ভবনটির কাছে গিয়ে চমকে উঠলাম। কাগজের ঠোঙার মতো দুমড়ে-মুচড়ে গেছে ভবনটি। নয়তলা ভবনের প্রতিটি তলা যেন পাউরুটির টুকরার মতো একটি আরেকটির গায়ে লেপ্টে আছে। তার ভেতর থেকে ভেসে আসছে আর্তনাদ। ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে বের করে আনা হচ্ছে থেঁতলে যাওয়া রক্তাক্ত মানুষের দেহ। আমি সেখানে পৌঁছানোর একটু আগে ফায়ার ব্রিগেডের সদস্যরা এসেছেন। হাজার হাজার মানুষ প্রাণপণে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন উদ্ধারকাজে।
বলছি ২৪ এপ্রিলের কথা। সকাল পৌনে নয়টায় প্রধান আলোকচিত্রী জিয়া ইসলামের ফোন পেয়ে আমার ঘুম ভাঙে। তিনি জানান, সাভার বাসস্ট্যান্ডের কাছে একটি ভবন ধসে পড়েছে। ঘটনার ভয়াবহতা বুঝতে পারি। স্পেকট্রাম আর তাজরীন ফ্যাশনসের অ্যাসাইনমেন্ট কভার করার অভিজ্ঞতা আমার আছে। এ রকম সংবাদে এক মিনিট দেরি মানে অনেক দেরি। চোখে কোনো রকমে একটু পানি ছিটিয়ে মোটরবাইক নিয়ে ছুটছি। ৩০ থেকে ৩৫ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে যাই সাভারের ঘটনাস্থলে। প্রখর রোদ। গা বেয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে।
ছবি তুলছি উদ্ধারকাজ আর ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়া বিপন্ন মানুষের। স্বজনদের আহাজারি। জীবন-মৃত্যুর দোলাচলে আটকে থাকা শ্রমজীবী মানুষের অসহায়ত্ব আর আকুতি দেখে বুকের ভেতরটা হাহাকার করে ওঠে। মৃত্যুফাঁদে আটকে পড়া মানুষের ছবি তোলা সত্যি কঠিন। আবার যখন জীবিত কাউকে উদ্ধার করা হয়, তখন সবার মতো আমারও চোখে আনন্দাশ্রু। এক অদ্ভুত শিহরণের মধ্য দিয়ে কেটে যায় সারাটা দিন।
এ রকম বিশাল ঘটনার ফলোআপ চলে ১৪ মে উদ্ধার অভিযান আনুষ্ঠানিকভাবে সমাপ্ত হওয়ার আগপর্যন্ত। প্রথম আলোর সংবাদচিত্রীরা (জিয়া ইসলাম, মনিরুল আলম, জাহিদুল করিম, হাসান রাজা, সাজিদ হোসেন, খালেদ সরকার, সৈকত ভদ্র) পালা করে ছবি তুলেছি রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির।
২৬ এপ্রিলের সকাল। আমার চোখ খুঁজে ফেরে মৃত্যুকূপে প্রাণের স্পন্দন। রানা প্লাজার পাশের ভবনের সিঁড়ি বেয়ে তৃতীয় তলায় উঠতেই ধ্বংসস্তূপের ভেতরে দেখি কয়েকটি হাত। অন্ধকারের ভেতর ইট-সুড়কির ফাঁক গলে একটু আলো এসে পড়েছে একটি হাতের ওপর। এটি একজন নারীশ্রমিকের হাত। প্রাণবায়ু বেরোনোর আগে হাতটা হয়তো বাঁচার আকুতি জানিয়েছিল। প্রায়ান্ধকার আলোয় হাতটার ছবি তুলি।
রানা প্লাজা থেকে লাশ এনে সারি সারি রাখা হয় অধরচন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠে। এখানে স্বজনহারা মানুষের ভিড়। যাঁরা চিরজনমের মতো মমতার বন্ধন ছিঁড়ে চলে গেছেন, তাঁদের জন্য প্রিয়জনের গগনবিদারী কান্না। নিখোঁজ ব্যক্তিদের সন্ধান চেয়ে লিফলেটে ভরে গেছে বিদ্যালয়ের দেয়াল, ফটক। ক্যামেরা দেখলেই ‘সন্ধান চাই’ প্ল্যাকার্ড নিয়ে এসে ভিড় করে নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনেরা। বাবা-মায়ের খোঁজ নিতে অভিভাবকদের সঙ্গে আসে অবুঝ শিশুরা। রানা প্লাজা কিংবা অধরচন্দ্র বিদ্যালয়ের মাঠ—লাশের দুর্গন্ধে দাঁড়ানো যায় না। দুর্গন্ধ এড়াতে ছিটানো হয় এয়ার ফ্রেশনার। দুর্গন্ধের সঙ্গে সুগন্ধির মিশেলে উৎকট গন্ধ তৈরি হয়।
২৮ এপ্রিল শাহীনা নামের এক নারীশ্রমিককে জীবিত উদ্ধারের অভিযান চলছে। সকাল থেকেই ক্যামেরা তাক করে বসে আছি। আমার আশপাশে অনেক ফটোসাংবাদিক। দুপুর গড়িয়ে বিকেল, এরপর সন্ধ্যা। শাহীনাকে উদ্ধার করা যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ পরপর আমাদের জানানো হয়, একটু পর উদ্ধার করা যাবে তাঁকে। আমরা উদ্ধারকাজে অংশ নিইনি ঠিকই, কিন্তু মানসিকভাবে জড়িয়ে পড়েছি উদ্ধারকাজে। রাত ১০টার পর ঘটে দুর্ঘটনা। ভেতরে আগুন ধরে যায়। শাহীনাকে আর জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। আমার চোখ ছলছল করে ওঠে। আমার আশপাশের সব ফটোসাংবাদিকের চোখে বেদনার ছাপ।
শিল্পকারখানার ভবনধসের ক্ষেত্রে এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা। বাংলাদেশের পোশাক খাতে এত প্রাণহানির ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি। সেই ভবনধসের ১০০ দিন পার হলো গত ২ আগস্ট। সেদিন গিয়ে দেখি ভিন্ন চিত্র। ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে ফেলার পর রানা প্লাজা যেন কাঁটাতারের বেড়ায় ঘেরা এক বিরানভূমি। প্রাত্যহিক জীবনের ব্যস্ততায় ফিকে হতে চলছে সেদিনের বীভৎসতা। অথচ স্বজনহারা মানুষের হাহাকারে এখনো ভারী হয়ে আছে সেখানকার বাতাস।
সাহাদাত পারভেজ: জ্যেষ্ঠ ফটো সাংবাদিক