চালের বাজার
সংকটকালেও সরকারি চাল বিতরণ সীমিত
চালের হালচাল
■ ট্রাকে করে চাল বিক্রি বন্ধ। খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি শুরু হয়নি।
■ সরকারের মজুত গত বছরের চেয়ে ৫ লাখ টন কম। সংগ্রহ গত বছরের অর্ধেক।
■ বাজারে মোটা চালের ঘাটতি।
■ কেজিতে ৪ টাকা বাড়তি চান মিলমালিকেরা।
দরিদ্র মানুষের খাদ্য ব্যয়ের বড় অংশ যায় চাল কেনায়। আয় কমে যাওয়া, আম্পান ও বন্যার বছরে বাড়তি উদ্যোগ নেই।
দেশের বাজারে মোটা চালের দাম দরিদ্র মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। সরকারি হিসাবই বলছে, সাতটি বিভাগীয় শহরে এখন মোটা চালের দর ৪১ থেকে ৪৪ টাকা কেজি, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৬ থেকে ৬৮ শতাংশ বেশি।
রাজধানীর বাজারে মোটা চালের কেজি ৪৪ টাকা থেকে শুরু। তবে ভালো মানের মোটা চাল কিনতে দাম পড়ছে ৪৬ থেকে ৪৮ টাকা কেজি।
দরিদ্র মানুষের খাদ্য ব্যয়ের বড় অংশ যায় চাল কেনায়। ফলে দাম বাড়লে বিপাকে পড়ে তারা। দাম বেশি হারে বেড়েছে দরিদ্রঘন বিভাগে। যেমন রংপুরে গত বছর এই সময়ে প্রতি কেজি মোটা চালের দাম ছিল ২৫ টাকা, এখন তা ৪২ টাকা। ফলে এক কেজি মোটা চাল কিনতে বাড়তি খরচ পড়ছে ১৭ টাকা।
বাজারে দাম বেড়ে গেলে দরিদ্র মানুষের জন্য সরকার স্বল্প মূল্যে ও বিনা মূল্যে চাল বিতরণ বাড়ায়। এ বছর করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে মানুষের আয় কমে গেছে। বিভিন্ন জেলায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মানুষ। এর আগে মে মাসে হানা দিয়ে গেছে ঘূর্ণিঝড় আম্পান। এমন পরিস্থিতেও দুই মাসে সরকারের চাল বিতরণ খুব একটা বাড়েনি, বরং বিনা মূল্যে চাল বিতরণ আরও কম করেছে সরকার। গত অর্থবছরেও ছিল একই পরিস্থিতি।
খাদ্য অধিদপ্তরের সূত্র বলছে, দরিদ্রদের জন্য ট্রাকে করে খোলা বাজারে চাল বিক্রি কর্মসূচি বন্ধ রয়েছে। খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির মাধ্যমে ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রির কার্যক্রম চালু হয়নি। ওদিকে আপৎকালীন খাদ্য মজুত হিসেবে সরকারের ধান-চাল সংগ্রহ কার্যক্রম পুরোপুরি সফল হয়নি। বোরো মৌসুমে ১৬ লাখ মেট্রিক টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্য নিয়ে মাঠে নামা খাদ্য অধিদপ্তর নির্দিষ্ট সময়ে সংগ্রহ করতে পেরেছে ৮ লাখ টনের মতো। বাধ্য হয়ে গত ৩০ আগস্ট সংগ্রহের সময় ১৫ দিন বাড়ানো হয়েছে।
সব মিলিয়ে ২০১৭ সালের পর চাল নিয়ে সমস্যা তৈরি হলো। ওই বছরের নভেম্বরে মোটা চালের কেজি ৪৮-৫০ টাকায় উঠেছিল। কারণ ছিল হাওরে ফসল নষ্ট হওয়া। যার ফলে বোরো মৌসুমে চাল উৎপাদন ৮ লাখ টন কম হয়। এবার উৎপাদন নিয়ে কোনো সমস্যা নেই, বরং বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) বলছে, নভেম্বর নাগাদ উদ্বৃত্ত চাল দাঁড়াবে ৫৫ লাখ টন।
আমাদের হিসাবে দেশে চালের কোনো সংকট নেই। কিন্তু তারপরও কেন দাম বাড়ছে, তা আমরা অনুসন্ধান শুরু করেছি। অনেকের বিরুদ্ধে নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে বেশি ধান-চাল থাকায় জরিমানাও করেছি। আশা করি কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার আগেই যাঁরা চালের মজুত করেছেন, তাঁরা চাল বাজারে ছেড়ে দেবেনমোছাম্মাৎ নাজমানারা খানুম, খাদ্যসচিব
খাদ্যসচিব মোছাম্মাৎ নাজমানারা খানুম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের হিসাবে দেশে চালের কোনো সংকট নেই। কিন্তু তারপরও কেন দাম বাড়ছে, তা আমরা অনুসন্ধান শুরু করেছি। অনেকের বিরুদ্ধে নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে বেশি ধান-চাল থাকায় জরিমানাও করেছি। আশা করি কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার আগেই যাঁরা চালের মজুত করেছেন, তাঁরা চাল বাজারে ছেড়ে দেবেন।’
সীমিত বরাদ্দ
২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশের চালের বাজারে তেমন কোনো অস্থিতিশীলতা ছিল না। ওই বছর সরকার বিভিন্ন কর্মসূচির আওতায় স্বল্পমূল্যে বিক্রি ও বিতরণ করেছিল প্রায় সাড়ে ২১ লাখ টন চাল। ২০১৯-২০ অর্থবছরে করোনা ও আম্পানের আঘাতের পরও চাল বিতরণ কিন্তু তেমন একটা বাড়েনি, বরং খাদ্য অধিদপ্তর বিতরণের যে লক্ষ্য ঠিক করেছিল, তার চেয়ে কম করেছে।
আরেকটু অবাক করা বিষয় হলো, ২০১৯-২০ অর্থবছরে সরকার বিনা মূল্যে মোট চাল বিতরণ করেছে ১০ লাখ ২১ হাজার টন, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় দেড় লাখ টনের মতো কম।
সরকারি গুদামে চালের মজুত এখন ১১ লাখ টনের কিছু বেশি, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫ লাখ টন কম।
সরকারি গুদামে চাল দিতে চালকল মালিকদের সংগঠনগুলো গত জুলাই থেকে সরকারের কাছে বলে আসছে, তারা সংগ্রহমূল্য কেজিপ্রতি ৩৬ টাকার সঙ্গে ২ টাকা বাড়তি চায়। নইলে তারা চাল দিতে পারবে না। গত ২৭ আগস্ট তারা আরেক দফা চিঠি দিয়ে বলেছে, তাদের এখন দিতে হবে কেজিতে ৪ টাকা।
গত এক মাসে ধানের দাম কেজিতে ৭ টাকা বেড়ে ২৭ টাকা হয়েছে। ওই দামে ধান কিনলে প্রতি কেজি চালে খরচ পড়ে ৪২ থেকে ৪৬ টাকা। তিনি বলেন, ‘আমরা কেজিতে ১০ টাকা লোকসান দিয়েও সরকারকে চাল দিচ্ছি। কিন্তু সব মিলমালিকের পক্ষে তো তা সম্ভব নয়। তাই আমরা লোকসান কমাতে প্রণোদনা চাইছিআবদুর রশীদ, চালকল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতির সভাপতি
চালকল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতির সভাপতি আবদুর রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, গত এক মাসে ধানের দাম কেজিতে ৭ টাকা বেড়ে ২৭ টাকা হয়েছে। ওই দামে ধান কিনলে প্রতি কেজি চালে খরচ পড়ে ৪২ থেকে ৪৬ টাকা। তিনি বলেন, ‘আমরা কেজিতে ১০ টাকা লোকসান দিয়েও সরকারকে চাল দিচ্ছি। কিন্তু সব মিলমালিকের পক্ষে তো তা সম্ভব নয়। তাই আমরা লোকসান কমাতে প্রণোদনা চাইছি।’
মোটা চালের ঘাটতি
শুধু দাম চড়া, তা নয়, বাজারে মোটা চালের ঘাটতিও আছে। ঢাকার মোহাম্মদপুর টাউন হল মার্কেট, কাজীপাড়া, মিরপুর-১ নম্বর সেকশন, শেওড়াপাড়ার অলি মিয়ার টেক ও কারওয়ান বাজার ঘুরে গত কয়েক দিনে দেখা যায়, মোটা চাল খুবই কম।
টাউন হল মার্কেটের পাইকারি দোকান সিয়াম রাইস এজেন্সির বিক্রেতা মুরাদ হোসেন বলেন, তাঁর দোকানে মোটা চালের সর্বনিম্ন দর ৪৪ টাকা কেজি। খুচরা দোকানমালিকেরা কিনে নিয়ে আরেকটু বেশি দামেই বিক্রি করবেন। শুধু মোটা নয়, অন্যান্য চালের দামও বাড়তি বলে উল্লেখ করেন তিনি।
বড় বাজারে মিনিকেট চাল মূলত ৫৫ থেকে ৫৬ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। একই চাল ছোট বাজার ও মহল্লার মুদিদোকানে বিক্রি হয় ৬০ টাকা কেজিতে।
সরকারি সংস্থা কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের হিসাবে, গত বছরের এ সময়ের তুলনায় ঢাকায় মাঝারি চালের দাম ২৭ ও সরু মিনিকেট চালের দাম ৩২ শতাংশ বেশি।
মূল্যবৃদ্ধির তিন কারণ
খাদ্যনীতিবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (ইফপ্রি) বাংলাদেশের হিসাবে, দেশে বোরো মৌসুমে প্রায় ২ কোটি টন চাল উৎপাদিত হয়েছে। তার ২০ থেকে ২৫ শতাংশ হচ্ছে হাইব্রিড ও মোটা চাল।
ব্যবসায়ী ও গবেষকেরা বলছেন, মূলত তিনটি কারণে বাজারে চালের দাম বাড়ছে। প্রথমত, করোনা ও বন্যায় সরকারি-বেসরকারি ত্রাণ কার্যক্রমের কারণে মোটা চালের মজুত কমেছে। ত্রাণে মূলত মোটা চাল দেওয়া হয়। দ্বিতীয়ত, চাল ধরে রাখলে ভালো দাম পাওয়া যাবে—এমন একটি পূর্বাভাস বাজারে রয়েছে। এই সুযোগে নতুন একদল ফড়িয়া ও বড় ব্যবসায়ী চালের বাজারে প্রবেশ করেছেন। তাঁরা নগদ টাকায় ধান-চাল কিনে মজুত করছেন। তৃতীয় কারণ হলো, কৃষকেরা এবার বন্যা ও করোনার কারণে নিজেদের জন্য চাল মজুত বেশি করেছেন।
দেশে মোটা চালের উৎপাদন কমছে। কিন্তু দুর্যোগের কারণে এ ধরনের চালের চাহিদা বেড়ে গেছে। ফলে দাম আরও বেড়ে যেতে পারেআখতার আহমেদ , ইফপ্রি বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর
ইফপ্রি বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর আখতার আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, দেশে মোটা চালের উৎপাদন কমছে। কিন্তু দুর্যোগের কারণে এ ধরনের চালের চাহিদা বেড়ে গেছে। ফলে দাম আরও বেড়ে যেতে পারে।
আমদানির চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি
মজুত বাড়াতে খাদ্য মন্ত্রণালয় চাল আমদানির জন্য সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে অনুমোদন নিয়ে রেখেছে। তবে আমদানির কার্যক্রম এগোয়নি। এ ক্ষেত্রে দ্বিমত পোষণ করছে কৃষি মন্ত্রণালয়।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের যুক্তি হলো, ধানের ভালো দাম পাওয়ায় করোনার মধ্যেও গ্রামীণ অর্থনীতি মোটামুটি চাঙা আছে। যার সুফল পাচ্ছে জাতীয় অর্থনীতি। শুল্ক কমিয়ে অবাধ আমদানির সুযোগ দেওয়া হলে বিপুল পরিমাণ চাল চলে আসবে, যা কৃষকদের নিরুৎসাহিত করবে।
বাজারে যথেষ্ট চাল থাকলেও মোটা চালের সংকট আছে। আমাদের হয়তো মোটা চাল আমদানির দরকার হতে পারে। তবে আমরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। এখনই এ ব্যাপারে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নিআব্দুর রাজ্জাক, কৃষিমন্ত্রী
কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাজারে যথেষ্ট চাল থাকলেও মোটা চালের সংকট আছে। আমাদের হয়তো মোটা চাল আমদানির দরকার হতে পারে। তবে আমরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। এখনই এ ব্যাপারে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।’
সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বাড়তি চাল না দেওয়ার বিষয়ে কৃষিমন্ত্রী বলেন, ‘সরকারের গুদামে যথেষ্ট চালের মজুত আছে। যেখানে যে ধরনের খাদ্যসহায়তা দরকার হবে, তা আমরা দিতে পারব।’
‘বিতরণ বাড়ানো দরকার’
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, যেকোনোভাবে চালের মজুত বাড়িয়ে সরকারকে বাজারে হস্তক্ষেপ করতে হবে।
এ বছর আমরা মোট তিনটি বড় সংকটের মধ্যে পড়লাম। করোনা, ঘূর্ণিঝড় আম্পান এবং সর্বশেষ বন্যা। এতে দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ আরও গরিব হয়ে গেছে। ফলে তাদের জন্য অবশ্যই খাদ্যসহায়তা বাড়ানো দরকার।কে এ এস মুরশিদ, মহাপরিচালক, বিআইডিএস
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক কে এ এস মুরশিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ বছর আমরা মোট তিনটি বড় সংকটের মধ্যে পড়লাম। করোনা, ঘূর্ণিঝড় আম্পান এবং সর্বশেষ বন্যা। এতে দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ আরও গরিব হয়ে গেছে। ফলে তাদের জন্য অবশ্যই খাদ্যসহায়তা বাড়ানো দরকার। বাজারে এখন যা চালের দাম, তাতে গরিব মানুষদের জন্য তা কিনতে কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, বন্যায় যেসব অবকাঠামো নষ্ট হয়েছে, সেগুলো কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির আওতায় চালু করলে মানুষের কাছেও খাদ্য পৌঁছাত, আবার অবকাঠামোগুলো দ্রুত ব্যবহার উপযোগী হতো।
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন প্রতিনিধি, নওগাঁ ও কুষ্টিয়া]