সংকটে ৬ জাতিগোষ্ঠীর ভাষা
শ্যামল চন্দ্র মালির (৩৫) কাছে নিজের ভুঁইমালি ভাষাটি হারিয়ে যাওয়া মা–বাবার মতো। বেঁচে থাকতে তাঁর মা–বাবা এ ভাষায় কথা বলতে পারতেন। এখন এলাকায় তিনি ছাড়া আর কেউ এই ভাষায় কথা বলতে পারেন না।
শ্যামল বলছিলেন, ‘মনে বাসনা আছে, এ ভাষা একদিন আমরা ফিরে পাব। কিন্তু সেটা কবে হবে, কীভাবে হবে, কেউ জানি না।’
নওগাঁর পোরশা উপজেলার কাছারিপাড়ায় বাড়ি শ্যামলদের। নওগাঁসহ উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় দেশের অন্যতম ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ভুঁইমালিদের বাস।
শ্যামলের মতো নিজের ভাষায় কথা বলতে ভুলে না গেলেও আলাল সিং তুরির মনেও কষ্ট আছে ভাষা নিয়ে। বাপ-দাদার খাট্টা ভাষাটি তিনি বলতে পারেন; কিন্তু সন্তানেরা প্রায় পারেই না। রংপুর সদরের লালবাগ এলাকায় থাকেন তুরি জাতিগোষ্ঠীর আলাল সিং। তিনি বলেন, বয়স্করা খাট্টা ভাষায় কথা বলতে পারেন। তবে নতুন প্রজন্ম এ ভাষায় অভ্যস্ত নয়। তারা একদিন এ ভাষা ভুলে যাবে। একদিন হয়তো কেউ এ ভাষায় কথা বলবে না।
তুরিদের বসবাস রংপুরসহ উত্তরের কয়েকটি জেলায়। তাদের ভাষার কোনো বর্ণমালা নেই। মুখে মুখে ফেরে এ ভাষা। প্রায় হারিয়ে গেছে, এমন ছয়টি জাতিগোষ্ঠীর ভাষার জরিপ করছে আন্তর্জাতিক সংস্থা সামার ইনস্টিটিউট অব লিঙ্গুইস্টিক (সিল)। সংস্থাটি ভুঁইমালি, তুরিসহ আরও যে চার ভাষা নিয়ে কাজ করছে, সেগুলো হলো মালো, মুসহর, রাজোয়াড় ও তেলি।
সিলের জ্যেষ্ঠ গবেষক স্কলাস্টিকা শেফালি রিবেরু বলেন, এই গবেষণার ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর ভাষার বর্তমান অবস্থান বোঝার জন্য ‘ফিশম্যান মানদণ্ড’ ব্যবহার করা হয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে ভাষার অবস্থান জানতে এটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
ফিশম্যান মানদণ্ডের পুরো নাম হলো, গ্রেডেড ইন্টারজেনারেশনাল ডিজরাপশন স্কেল (জিআইডিএস)। এ মানদণ্ডের ওপর ভিত্তি করে ছয়টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষার বর্তমান অবস্থা, দৈনন্দিন জীবন ও শিক্ষাক্ষেত্রে তারা কোন ভাষা বেশি ব্যবহার করছে, নতুন প্রজন্ম মাতৃভাষায় অভ্যস্ত কি না ইত্যাদি বিষয়ের ওপর আলোকপাত করে একটি প্রশ্নপত্র তৈরি করা হয়। জরিপের মধ্য দিয়ে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে তার ভিত্তিতে বলা যায়, এ ছয় জাতিগোষ্ঠীর ভাষা বিপন্ন হওয়ার পথে। ভাষাগুলো আছে চরম সংকটে, জানান শেফালি রিবেরু।
একটি ভাষার অবস্থান কোন পর্যায়ে, সেটি বোঝাতে ফিশম্যান মানদণ্ডের আটটি স্তর রয়েছে। চতুর্থ স্তরে থাকলেও ভাষাটি বিপন্ন হিসেবে গণ্য হয় না। কিন্তু চারের পরের স্তরে ভাষাটি বিপন্ন হিসেবে চিহ্নিত হবে। প্রথম স্তরের বিবেচনার বিষয়, ভাষাটি সরকারের ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে ব্যবহৃত হয় কি না। এ ছয় ভাষাসহ বাংলাদেশের কোনো ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষাই সরকারি পর্যায়ে ব্যবহৃত হয় না।
শেফালি রিবেরু বলেন, এই ছয় ভাষা ছয় থেকে অষ্টম স্তরে রয়েছে। অর্থাৎ চরম সংকটে ভাষাগুলো।
সিলের জরিপের তথ্য অনুযায়ী, মালো জনগোষ্ঠী সাদরি ভাষায় কথা বলে। প্রবীণদের মধ্যে এই ভাষার ব্যবহার থাকলেও তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এর ব্যবহার খুব কম।
উল্লেখিত তিন জাতিগোষ্ঠীর বাইরে অন্য তিন জাতিগোষ্ঠী—তেলির মানুষ নাগরী, মুসহররা পশ্চিমা বা দেশওয়ালি ও রাজোয়াড়রা খট্টালী ভাষায় কথা বলে।
ভুঁইমালী ছাড়া অপর পাঁচ জাতিগোষ্ঠীর মানুষের ভাষার মৌখিক রূপ থাকলেও লিখিত রূপ নেই। আর ভুঁইমালীদের নিজস্ব ভাষার মৌখিক বা লিখিত কোনো রূপই এখন আর নেই। এই জনগোষ্ঠীর মানুষ বাংলা ভাষাতেই অভ্যস্ত।
অতিবিপন্ন এসব ভাষা রক্ষায় কয়েক ধরনের ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ শাহরিয়ার রহমান। তাঁর কথায়, যেসব ভাষায় এখনো কিছু মানুষ কথা বলতে পারে, সেগুলোর লেখ্য রূপদানসহ যথাযথভাবে ধরে রাখা দরকার। আর যেসব ভাষার মানুষ আর কথাও বলতে পারে না, সেসবের ছোটখাটো প্রবাদ-প্রবচন কিছুদিন টিকে থাকে। সেগুলো ধরেই ভাষা সংরক্ষণের কাজ করতে হবে।
শাহরিয়ার রহমান বলেন, এসব ক্ষেত্রে প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন এসব প্রবাদ বা প্রবীণদের কারও কথায় কথায় ছড়া কাটার অভ্যাস থাকলে সেগুলো রেকর্ড করা যেতে পারে। এসব কাজ নিজ নিজ জাতিগোষ্ঠীর মানুষেরাই করতে পারেন। তবে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোরও এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসা দরকার।