মান বাংলার সমস্যা কী
বাংলাদেশে মান বাংলা বিষয়ে মাঝেমধ্যেই মারমার–কাটকাট তর্ক হাজির হয়—মান বাংলার দরকার কী? শতকরা কতসংখ্যক মানুষ এই বাংলায় বলতে পারে? আঞ্চলিক ভাষা কি তাহলে উঠে যাবে? কেউ কেউ মান বাংলা চালুর দোষ চাপাতে চান বাংলা একাডেমির কাঁধে। দোষের ভাগটিকে অনেকে আবার কলকাতার দিকেও ছুড়ে দেন। প্রশ্ন হলো, মান বাংলার সমস্যা কী? নাকি একে সমস্যায়িত করা হয়? ইতিহাস কী বলে?
ইতিহাস এই বলে যে যেকোনো ভাষার মতো বাংলাও একটি আদর্শ বা মান রূপের দিকে এগিয়ে গেছে। কোনো একজন লেখক, ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান এককভাবে এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত নন। ভাষাবিজ্ঞানীরা প্রক্রিয়াটিকে বলে থাকেন মান্যায়ন। এর মাধ্যমে বলা ও লেখার জন্য ভাষার মান্য রূপ তৈরি করা হয়। বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেও আদতে তা-ই ঘটেছে। যদি তা না ঘটত, বাংলা থেকে যেত অবিকশিত দশায়। ভাষা ব্যবহারকারীরা যার যার পছন্দসই বানান ও উচ্চারণের প্রয়োগ ঘটাত। তাদের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে বাংলা কোনো সুনির্দিষ্ট পরিচিতি তৈরি করতে পারত না। বলা ভালো, অতিরিক্ত অনুশাসন ও মুক্তি দুটিই ভাষার প্রসারের জন্য বিপজ্জনক; দুটিই ভাষাকে মৃত্যুর দিকে টেনে নিয়ে যায়। মান্যায়নের ভেতর লুকিয়ে আছে ভাষাকে একটি দৃঢ় ভিত্তির ওপর টিকিয়ে রাখার তাগিদ।
বহু রকম ভাষারূপ থেকে কেন একটি বিশেষ রূপ গড়ে তোলা হয়? কারণগুলোকে সহজ করে বলা যায়; এক. মান ভাষা দিয়ে শিক্ষা, দপ্তর, আইন-আদালত, রাষ্ট্র পরিচালনা করা; দুই. ভাষা-অঞ্চলের সবার জন্য একটি সাধারণ ভাষার মাধ্যমে যোগাযোগ সহজ করা; তিন. ভাষাভাষীর জাতিসত্তাগত পরিচয় নির্দিষ্ট ও সুসংহত করা। ধরা যাক, কুষ্টিয়া, নোয়াখালী, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ অঞ্চলের শিশুদের জন্য পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করা হবে। এই পুস্তকগুলোকে হতে হবে সর্বজনবোধ্য। আর তখনই দরকার পড়বে একটি আদর্শ ভাষার। মান ভাষার লক্ষ্য থাকে কোনো ভাষা-অঞ্চলের সব ভাষীর মধ্যে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা।
মান্যায়নের প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত জটিল। সচেতন অথবা অসচেতনভাবে ভাষাকে এই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে হয়। একক কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী চাপিয়ে দেয় না; কিন্তু ভাষার অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভিত্তি মান্যায়নে বড় প্রভাব ফেলে। আর এ কারণেই কোনো অঞ্চলের অনেকগুলো ভাষারূপের ভেতর থেকে একটি রূপ নির্বাচিত হয়ে যায়। বাংলা অঞ্চলের বৃহৎ প্রেক্ষাপটে বিচিত্র উচ্চারণভঙ্গি ও শব্দসম্ভারের কারণে উত্তরবঙ্গ, দক্ষিণবঙ্গ, পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গে প্রচলিত বাংলা ভাষা পরস্পর আলাদা। কিন্তু আদর্শ বা মান রূপ তৈরি হয়েছে কলকাতার লেখক ও বুদ্ধিজীবী পরিমণ্ডলে ব্যবহৃত বাংলা ভাষাকে ভিত্তি করে। সোজা কথায়, তাঁরা যেমন করে কথা বলেছেন, লিখেছেন এবং ভাষা নিয়ে ভেবেছেন, সেসবের ওপর আসন গেড়েই গড়ে উঠেছে মান বাংলার আদি কাঠামো।
এ নিয়ে বাংলাদেশি বাঙালিরা মনোকষ্ট বোধ করেন। ভাবেন, পূর্ববঙ্গের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে কলকাতার বাংলা। প্রকৃতপক্ষে ত্রিপুরা, ঝাড়খন্ড ও আসামের বাঙালিরও মন খারাপ হওয়ার কথা। কারণ, ওই সব অঞ্চলের বাংলা মান্যায়নের জন্য বিবেচ্য হয়ে ওঠেনি। ‘পূর্ব বাংলা’র ভাষা কেন বিবেচ্য হলো না, এই ভেবে যাঁরা গোস্সা করেন, তাঁদের জন্য বক্তব্য হলো, ঔপনিবেশিক ইতিহাসের পাটাতনে তৈরি হওয়া কলকাতার অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য ভাষার মান্যায়নে কার্যকারণ হিসেবে কাজ করেছে। সাধু ও চলিত দুটি রীতির মান রূপ তৈরি হওয়ার ইতিহাস মূলত একই উৎস জাত।
উনিশ শতকজুড়ে মুদ্রণ সংস্কৃতি নিয়ন্ত্রণ করেছেন কলকাতার লেখক ও বুদ্ধিজীবীরা। বাংলা ভাষার ধ্বনি, বর্ণ, লিপি, ব্যাকরণ, রীতি প্রসঙ্গে তাঁরা ভেবেছেন। তাঁদের মাধ্যমে রচিত ও মুদ্রিত হয়েছে বাংলা বই। পাঠ্যপুস্তক রচনা, মুদ্রণ ও বিপণনের সঙ্গে প্রধানত তাঁরাই যুক্ত ছিলেন। তাঁদের ভাষাবোধের প্রভাব পড়েছে বাংলা ভাষার অবয়ব সংস্থানে। ঢাকাকেন্দ্রিক পূর্ববঙ্গ সেসব কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে উনিশ শতকের শেষ দুই দশকে। তত দিনে বাংলাজুড়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কলকাতার সাংস্কৃতিক আধিপত্য। স্বীকার করা ভালো, এর সঙ্গে লড়াই করার জন্য পূর্ব বাংলা তখনো অপ্রস্তুত।
পূর্ববঙ্গবাসী বাংলা ভাষার গঠন, ব্যাকরণ, অভিধান ও রীতি বিষয়ে ভাবতে আরম্ভ করেছে অনেক পরে। বাঙালি মুসলমানের ভাষা বাংলা কি না, বিশ শতকের শুরুতেও এই তর্কে হাবুডুবু খেয়েছে মুসলমান সমাজ। এরই মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ ঝুঁকে গেছে রবীন্দ্রনাথ ও আধুনিকতার দিকে। মুসলমানদের শক্তিশালী ভরসা কাজী নজরুল ইসলাম ভাষার ময়দানে এলেও পূর্ব বাংলার ভাষা বলে আলাদা কিছু তাঁকে আলোড়িত করেনি। নজরুলসহ বাঙালি মুসলমানের আরও দুই ভরসা ভাষাবিজ্ঞানী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ও মুহম্মদ আবদুল হাই তিনজনই পশ্চিমবঙ্গকেন্দ্রিক ভাষা-অঞ্চলের সদস্য। আর তাই অনুমান করা যায়, বাংলা ভাষার মান্যায়নের পাল্লা কোন দিকে ঝুঁকে যেতে পারে।
পূর্ব বাংলার মুসলমানরা ভাষার মান্যায়ন নিয়ে যত না ভেবেছে, তার চেয়ে বেশি ভেবেছে ভাষার জাতীয়তা প্রসঙ্গে। মান্যায়নের লড়াইয়ে ভাষাতাত্ত্বিক দিকে থেকে তাই পূর্ব বাংলা কখনোই জোরদার কণ্ঠ হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। পাকিস্তান-পর্বে মান্যায়ন–বিষয়ক কাজ ছিল প্রধানত সাম্প্রদায়িক; অপরিচিত আরবি-ফারসি-উর্দু শব্দ আরোপণের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি হয়েছিল ‘ইসলামি বাংলা’ বা ‘মুসলমানি বাংলা’ প্রতিষ্ঠার তৎপরতা। জাতীয়তাবাদী প্রতিরোধ ভাষার সেই সাম্প্রদায়িকীকরণকে মোকাবিলা করেছে। এই প্রেক্ষাপটে আঞ্চলিক ভাষার সমন্বয় সূত্রে মুসলমানের অভিজ্ঞতানির্ভর ‘ঢাকাই বাংলা’র পক্ষে ছিলেন আবুল মনসুর আহমদ। মান রূপ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাঁর লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানি বাংলার জাতীয়তা গঠন, পাশাপাশি মধ্যবিত্তের কথ্য বাংলাকে জনগণের মধ্যে বোধগম্য উপায়ে প্রকাশ করা।
ভাষা-পরিকল্পনার মাধ্যমে বাংলাদেশ-পর্বে মান বাংলা বিষয়ে অঞ্চল উপযোগী নীতি ও রীতি প্রস্তুত করা যেত। কিন্তু তা ঘটেনি। এ পর্বেও বজায় থেকেছে কলকাতার আধিপত্য। কাঁটাতার পেরিয়ে কলকাতা যেচে বাংলাদেশের জন্য আদর্শ ভাষা তৈরি করে দিয়ে যায়নি। এ দেশের লেখক, বুদ্ধিজীবী ও বিদ্যায়তনিক গবেষকেরা ভাবাদর্শিকভাবে কলকাতাকে গ্রহণ করেছেন। আশি-নব্বই দশকের বাংলাদেশি সিনেমা, টিভি নাটকে গ্রাম-শহর-শ্রেণি নির্বিচার ব্যবহৃত হয়েছে মান বাংলা; সাংস্কৃতিকভাবে যা ছিল অবাস্তব ও অসত্য। তখন হয়তো কারও মনেও হয়নি যে মান বাংলার ভেতর হইছে, খাইছে, গেছে, আসতেছে ইত্যাদি ক্রিয়াপদ ঢুকে ভাষার মান রূপকে নতুন ধরনের দিকে চলে যেতে পারে।
আঞ্চলিকতাবাদীরা মনে করেন, মান বাংলা একটি ক্ষমতায়িত ভাষা। কারণ কোনো জাতির ভাষাগত পরিচয় দিতে গিয়ে প্রধানত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত নিয়ন্ত্রিত আদর্শ ভাষাকে হাজির করা হয়। ক্ষমতাসীনদের ভাষাবোধ ও প্রয়োগ যা-ই হোক না কেন, মান ভাষা ও ক্ষমতাতন্ত্র হাত ধরাধরি করে চলে। মানবাদীরা মনে করেন, আঞ্চলিকতার মিশ্রণ প্রকৃতপক্ষে ভাষাদূষণ; মানের ভেতর একটি-দুটি আঞ্চলিক শব্দ ও উচ্চারণ পেলে তাঁরা আঁতকে ওঠেন। কিন্তু আঞ্চলিকতাবাদী ও মানবাদীদের মনে রাখা দরকার, সমবৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ভাষাসমূহের একটি রূপ হলো মানভাষা। আঞ্চলিক ভাষা কখনোই মানভাষার ব্যত্যয় নয়। আঞ্চলিক ভাষাসমূহ থেকে বাছাইকৃত ও পরিশীলিত এই ভাষাটিকে বলা যায় দ্রুত যোগাযোগসক্ষম কাজের উপযোগী একটি আনুষ্ঠানিক ভাষা; যার প্রয়োগক্ষেত্র শিক্ষা, আইন–আদালত, আন্তরাষ্ট্রীয় যোগাযোগ, প্রশাসন, গণমাধ্যমে প্রচারযোগ্য জনগুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান ইত্যাদি। ব্যক্তি-ব্যক্তি যোগাযোগে মান বাংলা বড়জোর ব্যক্তির ইচ্ছানির্ভর একটি মাধ্যম মাত্র।
বাড়তি আভিজাত্য প্রতিষ্ঠার ঝোঁকে মানবাদীদের কেউ কেউ আঞ্চলিক বাংলার প্রতি দুর্বিনীত অবজ্ঞা প্রকাশ করেন। আঞ্চলিক ভাষা ও উপভাষার প্রয়োগ দেখে নৈতিক নসিহত পেশ করে বলতে থাকেন, ‘ভাষাদূষণ’ রোধ করতে হবে। নির্মম সত্য এই যে ভাষার স্বভাবই হলো দূষিত হওয়া; অতি শুদ্ধতার শেষ দশা হলো ভাষার মৃত্যু। আঞ্চলিক ভাষা ও উপভাষাগুলোই মূলত সবচেয়ে স্বাধীন ও জীবন্ত ভাষা; তারা প্রতিমুহূর্তে চলমান, চলতি পথে তারা তুলে নেয় নতুন শব্দ, নতুন প্রয়োগ। আবার উচ্চারণের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে নতুন শব্দকে নিজের ছাঁচমতো তৈরিও করে নেয়।
মান বাংলাবিষয়ক আলাপে আরেকটি প্রস্তাব শোনা যায়; সেটি এই, বাংলাদেশি মুসলমানের ভাষারীতি অনুসরণেই গড়ে তোলা উচিত এ অঞ্চলের মান ভাষা। কিন্তু বাংলাদেশ নামে পরিচিত ভূখণ্ডটি কখনোই ‘কেবলই’ মুসলমানের বসতি ছিল না। বহু ধর্ম ও সংস্কৃতির মানুষ এ অঞ্চলে বসবাস করছে। একটি মাত্র ভাষারূপ নিয়ে বাংলাদেশের ভাষা-পরিসর গঠিত নয়। এই অঞ্চলকে একটি মাত্র জাতিসত্তা ও ধর্মপরিচয়ের সঙ্গে সংলগ্ন করার মাধ্যমে আদতে ধর্মীয় ও ভাষাগত আধিপত্য তৈরি করা হয়।
কলকাতার বাংলাকে ‘হিন্দু বাংলা’ বলে চিহ্নিত করছি, সমালোচনা করছি, অথচ বাংলাদেশের জন্য ‘মুসলমানি বাংলা’ তৈরি করতে চাইছি। চিন্তা শেষমেশ থেকে যাচ্ছে একই ডিসকোর্সের অধীন; তা হলো সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মীয় সংস্কৃতি দিয়ে ভাষার মান রূপ স্থির করা এবং এক আধিপত্যের মোকাবিলা করতে গিয়ে আরেক আধিপত্যকে হাজির করা। এই অবস্থান এমন প্রশ্নেরও জবাব দেয় না, বাংলাদেশের অন্য ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী বাংলাদেশি বাঙালির সঙ্গে কোন ধরনের বাংলায় যোগাযোগ স্থাপন করবে।
ভাষিক বাস্তবতা এই যে আঞ্চলিক, মান, মিশ্র, পেশাগত, দাপ্তরিক, প্রশাসনিক, আনুষ্ঠানিক, অনানুষ্ঠানিক, অশ্লীল—বাংলা ভাষার এ ধরনের বৈচিত্র্যকে মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। কেননা ভাষা স্বয়ং বহুগামী। ভবিষ্যতে হইছে, খাইছে, করছে, দেখতেছি ক্রিয়াপদযুক্ত মান বাংলা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনাকে তাই উড়িয়ে দেওয়ারও সুযোগ নেই। তখন হয়তো দেখা যাবে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের মান বাংলা আরও স্পষ্টভাবে বেছে নিয়েছে দুটি খাত, হয়তো আরও গভীরভাবে বেঁকে যাবে দুজনার দুটি পথ।
ফেব্রুয়ারি ২০২২