মার্কিন দূতাবাস বলছে প্রতিবেদন বস্তুনিষ্ঠ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন তথ্যবিভ্রাট
বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনকে বস্তুনিষ্ঠ, পুঙ্খানুপুঙ্খ ও ন্যায্য বলে দাবি করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ঢাকা দূতাবাস। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম ও নির্যাতনের মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রতি সরকার আদতে শ্রদ্ধাশীল নয়।
গতকাল মঙ্গলবার প্রকাশিত ওই প্রতিবেদন নিয়ে বুধবার ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন কর্মকর্তারা। তাঁরা বলেন, দেশভিত্তিক এসব প্রতিবেদন বাস্তবভিত্তিক। পররাষ্ট্র দপ্তর এই প্রতিবেদন চূড়ান্ত করতে গোটা বিশ্বে তাদের যতগুলো মিশন আছে, সেগুলোকে কাজে লাগিয়েছে। পররাষ্ট্র দপ্তর এবং যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ভেতরে যত বিশেষজ্ঞ আছেন, তাঁদের সঙ্গে কথা বলেছে। আলাদাভাবে এই প্রতিবেদন চূড়ান্ত করায় অবদান রেখেছেন শ্রম অধিকার, পুলিশ ও নিরাপত্তা এবং নারী অধিকারবিষয়ক বিশেষজ্ঞরা। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও বেসরকারি সংস্থাগুলো থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রতিটি তথ্য একাধিক সূত্র থেকে যাচাই-বাছাই করা হয়েছে।
তবে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, মার্কিন প্রতিবেদনে তথ্যবিভ্রাট ঘটেছে। এই বক্তব্যের পক্ষে যুক্তি দিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রথম কথা হলো এই অভিযোগটা বোধ হয় ২০২১-এর, ২০২২-এর নয়। ২০২১-এ যে পরিমাণ গুম-খুনের কথা এখানে বলা হচ্ছে, আমাদের রেকর্ডে সে পরিমাণ নেই। আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বারা যদি কেউ বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন, নিরাপত্তা বাহিনী আত্মরক্ষায় যদি গুলিও করে, তাহলে প্রতিটি ঘটনায় একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তদন্ত করেন। এতে যদি ঘটনার সত্যতা প্রমাণিত হয়, তাহলেই আমরা সেই বিষয় ক্লোজ করে দিই। আর যদি ম্যাজিস্ট্রেট মনে করেন এখানে ঘটনাটি অন্যায় বা অসতর্কতায় হয়েছে, সেটা আমরা বিচার বিভাগে পাঠিয়ে দিই।’
এই প্রতিবেদন সম্পর্কে বক্তব্য জানতে চেয়ে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হককে খুদে বার্তা পাঠানো হলেও তিনি সাড়া দেননি।
প্রতিবেদনে যা আছে
যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রতিবেদনে মোট সাতটি বিষয়ের দিকে নজর দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, নির্যাতন, বিধিবহির্ভূত গ্রেপ্তার; মতপ্রকাশ, সমাবেশ ও সমিতি, ধর্মপালন ও চলাফেরার স্বাধীনতা এবং শরণার্থীদের সুরক্ষা; রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের স্বাধীনতা; সরকারের দুর্নীতি ও স্বচ্ছতার অভাব, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ নিয়ে আন্তর্জাতিক ও বেসরকারি তদন্তের প্রতি সরকারের মনোভাব; নারী, শিশু, যৌন, জাতিগত সংখ্যালঘু, আদিবাসী জনগোষ্ঠী এবং শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার এবং ইউনিয়ন ও নিরাপদ কর্মপরিবেশের অধিকার, শিশুশ্রম ও নিয়োগের ক্ষেত্রে বৈষম্য নিষিদ্ধ করা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিপীড়ন ও দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত থাকলেও ব্যাপকভাবে দায়মুক্তি ভোগ করে আসছে বলে খবর রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিপীড়ন, হত্যা ও দুর্নীতির খুব কমসংখ্যক ঘটনাতেই তদন্ত ও বিচারের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। দেশের বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে বলা হয়েছে, আইনে বলা হয়েছে বিচার বিভাগ স্বাধীন। কিন্তু দুর্নীতি ও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে বিচার বিভাগকেও আপস করতে হচ্ছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, মানহানির মামলাসহ নিবর্তনমূলক নানা আইন প্রয়োগ করে মতপ্রকাশে বাধা সৃষ্টির কথা উল্লেখ করা হয়েছে এই প্রতিবেদনে। বলা হয়েছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করে বিরোধী রাজনৈতিক দল ও বিরুদ্ধ মতকে দমনের কথাও।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ঘুষ, আর্থিক খাতে স্বচ্ছতার অভাব এখনো দেশটিতে তীব্র। ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত দুর্নীতি দমন কমিশন গঠিত হয়েছিল স্বাধীনভাবে দুর্নীতি দমনের জন্য, কিন্তু ঘুষ, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, অন্যায় রাজনৈতিক প্রভাব এই প্রতিষ্ঠানকেও আক্রান্ত করেছে। সরকারপন্থী রাজনীতিবিদ ও আমলাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে এখনো সরকারের অনুমতির জন্য প্রতিষ্ঠানটিকে তাকিয়ে থাকতে হয়।
ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের কাছে সাংবাদিকদের প্রশ্ন ছিল, যুক্তরাষ্ট্র নিজ দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে কি না। জবাবে কর্মকর্তারা বলেছেন, দেশটিতে মানবাধিকার ইস্যুতে সংবাদমাধ্যমগুলোর তীক্ষ্ণ নজর আছে। এ ধরনের ঘটনা কখনো গোপন করা হয় না এবং বিচার নিশ্চিত করা হয়।
সাংবাদিকদের দূতাবাসের কর্মকর্তারা জানান, ৪৬তম এই মানবাধিকার প্রতিবেদন মার্কিন কংগ্রেসে জমা দেওয়া হয়েছে। তারা বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রে মানবাধিকারের বিষয়টি থাকবে। চলমান মানবাধিকার লঙ্ঘন, গণতন্ত্রের পিছিয়ে পড়া এবং বিভিন্ন দেশে ক্রমেই বাড়তে থাকা কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে দেশভিত্তিক এমন প্রতিবেদন থাকা জরুরি।