রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় পাহাড়ে অবৈধ ও ঝুঁকিপূর্ণ বসতি
চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন পাহাড়ে দিন দিন অবৈধ ঝুঁকিপূর্ণ বসতি বাড়ছে। পাহাড় কেটে গড়ে তোলা এসব বসতিতে মূলত ছিন্নমূল ও নিম্ন আয়ের লোকজনের বসবাস। তবে এই পাহাড় দখলের নেপথ্যে রয়েছেন অনেক রাজনীতিক। পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির বিভিন্ন সভায় এ নিয়ে আলোচনাও হয়। কিন্তু প্রতিবছর বর্ষায় ঝুঁকিপূর্ণ বসতি উচ্ছেদ কিংবা সেবা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেই দায় সারে কর্তৃপক্ষ।
অভিযোগ উঠেছে, পাহাড় কাটা ও দখলের নেপথ্যে থাকা রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। নেপথ্যে থাকা এসব নেতার তালিকাও করা হয়নি। বরং তাঁদের ইশারায় ২০১৮ সালে মতিঝরনায় উচ্ছেদ অভিযানে বাধা দিয়েছিলেন স্থানীয় লোকজন।
যথারীতি প্রতিবছর বর্ষা এলে প্রশাসনের তোড়জোড় শুরু হয়। কিন্তু বাসিন্দারা কোনোভাবে বসতি ছাড়তে রাজি নন। ফলে পাহাড়ধসে প্রাণহানির ঘটনা চলছে। ২০০৭ থেকে এ পর্যন্ত পাহাড়ধসে কমপক্ষে ৪০০ জনের মৃত্যু হয়েছে। সবশেষ ২০ জুন ভোরে চশমা পাহাড়ের একাংশ ভেঙে এক কিশোর মারা যায়। এর আগে ১৭ জুন রাতে ফিরোজশাহ এলাকায় পৃথক পাহাড়ধসে চারজনের মৃত্যু হয়।
২০১৮ সালে ১৮ এপ্রিল ব্যবস্থাপনা কমিটির ১৮তম সভায় জানানো হয়, পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে ৬৮৪টি পরিবার। বর্তমানে তা বেড়ে চার হাজারের বেশি হয়েছে বলে গত সপ্তাহে অনুষ্ঠিত সবশেষ সভায় জানানো হয়। এর মধ্যে রেলওয়ের পাঁচ পাহাড়ে রয়েছে তিন হাজারের বেশি ঝুঁকিপূর্ণ অবৈধ বসতি। তবে পাহাড়ে মোট অবৈধ বসতির হালনাগাদ কোনো তথ্য নেই। তাই বসতির তালিকা আবার হালনাগাদ করার সিদ্ধান্ত হয় সভায়।
জানতে চাইলে রেলওয়ের প্রধান ভূসম্পত্তি কর্মকর্তা সুজন চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের পাহাড়ে তিন হাজারের বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বসতি রয়েছে। অনেকবার উচ্ছেদের উদ্যোগ নিয়েও মামলাসহ নানা কারণে করা যায়নি। স্থানীয় একটি সুবিধাভোগী পক্ষ আছে। তারা এসব বাসিন্দার শেল্টার দেয়। নইলে কি এত বড় সরকারি জায়গা দখল করা ছিন্নমূলদের পক্ষে সম্ভব?’
২০০৭ সালের ভয়াবহ পাহাড়ধসে ১২৭ জন মারা যাওয়ার পর গঠিত তদন্ত কমিটি ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে ৩৬টি সুপারিশ করেছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে— বিভিন্ন সমিতির নামে পাহাড় ইজারা বা দখল করে যাঁরা পাহাড় ধ্বংস করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি ব্যবস্থা গ্রহণ। এ ছাড়া প্রভাবশালী ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর দুর্বৃত্তায়ন কঠোরহস্তে নিয়ন্ত্রণেরও সুপারিশ ছিল।
অবৈধ দখল সম্পর্কে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক হিল্লোল বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, এটা দীর্ঘদিনের সমস্যা। এর পেছনে অনেক বিষয় জড়িত। এটার স্থায়ী সমাধান করতে হলে শুধু প্রশাসনিক নয়, দরকার সমন্বিত উদ্যোগ।
রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় বসতি
চট্টগ্রাম নগরের পূর্ব ফিরোজশাহ এলাকার ১, ২ ও ৩ নম্বর ঝিলে বসতির সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। রেলওয়ের পাহাড়ে এই বসতি গড়ে উঠেছে। বর্তমানে এই তিনটি ঝিলের মহল্লা কমিটির সভাপতি হিসেবে রয়েছেন নুরুল ইসলাম। তিনি স্থানীয় ৯ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য।
এই কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জহুরুল ইসলাম। পাঁচ বছর আগে তিনি ১ নম্বর ঝিল বহুমুখী সমবায় সমিতি নামে একটি সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। মূলত জহুরুলই ৯ নম্বর উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের অবৈধ বসতিগুলোর মূল নিয়ন্ত্রক বলে অভিযোগ রয়েছে।
তিনটি ঝিলের পাশে জিয়া নগর, মুজিব নগর ও বিজয় নগর নামে আরও তিনটি পাহাড়ে অবৈধ বসতি রয়েছে। এখানেও বসতির সংখ্যা পাঁচ হাজারের মতো। এসবের নিয়ন্ত্রণও জহুরুলের হাতে বলে অভিযোগ রয়েছে। ১ নম্বর ঝিলে অবৈধ বাসিন্দাদের সুবিধার্থে তিনি সিটি করপোরেশনের সহায়তায় আরসিসি ঢালাই করে রাস্তা নির্মাণ করে দেন।
অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জহুরুল প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওয়ার্ডের বেশির ভাগ বাসিন্দা বস্তিবাসী। রেলওয়ের পাহাড়ে তাঁরা রয়েছেন। এত মানুষকে কোথায় পুনর্বাসন করা হবে? তাঁদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কেবল ভোটের।’
জহুরুল বলেন, ‘ওয়ার্ডের মোট ভোটার ৮০ হাজারের মধ্যে ৫০ হাজারই পাহাড়ে থাকেন। জনপ্রতিনিধি হিসেবে আমি তাঁদের সুখ–দুঃখের বিষয় দেখি। কিন্তু অবৈধ দখলের সঙ্গে আমার কোনো হাত নেই।’
সরেজমিনে ১ নম্বর ঝিলে দেখা গেছে, সেখানে পাহাড় কেটে সেমিপাকা ও কাঁচা বাসার পাশাপাশি দ্বিতল ভবনও রয়েছে। কোনো ভবনের অনুমোদন নেই। আবার এখানে বিদ্যুৎ এবং ওয়াসার পানি সংযোগও দেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, রেলওয়ের পাহাড় দখল করে এখানে ধীরে ধীরে বসতি গড়ে ওঠে। দখলস্বত্ব বেচাকেনা হয় এক থেকে পাঁচ লাখ টাকায়। ঝিলের শেষ মাথায় ১৭ জুন ফজল হকের যে বাসায় পাহাড়ধস হয়েছে, সেখানে তাঁরা বসবাস করছিলেন ১৫ বছর ধরে।
জানতে চাইলে মহল্লা কমিটির সভাপতি নুরুল ইসলাম বলেন, ‘ঝিলের এই জায়গা নিয়ে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমার হাইকোর্টে মামলা চলছে। এখানে যাঁরা আছেন, তাঁরা কেউ ভাড়া কেউ আবার কারও কাছ থেকে দখল কিনে বসবাস করছেন। এ জন্য কিছু টাকার লেনদেন হয়। বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগও রয়েছে।’
চশমা পাহাড়ের গ্রিনভ্যালি আবাসিক এলাকার পাশে যে পাহাড়ধস হয়েছে, তার নিয়ন্ত্রণে রয়েছেন যুবলীগ নেতা আবদুল্লাহ আল মামুন। তাঁর বিরুদ্ধে সেখানে পাহাড় কেটে বসতি গড়ে তোলার অভিযোগ রয়েছে। তাঁদের কিছু ভাড়াঘরও রয়েছে পাহাড়ের খাঁজে।
মামুন কেন্দ্রীয় যুবলীগের সাবেক উপসমবায়বিষয়ক সম্পাদক। অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে তাঁর মুঠোফোনে কল দেওয়া হয়। তবে প্রতিবেদকের পরিচয় পেয়ে তিনি ফোন কেটে দেন।
পাহাড়ের অবৈধ বসতি ও ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসের বিষয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান বলেন, একদিকে উচ্ছেদ করা হয় তো আবার গিয়ে তাঁরা বসতি গড়ে তোলেন। তাঁদের পেছনে আরও অনেকে রয়েছেন। কিন্তু যেসব সংস্থার পাহাড়, যাদের পাহাড়; তাদের কোনো খবর নেই। যাদের পাহাড়, তাদেরও এ সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে।