিচ্ছেন। ৩১ থেকে ৬০ মিনিট পর্যন্ত সময় দিচ্ছেন ৪৫ শতাংশ। তবে ১ ঘণ্টার বেশি সময় দেওয়া তরুণ-তরুণীর সংখ্যা আগের চেয়ে কমেছে।
অন্যদিকে ইউটিউবে ৩০ মিনিট পর্যন্ত সময় কাটানো তরুণ-তরুণীর সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৬১ শতাংশ। সময় কাটানোর দিক থেকে ফেসবুক-ইউটিউবের তুলনায় ইমো-হোয়াটসঅ্যাপ তাঁদের খুব আকর্ষণ করতে পারছে না। জরিপ অনুযায়ী, তাঁদের ৮০ শতাংশের বেশি এই দুই মেসেজিং অ্যাপে সর্বোচ্চ আধা ঘণ্টা সময় কাটান। তরুণ-তরুণীদের সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার প্রসঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ভালো কিংবা মন্দ, তা নির্ভর করে ব্যবহারকারীর ওপর। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে বাদ দিয়ে চলা যাবে না, কিন্তু এগুলোর ক্ষতিকর দিক বাদ দিয়ে ইতিবাচক দিকগুলো নিতে হবে। এ বিষয়ে তাঁদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। শিক্ষক ও অভিভাবকদের এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে হবে।