রেস্তোরাঁশিল্পের বদলে যাওয়া
নিউইয়র্কের কুইনসের এস্তোরিয়া এলাকায় বেয়ারবার্গার নামে নতুন একটি বার্গারের দোকান খোলা হয়েছে। সেখানে একটি কাজের আশায় হাজির হয়েছে ১৭ বছরের এক অভিবাসী কিশোর। তার জন্ম বাংলাদেশের চট্টগ্রামে হলেও ৭ থেকে ১৪ বছর পর্যন্ত তার কেটেছে কুয়েতে। ইংরেজিতে খুব একটা সড়গড় নয়। পড়ে ব্রায়ান্ট হাইস্কুলে। তারপরও রেস্তোরাঁয় চেয়ার-টেবিল পরিষ্কারের কাজ জুটে গেল। দিনভর কাজ আর অবসর সময়ে মার্টিন স্কোরসিসের মাফিয়া সিনেমা দেখে ইংরেজি শেখা। সঙ্গে চোখ–কান খোলা রাখা। ছোটবেলা থেকে ডিজাইন নিয়ে আগ্রহ থাকলেও বাবার ইচ্ছায় চিকিৎসক হওয়ার চেষ্টা করেছেন। এ জন্য স্কুল শেষে সিরাকিউস বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাক্-মেডিকেলে ভর্তি হন। কিন্তু এক সেমিস্টার বাকি থাকতে পুরোপুরিভাবে বেয়ারবার্গারে আত্মনিয়োগ করেন। প্রথমে ছিলেন বেয়ারবার্গারের টেবিল পরিষ্কারক। তবে ১০ বছরের মাথায় এই অভিবাসী বাঙালি তরুণ প্রতিষ্ঠানটির প্রধান বিপণন কর্মকর্তা হয়ে গেলেন।
নাবীল আলমগীর
উদ্যোক্তা
জন্ম
১৯৯২ চট্টগ্রাম
পড়াশোনা
সিকারিউস বিশ্ববিদ্যালয়ে
প্রাক্–মেডিকেল (ড্রপআউট), কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবস্থাপনায় লেখাপড়া
প্রিয় রেস্তোরাঁ
সিভা, কুইনস, নিউইয়র্ক
(ভারতীয় খাবারের রেস্তোরাঁ)
অর্জন
ফোর্বস সাময়িকীতে উত্তর আমেরিকার
‘থার্টি আন্ডার থার্টি ২০২১’
তালিকায় স্থান
একেবারে শুরু থেকে বেয়ারবার্গারকে বিকশিত হতে দেখে ওই তরুণ দ্রুতই বুঝে গেলেন রেস্তোরাঁ ব্যবসার মূল সমস্যা। কারণ, তত দিনে আবির্ভূত হয়েছে উবার ইটস বা গ্রাবারগ্রাবের মতো মার্কেটপ্লেস। বেয়ারবার্গারও অনলাইনে অর্ডার পেতে সেখানেই নির্ভরশীল হয়ে পড়ল। কিন্তু ওই অ্যাপগুলো প্রতি অর্ডারে ১৫ থেকে ৩০ শতাংশ কমিশন নিয়ে নেয়। এ যেন ‘লাভের গুড় পিঁপড়ার খেয়ে নেওয়া।’ অভিবাসী বাঙালি যুবক খুঁজে বের করলেন, ভিন্ন কোনো পন্থায় এই বিপদ থেকে রেস্তোরাঁগুলোকে বের করে আনতে হবে। আর সেটা করার জন্য চাকরি ছেড়ে আরও চার বন্ধুকে নিয়ে ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠা করলেন ‘লাঞ্চবক্স’ নামের প্রতিষ্ঠান। এর উদ্দেশ্য সহজ, রেস্তোরাঁ ও গোস্ট কিচেনগুলোকে একটা প্ল্যাটফর্ম দেওয়া, যেখানে উভয় পক্ষেরই জিত হবে। অর্ডারপ্রতি কমিশনের বদলে হলো মাসিক চাঁদার গ্রাহক পদ্ধতি। এ ছাড়া রেস্তোরাঁর ডিজিটালাইজেশনের জন্য অন্যান্য পদ্ধতি—যেমন রেস্তোরাঁর ইন-স্টোর অর্ডার সিস্টেম, অ্যাপ, ওয়েবসাইটসহ গ্রাহক রিলেশনশিপ ব্যবস্থাপনার সেবাও যুক্ত করলেন।
করোনার পর রেস্তোরাঁতে বসে খাওয়ার সুযোগ যখন একেবারেই বন্ধ হয়ে গেল, তখনই বোঝা গেল রেস্তোরাঁগুলো বাঁচাতে তৃতীয় পক্ষীয় অ্যাপগুলোর বিকল্প দরকার। সেই সম্ভাবনা দেখা গেল ‘লাঞ্চবক্স’–এ। তাই প্রথমে ২ মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগের পরপরই সিরিজ এ-তে লাঞ্চবক্স পেল ফুড-টেক স্টার্টআপের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ—২০ মিলিয়ন ডলার। আর এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত অভিবাসী নাবীল আলমগীরকে ফোর্বস সাময়িকী নির্বাচিত করল তাদের উত্তর আমেরিকার ‘৩০-এর নিচে ৩০’-এর তালিকায়।
জীবনের কঠিন বাস্তবতায় শৈশবেই কর্মজীবনে প্রবেশের সুবাদে নাবীল রেস্তোরাঁ খাতের অনলাইন অর্ডার, মার্কেটিং ম্যানেজমেন্ট এবং ডেলিভারি সিস্টেমের সমস্যাগুলোকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন। আর তার সমাধানও বলতে গেলে একের ভেতর অনেক। লাঞ্চবক্সের গ্রাহকেরা আগে ভিন্ন ভিন্ন কোম্পানির সেবা নিত। এখন এক জায়গাতেই সব পাচ্ছেন। লাঞ্চবক্স রেস্তোরাঁ মালিকদের অর্থ অপচয় কমানোর সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের আয়ও বাড়িয়েছে। ভোক্তাদের কাছ থেকে লাঞ্চবক্সে আসা প্রতি ১০০ ডলারের বিপরীতে রেস্তোরাঁগুলো এখন আয় করতে পারে ২৫ ডলার। প্রচলিত অ্যাপে তা হতো মাত্র ৫ ডলার! লাঞ্চবক্সের গ্রাহকদের মধ্যে আছে নাবীলের চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠান বেয়ারবার্গার, মেক্সিক্যু, ক্লিন জুস, জেরোস ফ্যামিলি বেকারি, স্টিকিস ফিঙ্গার জয়েন্ট, ফুকুসহ আরও অনেক রেস্তোরাঁ। সফটওয়্যার এজ এ সার্ভিস (এসএএএস) হিসেবে লাঞ্চবক্স এই সেবাগুলো দেয়।
লাঞ্চবক্সের আগে নাবীল ব্যর্থ হয়েছেন দুটি স্টার্টআপে, কিন্তু আশাহত হননি। এর প্রথমটি ছিল ‘লিনিট’ (লাস্ট+মিনিট থেকে) নামের একটি অ্যাপ, যেখান থেকে জানা যেত শহরের কোথায় পার্টি হচ্ছে। দ্বিতীয়টি ‘টাফ্ট’ নামে একটি সামাজিক বুলেটিন বোর্ড। আর ২০১৯ সালে ২ মিলিয়ন ডলারের মূলধন অর্থায়নের আগে ৭২ জন বিনিয়োগকারী তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেছিল।
বছর দুয়েক আগে মাত্র ১০ জনের দল নিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল লাঞ্চবক্সের। এখন সেই দলটি ১৬০ জনে এসে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এই অভিবাসী তরুণের সফলতার সূত্র কী, তা উল্লেখ করে লেখাটির ইতি টানব।
পাওলো কোয়েলোহোর দ্য আলকেমিস্ট বইয়ে উল্লিখিত ‘মক্তব’, বাংলায় যার অর্থ হলো ‘লিখিত’, সেটাই হলো নাবীল আলমগীরের জীবনের ধ্রুবতারা, সাফল্যের সূত্রও বটে। এটা তিনি নিজের হাতের ওপরে ট্যাটু করে রেখেছেন। নাবীল মনে করেন, সব মানুষই তার নিজের ভাগ্যের লেখক। যে জীবন আমরা লিখি বা সৃষ্টি করি, তা–ও আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি।
মো. রাশেদুর রহমান: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক; ইনোভেশন, ক্রিয়েটিভিটি অ্যান্ড এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ সেন্টারের নির্বাহী পরিচালক