শ্বাপদসংকুল জনপদই আমার কর্মক্ষেত্র!

হাসপাতালে আহত মাসুদ আলম। ছবি: এহসান-উদ-দৌলা
হাসপাতালে আহত মাসুদ আলম। ছবি: এহসান-উদ-দৌলা

আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর। ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকিও এসেছিল পরোক্ষভাবে। মফস্বলে এ রকম হরহামেশা হুমকিতে অভ্যস্ত থাকতে হয় বলে ওই হুমকির কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম। মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে পরোক্ষ সেই হুমকি আমার জীবনে কঠিন বাস্তব হয়ে দেখা দিল।
প্রথম আলোতে গত ২০ মার্চ ‘ঝুঁকিহ্রাস প্রকল্পের টাকা নয়ছয়ের যত কৌশল’ শিরোনামে আমার একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। অনুসন্ধানী এ প্রতিবেদনে যশোরের অভয়নগর ও মনিরামপুর উপজেলায় জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকিহ্রাস প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নে অস্বচ্ছতা, অনিয়ম ও দুর্নীতির বিবরণ তুলে ধরা হয়েছিল। ২৮ মার্চ পেশাগত দায়িত্ব পালন শেষে দুপুরের কিছুটা আগে সুন্দলী থেকে উপজেলা সদরে যাওয়ার জন্য ইজিবাইকে রওনা দিই।
সুন্দলী ইউনিয়নের ধোপাদী গ্রামের উলুরবটতলায় পৌঁছালে সুফিয়ান ফকিরের নেতৃত্বে পাঁচ-ছয়জনের একটি সন্ত্রাসী দল ইজিবাইক থেকে আমাকে জোর করে নামিয়ে বেদম মারধর করে। গাছের মোটা ডাল ও ধারালো অস্ত্রের পিঠ দিয়ে আমার কোমর থেকে শরীরের নিচের অংশ থেঁতলে দেওয়া হয়। বাঁ হাত ভেঙে দেওয়া হয়। আঘাত করা হয় ডান হাতে। আশপাশে অনেক লোক দাঁড়িয়ে পুরো ঘটনাটি দেখলেও কেউ আমাকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসেনি।
ওরা বীরদর্পে চলে যাওয়ার পর আশঙ্কাজনক অবস্থায় প্রত্যক্ষদর্শী সেই লোকজনই আমাকে ধরে ইজিবাইকে তোলে। মনে হচ্ছিল, আমার সারা শরীর ছুরি দিয়ে ফালা ফালা করা হয়েছে। তখন অসহনীয় যন্ত্রণা আমার শরীরজুড়ে। নিকটস্থ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দূরত্ব প্রায় সাত কিলোমিটার। নিজেকে আর সামলে রাখতে পারছিলাম না। এ সময় এক অসীম শক্তি আমাকে প্রেরণা জোগাল। এ শক্তি সততার, সততার থেকে বেশি কিছুর। রবীন্দ্রনাথ এলেন মনে। গাইলাম, ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে...।’
সাত কিলোমিটার দূরের স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মনে হলো সাত মিনিটেই পৌঁছে গেছি। সেখানে চিকিৎসকেরা দেখলেন। হলো হাত-পা ও কোমরের এক্স-রে। অবস্থা জটিল! এরপর অ্যাম্বুলেন্সে যশোরের ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল। চলল সাত দিন ধরে চিকিৎসা। খুব বেশি কাজ হলো না। প্রথম আলোর উদ্যোগে সেখান থেকে বিমানে করে নিয়ে যাওয়া হলো ঢাকায় বারডেম হাসপাতালে। দেখতে এলেন সম্পাদক মতি ভাই। এলেন প্রধান বার্তা সম্পাদক লাজ্জাত ভাইসহ অনেকেই। ভালোবাসার হাত সম্প্রসারিত হলো। হলো বাঁ হাতে অস্ত্রোপচার। বারডেমে দুই দফায় ২৫ দিন চিকিৎসা নিলাম। কিন্তু পায়ের খুব বেশি উন্নতি হলো না।

অবশেষে প্রথম আলোর সার্বিক সহযোগিতায় ভারতের ভেলরের খ্রিষ্টান মেডিকেল কলেজ (সিএমসি) হাসপাতালের মেরুদণ্ড (স্পাইন) চিকিৎসক ভেঙ্কটেশ কুমার ও শল্যচিকিৎসক ভিনু ম্যাথিউ জর্জের অধীনে চিকিৎসা নিয়েছি। এখনো আমি পুরোপুরি সুস্থ হতে পারিনি।

বাস্তব অভিজ্ঞতায় বুঝেছি, সাংবাদিকের জীবনের কোনো নিরাপত্তা নেই। নেই একজন সৎ সাংবাদিকের কোনো প্রকৃত বন্ধু। শুধু আছে নিত্যদিনের সামনে চলার কণ্টকাকীর্ণ বন্ধুর পথ। আছে জীবনঝুঁকি। আর এই শ্বাপদসংকুল জনপদই আমার কর্মক্ষেত্র!

মাসুদ আলম: অভয়নগর (যশোর) প্রতিনিধি