শিরোনামের ইভ্যালির জায়গায় আরও অনেক নাম বসানো যায়। যুবক হতে পারে, ডেসটিনিও চলে। সবচেয়ে ভালো হয় শূন্য স্থান রাখলে। ভবিষ্যতে তবে নতুন নাম এলে, শুধু স্থান পূরণ করলেই হবে। কারণ, ওটিই যে মৃত্যুসম সর্বস্বান্ত হওয়ার গন্তব্য। তা এই লোভের চক্র কি নতুন কিছু?
নতুন কিছুই নয়, বরং প্রচণ্ড ক্লিশে। অথচ সেই পচা শামুকে পা কাটানোর জন্য এ দেশের মানুষ তাতে বারবার পা বাড়ায়। কারণ, পচা শামুকে তারা দামি মুক্তোর খোঁজ করে। শেষে মুক্তোর বদলে মেলে সাদা পুঁতি। এরপর মুক্তোর খোঁজে থাকা লোভ ভুলে গিয়ে শুরু হয় পচা শামুকের গুষ্টি উদ্ধার। কিন্তু যিনি পূর্বসূরির পা কাটা দেখেও জেনেশুনে পা বাড়ালেন, তার কী হবে?
সংবাদমাধ্যমের খবরে প্রকাশ, এখনকার ই-কমার্স, বহুস্তর বিপণন (এমএলএম) কোম্পানি ও সমবায় সমিতি—সব মিলিয়ে গত ১৫ বছরে ২৮০টি প্রতিষ্ঠান মানুষের অন্তত ২১ হাজার ১৭ কোটি টাকা লোপাট করেছে। সব ক্ষেত্রেই উপায় ছিল গ্রাহককে বেশি মুনাফা ও ছাড়ের লোভ দেখানো। বাংলাদেশ ব্যাংক, যুবকের ঘটনায় গঠন করা কমিশন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদন্ত ও গ্রাহকদের দাবির ভিত্তিতে টাকার এই হিসাব পাওয়া গেছে। এর মধ্যে রয়েছে ২০০৬ সালে যুবকের ২ হাজার ৬০০ কোটি, ২০১১ সালে ইউনিপে টু ইউর ৬ হাজার কোটি, ২০১২ সালে ডেসটিনির ৫ হাজার কোটি এবং ২০০৮ থেকে ২০১৭ সাল সময়ে ২৬৬টি সমবায় সমিতির গ্রাহকদের ৪ হাজার ১০০ কোটি টাকা লোপাটের ঘটনা। এ ছাড়া চলতি বছর ১১টি প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের টাকা ফেরত দিচ্ছে না বলে বেরিয়ে আসে। এর মধ্যে রয়েছে ই-অরেঞ্জের গ্রাহক ও সরবরাহকারীদের ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা, ইভ্যালির ১ হাজার কোটি টাকা, ধামাকার ৮০৩ কোটি টাকা, এসপিসি ওয়ার্ল্ডের ১৫০ কোটি টাকা, এহসান গ্রুপের ১১০ কোটি টাকা, নিরাপদডটকমের ৮ কোটি টাকা, চলন্তিকার ৩১ কোটি টাকা, সুপম প্রোডাক্টের ৫০ কোটি টাকা, রূপসা মাল্টিপারপাসের ২০ কোটি টাকা, নিউ নাভানার ৩০ কোটি টাকা এবং কিউ ওয়ার্ল্ড মার্কেটিংয়ের গ্রাহকদের ১৫ কোটি টাকা লোপাটের ঘটনা।
ওপরের অনুচ্ছেদটি প্রকাশিত সংবাদ থেকেই নেওয়া। দেখুন তবে, সর্বস্বান্ত হওয়ার শূন্য স্থানে বসানোর মতো কত নাম পাওয়া গেল! সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, কোনো ক্ষেত্রেই এসব হাজার হাজার কোটি টাকা আর তাদের প্রকৃত মালিকের পকেটে ফিরে যেতে পারেনি। ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকেরা বছরের পর বছর ধরনা দিয়েছেন, প্রতিবাদ-বিক্ষোভ জানিয়েছেন, কিন্তু টাকা উড়ে গেছে পাখা মেলে।
প্রশ্ন হলো, বছর কয়েকের ব্যবধানে বারবার এসব প্রতারণার ঘটনা ঘটলেও কেন মানুষ এদের ওপরই প্রাথমিক বিশ্বাস জলাঞ্জলি দেন? সংক্ষিপ্ত উত্তর হলো, বেশি লাভের লোভ। আমাদের পরিচিত অনেকেই এসবে পা দিয়েছেন। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাও আছে। এমন নয় যে তাঁরা শুধু লোভ করেছেন, সঙ্গে কিন্তু পরিশ্রমও ছিল। এমএলএম কোম্পানিতে নাম লেখানো এমন অনেক পরিচিতজনকেই দেখেছি নাওয়া-খাওয়া বাদ দিয়ে দিনরাত ‘হাত’ বাড়ানোর কাজে পরিশ্রম করতে। অন্যকে নিজের পথে নিয়ে আসাতেও তাঁদের জুড়ি মেলা ছিল ভার। ‘হাওয়াই’ গাছ কিনতে রাজি না হওয়ায় এক বন্ধুসম তো সেটিকে আমার জীবনের ‘সবচেয়ে বড় ভুল’ আখ্যা দিয়েছিলেন। সেই সঙ্গে এ ব্যাপারে তোলা কিছু প্রশ্নকে ‘অপপ্রচার’ বলে অভিহিত করেছিলেন। বলেছিলেন, অন্যের ভালো দেখতে না পারাই এসব প্রশ্নের মূল। যদিও পরবর্তী সময়ে সেই গাছ আর ফুলে-ফলে ভরে ওঠেনি কখনোই।
এ দেশের কিছু মানুষ নিজেদের ব্যক্তিগত উন্নতি চায় ঠিকই, তবে তা দ্রুততম সময়ে। আঙুল ফুলে কলাগাছ—এমন প্রবাদবাক্য বাংলায় তো এমনি এমনি তৈরি হয়নি। অর্থাৎ আঙুল ফুলিয়ে কলাগাছ বানানোর ইচ্ছা এ দেশের অনেক মানুষের মধ্যে বরাবরই নদীর মতো প্রবহমান। কখনো তাতে জল কমে, কখনো হয় উত্তাল জোয়ার। তবে এ সমাজে তা কখনো ‘মরা গাঙ’ হয় না। ইভ্যালির মতো এবারের অভিযুক্ত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোও সেই লোভকেই পুঁজি করেছে। দিয়েছে অবিশ্বাস্য কম দামে পণ্য কেনার সুযোগ। এখন কেউ যদি এক ফ্রিজের দামে দুটি ফ্রিজ পায়, তবে জিব কেন লকলকে হবে না, বলুন?
দুর্জনে বিশ্বাস স্থাপনের আরও দুটি কারণ আছে। প্রথমত, হনেওয়ালা দুর্জনকে কারা সুজন বলছে? দ্বিতীয়ত, কে দুর্জন, কে সুজন—সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরগুলো কী বলছে? ধরুন, আমজনতার কাছে জনপ্রিয় কোনো ব্যক্তিত্ব যদি প্রচারে অংশ নেন, তবে সাধারণ ভোক্তারা প্রলুব্ধ হন সহজেই। যদিও জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বরা বেলা শেষে বলতেই পারেন, তিনি স্রেফ বিজ্ঞাপন করেছিলেন। কিন্তু সেই বিজ্ঞাপনে তো আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপনের ডাকও কেউ কেউ দেন। আর জানা কথা যে আমরা কান কথায় কান দিই বেশি। ফলে চিলে কান নিয়েছে শুনলে চিলের পিছু নেওয়া মানুষের সংখ্যা নেহাত কম হবে না! এখন চিলের কান নেওয়ার আহ্বান জনপ্রিয় কেউ ঘোষণা করবেন কি না, তা ওই ব্যক্তির নৈতিক বিবেচনার ওপর কিছুটা নির্ভরশীল। যে দেশে যে চল, সেই ভাবনা মাথায় নিয়েই তো চলা উচিত, নাকি? অভিযোগের তির অহেতুক নিজের দিকে নেওয়ারই-বা দরকার কী?
দ্বিতীয় প্রসঙ্গে বলা যায়, এভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের লোভ দেখিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাটের সাহস দেখানোর পেছনে সরকারি দপ্তর ও সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যর্থতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নায়ক (বা খলনায়ক) মারপিট করে নায়িকাকে উদ্ধার করার পরই পুলিশ এসে বলেছে, ‘আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না!’ রোগী মারা যাওয়ার পর চিকিৎসক উপস্থিত হওয়ার এই রীতি এবারও চলমান। তা না হলে ২০১৮ সালে বিতর্কিত ব্যবসায়িক মডেলে চালু হওয়া প্রতিষ্ঠানের বিষয় নিয়ে কেন তিন বছর পর সত্যিকার অর্থে টনক নড়বে? এর অর্থ হলো, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাও নিশ্চয়ই কোনো না কোনো কারণে কাঠের চশমা পরে ছিলেন। সেটিও কি লোভসংক্রান্ত?
লোভ মনুষ্য জাতির অনেক পুরোনো প্রবৃত্তি। আদিকাল থেকেই এই প্রবৃত্তির ফাঁদে মানুষ বারবার হাত, পা ও মাথা দিয়েছে। লোভের দুষ্টচক্র সজীব করেই চলে সাধারণের হাজার হাজার কোটি টাকা মেরে দেওয়ার ধান্দা। বিতর্কিত উদ্যোক্তা, সাধারণ গ্রাহক, নিয়ন্ত্রক সংস্থা, প্রচারকারী—এরা সবাই এই লোভের দুষ্টচক্রের একেকটি উপাদান। শুধু এক পক্ষ কখনোই এই চক্র সচল রাখতে পারে না, প্রয়োজন হয় সবার সমান অংশীদারির। কেউ বুঝে অংশ নেন, কেউ অংশ নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর বুঝতে পারেন। এমন দুষ্টচক্রে ‘সরল বিশ্বাস’ স্থাপন করাই পাপতুল্য। এই দুষ্টচক্র পুরোপুরি ভেঙে দিতে পারলেই কেবল ‘পাপ’ ও ‘পাপে মৃত্যু’ ঠেকানো সম্ভব। নইলে ‘মৃত্যু’ শব্দটির জায়গায় অন্য নাম বসিয়ে যেতে হবে অদূর ভবিষ্যতেও।