রাজশাহীতে আটজনের রগ কেটেছে শিবির

সাড়ে তিন বছরের হিসাব
সাড়ে তিন বছরের হিসাব

ফারুক মরে গিয়ে বেঁচে গেছে। আর আমি বেঁচে আছি মরার মতো।’ বলছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক কর্মী সাইফুর রহমান বাদশা। সাড়ে তিন বছর আগে এক রাতে ইসলামী ছাত্রশিবিরের নির্মমতার শিকার হয়ে এখনো যন্ত্রণাকাতর জীবন কাটাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘দুই হাত ও পায়ের রগ কাটার পর মাথায় চাপাতি দিয়ে কোপ দিয়ে ওরা যখন ফেলে যায়, বাঁচব বলে ভাবিনি।’শুধু সাইফুরই নন, গত সাড়ে তিন বছরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও এর আশপাশের এলাকায় তাঁর মতো অন্তত আটজনের হাত-পায়ের রগ কেটে দিয়ে পঙ্গুত্বের দিকে ঠেলে দিয়েছে ছাত্রশিবিরের দুর্বৃত্তরা। শিবিরের বর্বরতার সর্বশেষ শিকার হলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম তৌহিদ আল হোসেন ওরফে তুহিন। ২২ আগস্ট রাতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অতর্কিত হামলা চালিয়ে তুহিনের হাত ও পায়ের রগ কেটে দেয় দুর্বৃত্তরা। একই সঙ্গে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর আহত করা হয় তাঁকে। তুহিনের জীবন শঙ্কামুক্ত হলেও পঙ্গুত্বের আশঙ্কা এখনো কাটেনি বলে চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন। জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠন ছাত্রশিবির বিগত শতাব্দীর আশির দশকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রগ কাটার রাজনীতি শুরু করে বলে জানা গেছে। মাঝে তাদের রগ কাটা বন্ধ থাকলেও ২০১০ সাল থেকে আবার শুরু হয়। ওই বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃশংস এক হামলা চালান শিবিরের কর্মীরা। তাঁরা ছাত্রলীগের নেতা ফারুক হোসেনকে কুপিয়ে হত্যা করে লাশ শাহ্ মখদুম হলসংলগ্ন ম্যানহোলের মধ্যে ফেলে দেন। ওই রাতে ছাত্রলীগের কর্মী সাইফুর রহমান বাদশা, ফিরোজ মাহমুদ, আরিফুজ্জামান ও শহিদুল ইসলামের হাত-পায়ের রগ কেটে দেয় শিবির।

পরে বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর পাস করা সাইফুর রহমান এখনো স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারেন না। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘শরীরের কাটা দাগগুলো দেখে এখনো আঁতকে উঠি। ব্যথার যন্ত্রণায় রাতে ঘুমাতে পারি না। শিবিরের নৃশংসতা কেড়ে নিয়েছে আমার সব স্বপ্ন। পড়াশোনা শেষ করে কোনো চাকরিও জোগাড় করতে পারিনি। বৃদ্ধ বাবার পেনশনের টাকায় এখনো চিকিৎসা করাতে হচ্ছে।’

গত বছরের ২১ নভেম্বর চোরাগোপ্তা হামলার শিকার হন ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার তৎকালীন সহসভাপতি আখেরুজ্জামান তাকিম। তাকিমকে কুপিয়ে গুরুতর জখম করার পর তাঁর এক পা ও এক হাতের রগ কেটে দেন দুর্বৃত্তরা। এ হামলার জন্য ছাত্রশিবিরকেই দায়ী করে ছাত্রলীগ।

তাকিম জানান, তিনি এখনো স্বাভাবিক চলাফেরা করতে পারেন না। হাঁটতে গেলে ব্যথা করে বাঁ পা। আর শরীরের বিভিন্ন স্থানের ক্ষতগুলো যন্ত্রণা দেয়।

চলতি বছরের ১৭ মার্চ রাতে বিশ্ববিদ্যালয়-সংলগ্ন বিনোদপুর এলাকায় ৩০ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলামের বাড়িতে হামলা চালায় শিবির। তারা শহিদুল ইসলামের হাত-পায়ের রগ কেটে দেয়। ওই হামলায় আওয়ামী লীগের সদস্য মাইনুল হোসেন ও যুবলীগের নেতা রুহুল আমিনকে কুপিয়ে জখম করা হয়।

শহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ডান পায়ের গোড়ালি থেকে নিচ পর্যন্ত কোনো অনুভূতি নেই। বাঁ পায়ে ৩৫টি সেলাই দেওয়া হয়েছে। হাঁটতে গেলে পা ফুলে যায়, রাতে প্রচণ্ড ব্যথা করে। চিকিৎসকেরা বলেছেন, আরেকবার অস্ত্রোপচার করা লাগবে।’

এরপর গত ১৪ এপ্রিল রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের মেহেরচণ্ডী এলাকায় চোরাগোপ্তা হামলার শিকার হন রাজশাহী জেলা ছাত্রলীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক হাবিবুর রহমান। হামলাকারীরা তাঁর বাঁ পা ও ডান হাতের রগ কেটে দেয়। পরবর্তী সময়ে হাবিবুরের ডান পায়ের হাঁটু পর্যন্ত কেটে ফেলতে হয়েছে। সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হাবিবুরের চলাফেরার ভরসা এখন ক্রাচ। ছাত্রলীগ এ ঘটনার জন্য শিবিরকে দায়ী করেছে।

হাবিবুর বলেন, ‘দল থেকে কৃত্রিম পা সংযোজনের জন্য আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো নিশ্চয়তা পাইনি।’

এ ছাড়া গত বছরের ১১ অক্টোবর ছাত্রলীগের কর্মী ইমরান হোসেন ও ২৪ অক্টোবর ছাত্রলীগের নেতা মাহবুব আলমকে কুপিয়ে জখম করা হয়েছিল। এসব ঘটনায় ছাত্রলীগ নেতারা শিবিরকেই দায়ী করছেন।

জানতে চাইলে রাজশাহী মহানগর পুলিশের উপকমিশনার শাহ গোলাম মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক রগ কাটার মতো এসব নৃশংস হামলার বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ছাত্রশিবিরের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে।

এ ব্যাপারে শিবিরের বক্তব্য জানার জন্য বারবার চেষ্টা করেও সংগঠনের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি আশরাফুল আলম ও ভারপ্রাপ্ত প্রচার সম্পাদক জিয়াউদ্দিন বাবলুর মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

ছাত্রলীগের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সদ্য সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবু হুসাইন অভিযোগ করেন, একমাত্র ছাত্রশিবিরের ক্যাডাররা রাতের অন্ধকারে চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে প্রতিপক্ষ সংগঠনের নেতা-কর্মীদের হত্যা ও পঙ্গু করে দেয়। তাঁর দাবি, শিবির কোনো ছাত্র সংগঠন নয়, এটি একটি জঙ্গি সংগঠন।