শরীফ উদ্দিনের বিরুদ্ধে কী অভিযোগ, এত প্রশ্নের পরেও বললেন না দুদকের সচিব
উপসহকারী পরিচালক শরীফ উদ্দিনকে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) থেকে চাকরিচ্যুতির প্রতিবাদে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন করেছেন তাঁর সহকর্মীরা। পরে দুদকের সচিব মো. মাহবুব হোসেনের কাছে সারা দেশের ৩০০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী স্বাক্ষরিত একটি স্মারকলিপিও দিয়েছেন তাঁরা।
আজ বৃহস্পতিবার বেলা দুইটায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ের ফটকে ব্রিফিং করতে এসে শরীফ উদ্দিনকে চাকরিচ্যুত করার বিষয়ে সাংবাদিকদের একের পর এক প্রশ্নের সম্মুখীন হন সচিব মো. মাহবুব হোসেন। জবাবে তিনি বলেন, একটি প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করার জন্য যত রকমের কাজ করা যায়, একটাও বাকি রাখেননি শরীফ উদ্দিন।
আর দুদকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনুদ্দিন আবদুল্লাহ সাংবাদিকদের বলেছেন, শরীফ উদ্দিন যে কাজ কারবার করেছেন, যাতে ওই সিদ্ধান্ত নিতে তাঁরা বাধ্য হয়েছেন।
তবে শরীফ উদ্দিন ঠিক কী করেছেন বা তাঁর বিরুদ্ধে কী সেই গুরুতর অভিযোগ, যার ফলে তাঁকে অপসারণ করা ছাড়া দুদকের উপায় ছিল না—এসব বিষয়ে এত প্রশ্নের পরেও সেটা পরিষ্কার করে বলেননি দুদকের চেয়ারম্যান ও সচিব।
নিচে সাংবাদিকদের প্রশ্ন ও দুদকের সচিব মো. মাহবুব হোসেনের বক্তব্য তুলে ধরা হলো।
দুদকের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী আজকে মানববন্ধন করেছেন চাকরিতে ভয় ও অনিশ্চয়তার জায়গা থেকে। এর সঙ্গে শরীফ উদ্দিনের চাকরিচ্যুতির বিষয়টিও রয়েছে। আসলে শরীফ উদ্দিনের চাকরিচ্যুতির কারণ কী?
দুদকের সচিব মো. মাহবুব হোসেন: আপনারা জানেন, দুর্নীতি দমন কমিশনের যে আইন রয়েছে এবং দুর্নীতি দমন কর্মচারী চাকরিবিধি ২০০৮ রয়েছে। সে অনুযায়ী দুর্নীতি দমন কমিশনের সব কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে থাকে। গতকাল যেটি হয়েছে, শরীফ উদ্দিন দুর্নীতি দমন কমিশন কর্মচারী বিধি অনুযায়ী যে বিধিবিধানাবলি মানা প্রয়োজন, সেগুলো না মেনে অব্যাহতভাবে এই বিধির পরিপন্থী কাজ করে যাচ্ছিলেন। যার কারণে কমিশন মনে করেছে, কমিশনের ভাবমূর্তি রক্ষার স্বার্থে তাঁকে চাকরি থেকে অপসারণ করেছেন। এটি কোনো ব্যক্তির বিষয় নয়।
তাঁর বিরুদ্ধে কি কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে?
মাহবুব হোসেন: আমি তো বললাম, দুর্নীতি দমন কমিশনের যে আইন এবং দুর্নীতি দমন কর্মচারী চাকরিবিধি ২০০৮ অনুযায়ী আমাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কী করবেন, কীভাবে তাঁদের কার্যক্রম চালাবেন, সেগুলো সুন্দরভাবে বর্ণনা করা আছে। কিন্তু উনি (শরীফ উদ্দিন) এই বিধিবিধানের বাইরে গিয়ে অনেক কাজ করেছেন। যেটি আমি এখানে পাবলিকলি (প্রকাশ্যে) বলতে চাই না। ফলে কমিশন মনে করেছে যে দুদকের ভাবমূর্তির রক্ষার্থে, সকলের স্বার্থে ৫৪(২) ধারাটি এখানে প্রযোজ্য হয়েছে। তার মানে এই নয় যে এই ৫৪(২) ধারার প্রয়োগ আমরা সব জায়গাতেই করব। এটি একেবারে শেষ, একেবারে চরম পর্যায়ে যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়, সেটিরই একটি অংশ।
তাঁর বিরুদ্ধে আগে কী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন?
মাহবুব হোসেন: আসলে আমি বললাম যে এখানে পাবলিকলি সব বলা ঠিক হবে না। তাঁর বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ ছিল। তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা চালু রয়েছিল এবং তাঁর বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ আসতে ছিল, অনেকগুলো এসেছে। আপনারা জানেন যে উনি বদলির বিষয়ে, যে তদন্তকালে যে টাকা উদ্ধার হয়েছিল, সে বিষয়ে যে কার্যক্রম করেছিলেন, সে বিষয়ে মহামান্য হাইকোর্ট থেকেও অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। মানে সবকিছু মিলিয়ে চাকরিবিধি পরিপন্থীর কারণে তাঁর বিরুদ্ধে এ ব্যবস্থাটা নেওয়া হয়েছে।
সে টাকাটা কোথায়?
মাহবুব হোসেন: সেই টাকা বিধি মোতাবেক যথাযথ জায়গায় এখানে রাখা হয়েছে।
(এ বিষয়ে শরিফ প্রথম আলোকে বলেন, র্যাবের অভিযানে কক্সবাজারের ভূমি অধিগ্রহণ শাখার একাধিক কর্মীর কাছ থেকে জব্দ করা ৯৪ লাখ টাকা পরে দুদকের মামলার আলামত হিসেবে জব্দ করেন শরীফ। সেই টাকা দুদক অফিসের ভল্টে রাখেন তিনি। ওই মামলার অভিযোগপত্র দিলেও করোনার কারণে টাকাটা আদালতে জমা দিতে পারেননি। বিষয়টি দুদকের ঊধর্বতন কর্মকর্তাদের জানিয়ে নিজের কাছে রেখেছিলেন।)
তাহলে কি দুদকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অযৌক্তিক বা আইনবিরুদ্ধভাবে মানববন্ধন করেছেন?
মাহবুব হোসেন: আমি বলেছি যে দুর্নীতি দমন কমিশনের যে আইন এবং দুর্নীতি দমন কর্মচারী চাকরিবিধি পরিপন্থী কাজ করার জন্য এই পদক্ষেপটা নেওয়া হয়েছে। উনি কী কী সমস্যা করেছেন, একেবারে পাবলিকলি এখানে বলতে চাই না। কিন্তু আমরা আইন মেনেই কাজটি করেছি। কমিশন সর্বসম্মতভাবে মনে করেছেন যে চাকরিবিধি পরিপন্থী কাজ যিনি করেছেন এবং অব্যাহতভাবে করছেন। ওনার জন্য অপসারণ ব্যতিরেকে আর কোনো উপায় ছিল না।
যাঁরা মানববন্ধন করেছেন, তাঁরা স্মারকলিপিতে উল্লেখ করেছেন, যে বিধিতে [৫৪(২)] চাকরিচ্যুত করা হয়েছে, সেই বিধিটা উচ্চ আদালত কর্তৃক এখনো বিচারাধীন।
মাহবুব হোসেন: আমি আবারও বলি, আমরা বিধি মেনেই কাজ করেছি। এখন মানববন্ধন কে করেছে, সেটি আমার সামনে ঘটেনি। এখন উনারা কয়েকজন আমার কাছে সকালে এসেছিলেন। তাঁরা চাচ্ছেন যাতে আদেশটি পুনর্বিবেচনা করা হয় এবং তাঁরা বলেছেন যে উনারা কাজকর্ম করতে একটু সেকি ফিল করছেন। আমি তাঁদের আশ্বস্ত করেছি যে দুদক আইন ও চাকরি বিধিমালা অনুসরণ করে আপনারা যদি ন্যায়সংগতভাবে, সততা রক্ষা করে কাজ করেন তাহলে কারও কোনো ভয়ের কিছু নেই।
এই যে ৫৪(২) ধারাটি শুধু দুদকের যাঁরা কর্মকর্তা-কর্মচারী, তাঁদের ব্যাপারে প্রযোজ্য হবে, দুদকের অন্যান্য বিভাগে (প্রশাসন, বিচার বিভাগ ও তথ্য ক্যাডার) তাঁদের ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ হবে না। এটা বৈষম্য কি না?
মাহবুব হোসেন: দুর্নীতি দমন কমিশন আইন এবং কর্মচারী চাকরি বিধিমালা অনেক আগে থেকে চলে আসছে। এই বিধিতে স্পষ্টভাবে বলা আছে কমিশন সিদ্ধান্ত নিতে পারে, যদি ওই পর্যায়ের সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো উপলক্ষ বা ঘটনা ঘটে থাকে। আর অন্য জুডিশিয়াল ক্যাডার বলেন বা প্রশাসন ক্যাডার বলেন, তাঁরা এখানে যে কাজ করছেন, তাঁরা যদি কোনো অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন, তাহলে সেটা থেকে তাঁদের পরিত্রাণের উপায় নেই। দুদক আইন বা চাকরিবিধি তাঁদের বেলায় প্রযোজ্য হবে না, কিন্তু তাঁদের জন্য সরকারি কর্মচারী আইন রয়েছে। এখানে কেউ অনিয়মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়লে তাঁদের বিরুদ্ধে সেই আইনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আইনের চোখে সবাই সমান।
শরীফের বিরুদ্ধে তো আপনারা চূড়ান্ত ব্যবস্থা নিয়ে ফেলেছেন। অপসারণ করার আগে তাঁর বিরুদ্ধে সতর্কতামূলক কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? অনেক দিন থেকে আলোচনা হচ্ছিল যে চট্টগ্রামে ও কক্সবাজারে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের সঙ্গে শরীফের একধরনের দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছিল তাঁর কাজের কারণে। তিন জেলা প্রশাসকের বিরুদ্ধেও শরীফ মামলার সুপারিশ পাঠিয়েছিলেন কমিশনে। তিনি সেটার বলি হলেন কি না?
মাহবুব হোসেন: দুর্নীতি দমন কমিশনের অধীনে যে কার্যক্রম চলমান রয়েছে এখানে এমন কোনো আশঙ্কা নেই, এমন কোনো উপলক্ষ নেই, এমন কোনো ঘটনাও ঘটেনি যে এই তদন্ত করার কারণে বা একে লক্ষ্য করার কারণে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যে বিষয়টি ঘটেছে তার সঙ্গে তদন্ত বা সম্পৃক্ততা নেই। এবং শরীফের বিরুদ্ধে তিন বিভাগীয় মামলা চলমান রয়েছে। আরও ৭ থেকে ১০টি অভিযোগ আমাদের কাছে এসেছে। এবং উনি কী করেছেন, সে বিষয়গুলো বিগত পেপারগুলো দেখলে আপনারা দেখতে পাবেন। মহামান্য হাইকোর্ট থেকেও একবার আমি এখানে আসার আগে পত্রিকায় দেখেছিলাম যে ভুয়া হাইকোর্টের আদেশে এ রকম কিছু করার বিষয়ে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল। কাজেই এখানে লাইন বাই লাইন আমি বলতে পারব না। বাট তাঁর জন্য যেটি প্রয়োজন, সেটি কমিশন বিধি মোতাবেক সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
যাঁরা মানববন্ধন করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে?
মাহবুব হোসেন: এখানে মানববন্ধন বলেন, কর্মবিরতি বলেন, এ রকম তথ্য আমি এখন পর্যন্ত পাইনি। আমি সকাল থেকে অফিসে রয়েছি। যদি এমন তথ্য পাওয়া যায়, তখন অবস্থা বুঝে সিদ্ধান্ত নেব।
আপনি বললেন, শরীফের বিরুদ্ধে তিনটি বিভাগীয় মামলা চলছে। তো বিচারপ্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত কমিশন কেন অপেক্ষা করল না।
মাহবুব হোসেন: আমরা তখন অপেক্ষা করব, যখন কমিশন মনে করে, একজন কর্মকর্তা বা কর্মচারীর কারণে অব্যাহতভাবে আমাদের নিয়মসংগত কাজকর্মে ব্যাঘাত ঘটছে, তখন তারা এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। এ জন্য কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু উনি অনেক সুযোগ পেয়েছেন, এবং উনাকে অনেকবার ডাকা হয়েছে এবং পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ বিধিবদ্ধভাবে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
শরীফের বিরুদ্ধে আসা অভিযোগের সত্যতা দুদক পেয়েছে কি না।
মাহবুব হোসেন: বিষয়টি এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে একটি প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করার জন্য, প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে মানুষের মনে বিরূপ ধারণা দেওয়ার জন্য যত রকমের কাজ করা যায়, উনি একটাও বাকি রাখেননি। কাজেই এখানে আর বেশি কথা বলার প্রয়োজন নেই।