প্রিজন ভ্যানের গ্রিলের ফাঁকে সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের মুখের ছবি দেখে মানুষ ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল। বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকে প্রিজন ভ্যানের ছবির পাশে রোজিনা ইসলামের স্বাভাবিক অবস্থার হাস্যোজ্জ্বল ছবি পোস্ট দেন। বুধবার রাতে অনেকে ঘুমোতে যাওয়ার আগে ফেসবুকের পোস্টে মুক্ত রোজিনা ইসলামকে দেখার প্রত্যাশা জানিয়েছিলেন। বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত ফেসবুক ব্যবহারকারী মানুষ সে আশাতেই ছিলেন। তবে দুপুরের পর চিত্র পাল্টাতে থাকে।
ফেসবুকে কার্টুন, ছবি বা পোস্টের ভাষায় ক্ষোভ জানাতে থাকেন। কেননা শেষ পর্যন্ত রোজিনা ইসলামের জামিন হয়নি। জামিনের আশায় থাকতে হবে আগামী রোববার পর্যন্ত।
প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলাম গত সোমবার দুপুরের পর পেশাগত দায়িত্ব পালনে সচিবালয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যান। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা তাঁকে একটি কক্ষে আটকে রাখেন। রাত পৌনে ১২টার দিকে তাঁর বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় মামলা করা হয়। মঙ্গলবার তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের করা মামলায় রোজিনা ইসলামের জামিন আবেদনের ওপর শুনানি হয়েছে আজ বৃহস্পতিবার। শুনানি শেষে জামিন নিয়ে আগামী রোববার আদেশ দেওয়া হবে বলে জানান আদালত।
আদালতে রোজিনা ইসলামের পক্ষে শুনানিকালে প্রথম আলো নিয়োজিত আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী বলেছেন, রোজিনা ইসলামের মামলাটি জামিনযোগ্য। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে আটক হওয়া রোজিনা ইসলামের জামিন পাওয়াটা তাঁর প্রতি কোনো দয়া, অনুগ্রহ, অনুকম্পা নয়। বরং জামিন পাওয়াটা তাঁর মৌলিক অধিকার।
গত সোমবার ঘটনার পর থেকে রোজিনা ইসলাম অসুস্থ হয়ে পড়েন। হাসপাতালে না নিয়ে সে অবস্থাতেই তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। গত সোমবার থেকেই ফেসবুকে এ ঘটনার উত্তাপ টের পাওয়া যাচ্ছে। ফেসবুক ব্যবহারকারীরা রোজিনা ইসলামের একমাত্র মেয়েটি মা ছাড়া এভাবে একা থাকছে, তা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেন। আজ জামিন না হওয়ায় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত শাহানা হুদা লিখেছেন, ‘রোজিনা ইসলামের জামিন বিষয়ে আদেশ রোববার। মানে আরও দুই দিন ঝুলায় দিল। আশ্চর্য। ওর মেয়েটার কী হবে?’
বর্তমানে প্রবাসে থাকা রুমানা রুমি লিখেছেন, ‘...যে শিশুটা আজ মায়ের পথ চেয়ে বসে বসে কাঁদছে, তার শাস্তি আপনারা পাবেনই। আপনাদের ধিক্কার জানাই আর রোজিনা ইসলামের মুক্তি চাই।’ সাংবাদিক ইয়াসমিন রিমু লিখেছেন, ‘এত ভয় কেন জামিন দিতে?’
আজ এক বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি আদালতে ভার্চ্যুয়াল শুনানি শেষে জামিন আদেশ পিছিয়ে আগামী রোববার পর্যন্ত দীর্ঘায়িত করার ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। ঢাকাসহ সারা দেশেই রোজিনা ইসলামের মামলা প্রত্যাহার করে নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে আন্দোলনও চলছে। একই সঙ্গে ফেসবুকেও উত্তাপ বাড়ছে।
সোমবার থেকে বুধবার পর্যন্ত ফেসবুকে রোজিনা ইসলামের মুক্তি, গণমাধ্যমের স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন আলোচনা গুরুত্ব পেয়েছে। এ আলোচনায় অংশ নিয়েছেন বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ। তবে বৃহস্পতিবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল জামিন না হওয়ার বিষয়টি।
গণমাধ্যমকর্মী প্রভাষ আমিন লিখেছেন, ‘রোজিনার জামিন রোববার পর্যন্ত ঝুলিয়ে রাখা অবিশ্বাস্য, দুর্ভাগ্যজনক।’ আর জাহেদুল আহসান ফেসবুকে লিখেছেন, ‘শেষ পর্যন্ত রোজিনা ইস্যুতে প্রতিহিংসারই প্রকাশ পেল।’ চ্যানেল আইয়ের সাংবাদিক ফাহমিদা আখতার লিখেছেন, ‘আরও দুই দিনের অপেক্ষায় রাখা হলো...।’
ফেসবুকের প্রোফাইল পিকচার বা ছবির ফ্রেমেও বদল ঘটেছে। প্রোফাইল পিকচার আপডেট করার ফ্রেমে লেখা, ‘জাস্টিস ডিলেইড ইজ জাস্টিস ডিনাইড।’
সাংবাদিক ইরানী বিলকিস খান লিখেছেন, ‘যেখানে বিশেষ আদালতে স্বসম্মানে জামিন দেওয়ার কথা ছিল, মামলা প্রত্যাহার করার কথা ছিল, সেখানে রোববার পর্যন্ত জামিনটাই ঝুলিয়ে দেওয়া হলো, অথচ খুনের আসামিও আগাম জামিন পায়।’ সাংবাদিক মহসিনুল করীম লিখেছেন, ‘দুঃখিত, সব প্রক্রিয়া শেষেও রোজিনার জামিন আদেশের জন্য আগামী রোববার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে...।’
গণমাধ্যমকর্মীদের আমাদের গণমাধ্যম-আমাদের অধিকার-অনলাইন গ্রুপে মৌসুমী আচার্য লিখেছেন, ‘ভবিষ্যতে প্রেসনোটের বাইরে যেন কোনো সাংবাদিক একটা শব্দও না লিখেন, সেই শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। চেপে ধরা গলা, হাতে হাতকড়া, চৌদ্দ শিকের পেছনে বসবাস...আর করবেন কেউ সাংবাদিকতা?’
ব্রিটিশ আমলের আইনে সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা, জামিন না দিয়ে কারাগারে রাখা, জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়া...এ বিষয়ে বর্তমানে প্রবাসী মাহবুব স্মারক সূর্য সেন আর প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের সাক্ষাৎকার নিতে চান বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এই দুজনের সাক্ষাৎকার নেওয়ার সুযোগ থাকলে তিনি ‘কেন তাঁরা প্রাণ দিয়েছিলেন’, সে প্রশ্ন করতেন বলে ফেসবুকে লিখেছেন।
সাংবাদিক মঞ্জুরুল করিম লিখেছেন, ‘সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম জামিন পেয়ে বেরিয়ে এলে কি তাঁর মুখ থেকে আরও অনেক কিছু জানা যাবে? তিনি যদি নির্দোষ হন, তাহলে কি দোষীদের বিচার শুরু হবে?’
আর দীপায়ন খিসা লিখেছেন, ‘আমলাতন্ত্র জলে, স্থলে, অন্তরিক্ষে বিরাজমান।...সুতরাং সবকিছুই বিলম্বিত হবে। আন্দোলন জারি রাখা অতি আবশ্যক।’
তবে আজ দুপুরের পর থেকে ফেসবুকেই কেউ কেউ রোজিনা ইসলামের জামিন হয়েছে এমন পোস্টও দেন। তবে নিজেরাই রোজিনা ইসলামকে জামিন দিয়ে ফেসবুক কাঁপিয়ে দেওয়া ব্যক্তিদের পোস্টে অনেকে প্রতিবাদও করেছেন।
রোজিনা ইসলামের বিষয়টি আন্তর্জাতিক অঙ্গনের দৃষ্টি আকর্ষণে ফেসবুকে ইংরেজিতে পোস্ট দেওয়ার পাশাপাশি টুইটার ব্যবহারের তাগিদও দিচ্ছেন গণমাধ্যমকর্মীরা।