মাঠের দ্বন্দ্ব মাঠে থাকছে না, আঁচ লাগছে আ.লীগে–সচিবালয়ে
উত্তরের জেলা লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলায় গত বছরের নভেম্বর মাসের ঘটনা। এ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) হত্যার হুমকি এবং ১৯টি চেক ছিঁড়ে ফেলার ঘটনায় উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফারুক ইমরুল কায়েসের বিরুদ্ধে থানায় দুটি পৃথক সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়। ইউএনও মুহাম্মদ মনসুর উদ্দিন ও উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের স্টেনোটাইপিস্ট হাবিবুর রহমান বাদী হয়ে জিডি দুটি করেন। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গত ৩০ নভেম্বর ইউএনওকে হুমকি দেওয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগে চেয়ারম্যান ফারুক ইমরুল কায়েসকে সাময়িক বরখাস্ত করে স্থানীয় সরকার বিভাগ।
যে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফারুক ইমরুল কায়েসকে বরখাস্ত করা হয়, সেখানে বলা হয়, আদিতমারীর ইউএনওর সঙ্গে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ফারুক ইমরুল কায়েস (গত ১২ নভেম্বর) অসদাচরণ ও দুর্ব্যবহার করেছেন। ফারুক ইমরুল কায়েস উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে পরিষদের বিভিন্ন দপ্তরে আর্থিকভাবে অনৈতিক দাবি প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করে আসছেন। তিনি আদিতমারী উপজেলা পল্লী উন্নয়ন কর্মকর্তার সঙ্গে অশোভন আচরণ করেছেন। তাঁর এসব কর্মকাণ্ডে উপজেলা পরিষদের কর্মচারীদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। এমন অবস্থায় সরকার তাঁকে স্বীয় পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।
পরে অবশ্য ফারুক ইমরুল কায়েসকে উচ্চ আদালতের রায়ে নিজ পদে বহাল হন। তিনি গত জুন মাসে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে আবার বসেছেন। ইউএনওর সঙ্গে তাঁর সমস্যা ‘মিটে’ গেছে বলেই স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা দাবি করেন।
আদিতমারীর ঘটনা ‘মিটে গেলেও’ বরিশালের ঘটনা দেশজুড়ে সাড়া ফেলেছে। যেখানে সিটি মেয়রের বিরুদ্ধে মামলা পর্যন্ত করলেন সদর উপজেলার ইউএনও।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী (এলজিআরডি) এম তাজুল ইসলামের কাছে বরিশালের ঘটনাটি ‘অনাকাঙ্ক্ষিত কিন্তু বিচ্ছিন্ন।’ আর মাঠপর্যায়ে এসব দ্বন্দ্ব প্রকট, এমনটা মানতে নারাজ তিনি।
তবে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ, সাংসদ, একাধিক উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউএনওদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দ্বন্দ্ব ও রেষারেষির ঘটনা আছে প্রায় সবখানে। কোথাও কম, কোথাও বেশি। মাঠপর্যায়ে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং অন্য জনপ্রতিনিধিদের দ্বন্দ্ব আড়াল করা যাচ্ছে না। বরিশালে এর বহিঃপ্রকাশ হলো।
উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানরা বলছেন, ইউএনও বা প্রশাসনের কর্মকর্তারা তাঁদের তেমন পাত্তা দেন না। সরকারের আমলানির্ভরতা মাঠের প্রশাসনের প্রভাব ফেলেছে।
ইউএনওরা বলছেন, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানরা তাঁদের অন্যায় আবদার মানতে ইউএনওদের বাধ্য করার চেষ্টা করেন। অনেক জায়গায় শাসক দলের সাংসদ ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকলে এর রেশ গড়ায় তাঁদের ওপর। পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে পড়ে।
বরিশালের ঘটনায় প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধির দ্বন্দ্ব, শাসক দলের অন্তর্দ্বন্দ্ব—এসবই দেখা যায়।
সম্প্রতি বরিশাল সদর উপজেলা ইউএনও মুনিবুর রহমানের বাসভবনে সিটি মেয়র সেরিনিয়াবত সাদিক আবদুল্লাহর সমর্থকদের হামলার ঘটনা সারা দেশে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। গত বুধবার রাতে ওই ঘটনার সূচনা হয় ইউএনওর কার্যালয়ের দেয়ালে ব্যানার–ফেস্টুন অপসারণকে কেন্দ্র করে। বুধবার রাতে মেয়র–সমর্থক ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। সদর উপজেলা কমপ্লেক্সের মধ্যে ময়লা–বর্জ্য রাখার ঘটনা ঘটে। পরদিন দুটি মামলা হয়। একটি করেন ইউএনও মুনিবুর রহমান। সে মামলায় সিটি মেয়রকে প্রধান আসামি করা হয়। অন্য মামলাটি করেন বরিশাল কোতোয়ালি থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. জামাল। দুই মামলায় আওয়ামী লীগের স্থানীয় ১২ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
এ ঘটনায় রাজনীতি জড়িত না থাকলেও সেই রাজনীতির বিষয়টি আসছেই। কারণ, অপসারণ করা ব্যানার-ফেস্টুনগুলো ছিল বরিশাল সদরের সাংসদ ও পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকের সমর্থকদের লাগানো। বরিশালের রাজনীতিতে মেয়র পরিবারের সঙ্গে জাহিদ ফারুকের দ্বন্দ্ব থাকলে তা কখনো প্রকাশ পায়নি ।
এর আগে গত বছরের অক্টোবর মাসে ফরিদপুর-৪ আসনের সাংসদ ও যুবলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মুজিবুর রহমান নিক্সন প্রকাশ্য সভায় ফরিদপুরের জেলা প্রশাসককে হুঁশিয়ারি দেন। তিনি বলেন, প্রশাসনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ওই জেলা প্রশাসক শেখ হাসিনার চোখ ফাঁকি দিয়ে ১২ জন ম্যাজিস্ট্রেট নিয়ে নৌকার কর্মীদের গ্রেপ্তার করেছেন, পিটিয়েছেন।
ফরিদপুরের চরভদ্রাসন উপজেলার নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নিক্সন চড়াও হন স্থানীয় প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তার ওপর। নিক্সন চৌধুরী ও চরভদ্রাসনের ইউএনও জেসমিন সুলতানার মোবাইলে কথোপকথনের অডিও ভাইরাল হয়।
অডিওতে নিক্সন অশ্রাব্য ভাষায় ইউএনওর সঙ্গে কথা বলেন। নিক্সন চৌধুরী ইউএনওকে বলেন, ‘আপনার এসি ল্যান্ড আমার লোককে গাড়িতে তুলে নিয়েছে। ওরে দালালি করতে মানা করেন। সিগারেট খাওয়ার জন্য ওকে ধরছে, আপনি ওকে ছাড়তে বলেন। আমি আসতাছি চরভদ্রাসন, পাঁচ মিনিট সময় দিলাম। এর মধ্যে ছেড়ে না দিলে উপজেলা ঘেরাও করব।’
চট্টগ্রাম বিভাগের একটি জেলার এক ইউএনও প্রথম আলোকে নাম প্রকাশ না করার শর্ত বলেন, যেখানে এমপি ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের দ্বন্দ্ব আছে, সেখানে মাঠ প্রশাসনের অবস্থা খারাপ হয়ে যায়।
এই ইউএনও আরও বলেন, একটি অনুষ্ঠানে অতিথি করা নিয়ে সাংসদ ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের সমর্থকদের মধ্যে তুলকালাম হয়। সাংসদ তাঁকে দোষেন।
বগুড়ার এক উপজেলার ইউএনও বলেন, বিধবা ও প্রতিবন্ধী ভাতা দেওয়ার ক্ষেত্রে নিজের লোকদের প্রাধান্য দিতে বাধ্য করার চেষ্টা করেন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। তিনি না করায় দ্বন্দ্ব লেগে যায়।
এই ভাতা বিতরণ কমিটির প্রধান ইউএনও। আর ভাতা প্রতিস্থাপন কমিটির প্রধান উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান।
ভাতাসংক্রান্ত এমন সমস্যার কথা একাধিক জায়গা থেকে জানা গেছে।
খুলনার একটি উপজেলার ইউএনও বলেন, হাটের ডাকে নিজের পছন্দের লোককে পাইয়ে দিতে চাপ দেন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। তিনি না শুনে সর্বোচ্চ দরদাতাকে ইজারা দেন। এতে নাখোশ হন চেয়ারম্যান।
অভিযোগ আছে ইউএনওদের বিরুদ্ধেও। রাজশাহী বিভাগের এক উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বলেন, ‘ইউএনও নিজেকে সর্বেসর্বা মনে করেন। তিনি জানেন এমপির সঙ্গে আমার দ্বন্দ্ব। তিনি নিজেকে এমপির লোক হিসেবে জাহির করেন।’
আদিতমারী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফারুক ইমরুল কায়েস প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রশাসনের লোকজন এমনভাবে কাজ করতেসে, যেন ওনারাই সব। ওনারাই সরকারকে আনছে, উপজেলা পরিষদে আমরা জানি কোথা থেকে আসলাম।’
বরিশাল বিভাগের এক উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের কথা, ‘এমপির সঙ্গে উপজেলা চেয়ারম্যানের দ্বন্দ্ব ইউএনওরা এনজয় করেন। এতে তাঁদের ইচ্ছামতো কাজ করতে সুবিধা হয়।’
এই উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের কথা, ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর থেকে বেশি বেপরোয়া হয়ে গেছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা। নির্বাচন নিয়ে স্বচ্ছতার ঘাটতি থাকায় এসব প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ‘বেশি সহযোগিতা’ থাকায় তাঁরা এখন মনে করেন, সরকার তাঁদের ওপর নির্ভরশীল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক সালাউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান বলেন, বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধিত্বকারী মাঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে স্থানীয় সরকারের নেতৃত্বে একধরনের দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক আছে। এর মূল কারণটা হলো, নির্বাচিত নেতৃত্ব ইচ্ছা অনুযায়ী অনেক সময় সরকারি সম্পদ ব্যয় করতে চায়, কিন্তু সরকারি কর্মকর্তারা কেন্দ্রীয় নীতিমালাকে সামনে রেখে সেই উন্নয়ন এবং বরাদ্দ ব্যবস্থার পরিবীক্ষণ করেন, যা অনেক ক্ষেত্রে দ্বান্দ্বিক একটা অবস্থান সৃষ্টি করে। তাতে স্থানীয় নেতৃত্ব অনেক ক্ষেত্রে নাখোশ হয়, এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা বৈরিতার পর্যায়ে চলে যায়।’
উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদের সংগঠন বাংলাদেশ উপজেলা চেয়ারম্যান অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক হারুন-উর-রশীদ হাওলাদার মনে করেন, জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সাম্প্রতিক প্রকাশ্য বিরোধ অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও এর উৎপত্তি সংবিধানের নির্দেশনা ও আইন অনুযায়ী প্রশাসনিক স্তরগুলোয় নির্বাচিত প্রতিষ্ঠানের অধীনে কাজ না করার মানসিকতা।
দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার ইউএনওর ওপর হামলার পর ইউএনওদের নিরাপত্তার জন্য ১৫ আনসার সদস্য বরাদ্দ দেওয়ার সমালোচনা করেন হারুন-উর-রশীদ হাওলাদার। তিনি বলেন, এ যেন একজনের জন্য বিকল্প থানা। মাঠ কর্মকর্তা—নিজেদের ক্ষমতার নিয়ামক শক্তি ভাবা ভুল। প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ, জনগণ বিক্ষুব্ধ হলে জনপ্রতিনিধিদের ওপর হবে, যখনই জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতা কর্মচারী প্রয়োগ করবে, তখনই বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে।
মাঠপর্যায়ে বড় ধরনের কোনো দ্বন্দ্ব জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের মধ্যে নেই বলে দাবি মন্ত্রী তাজুল ইসলামের। তিনি বলেন, কোথাও কাজ করতে গেলে সমস্যা তো হবেই। সব জনপ্রতিনিধি যেমন ভালো নয়, তেমন সব প্রশাসনের কর্মকর্তাও ভালো নয়।
তাজুল ইসলাম আজ রোববার প্রথম আলোকে বলেন, বরিশালের ঘটনাটি বিচ্ছিন্ন। এটি মাঠের বাস্তবতা নয়।
তবে বরিশালের ঘটনাকে এমনভাবে বিচ্ছিন্ন বলে মনে না করে এর সঠিক কারণ সন্ধানের পরামর্শ দেন স্থানীয় সরকারের খ্যাতনামা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সালাউদ্দিন আমিনুজ্জামান। তিনি বলেন, বরিশালের ঘটনার অন্তরালে কারণ এখনো জানা যায়নি। তবে ঘটনাটা নিছক ব্যক্তিগত রেষারেষির ফল ভাবা যাবে না। মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ক্ষমতা বণ্টন, জবাবদিহি এবং সামগ্রিকভাবে আইনের শাসনের আওতায় দেখতে হবে আর গুরুত্বের সঙ্গে বিশ্লেষণ করতে হবে। এর পেছনের প্রেক্ষাপট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষণ প্রয়োজন। তা না হলে ভবিষ্যতে এমন আরও ঘটনা ঘটবে না, তা বলা যায় না।
খোদ শাসক দলের মধ্যেই আমলানির্ভরতা নিয়ে সমালোচনা হয়েছে। গত ২৮ জুন সংসদে প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা ও মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ আমলাদের কারণে রাজনীতিকরা ‘ম্লান’ হয়ে যাচ্ছেন বলে উষ্মা প্রকাশ করেন। তোফায়েল বলেন, ‘যারা রাজনীতিবিদ, যারা নির্বাচিত প্রতিনিধি, তাদের জন্য নির্ধারিত স্থান যেখানে আছে, সেখানে তাদের থাকা উচিত।’