মাছ উৎপাদনে আমরা প্রায় সর্বোচ্চ জায়গায় চলে গেছি
মৎস্য খাতে বাংলাদেশের সাফল্য ঈর্ষণীয়। যাঁদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ এই খাতে সাফল্য অর্জন করেছে, মো. গোলাম হোসেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তিনি বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ছিলেন। দেশের উন্নত মানের সুবর্ণ রুই, তেলাপিয়া, রাজপুঁটিসহ বেশ কিছু জনপ্রিয় জাত উদ্ভাবনে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন। বর্তমানে কাজ করছেন বাংলাদেশ তেলাপিয়া ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে। সুনীল অর্থনীতি নিয়ে ওয়ার্ল্ড ফিশের সঙ্গে বিশেষজ্ঞ হিসেবে এখনো কাজ করছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক ইফতেখার মাহমুদ
প্রশ্ন :
আপনি মৎস্যবিজ্ঞানী হিসেবে কাজ শুরুর সময়ে দেশে মৎস্যসম্পদের অবস্থা কেমন ছিল?
মো. গোলাম হোসেন: ১৯৭৮ সালে যখন বাংলাদেশ মৎস্য অধিদপ্তরে একজন বিজ্ঞানী হিসেবে কাজ শুরু করি তখন দেশে মাছ বলতে ছিল নদী-খাল-বিল ও হাওরে প্রাকৃতিকভাবে যা পাওয়া যেত। গ্রামাঞ্চলে মানুষ নদীতে যেসব পোনা পেত, তা ধরে পুকুরে ছাড়ত। সেখান থেকে সামান্য মাছ আসত । আর সাগরে জেলেরা কিছু মাছ ধরত। ওই সময়ে সব মিলিয়ে দেশে মাছের উৎপাদন ছিল ৫ লাখ থেকে ৬ লাখ টন। গ্রামের মানুষ যা মাছ ধরত, তা নিজেরাই খেত। আর শহরে মূলত মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তরা টাকা দিয়ে মাছ কিনে খেতে পারত। কারণ, মাছের জোগান ছিল কম, দামও ছিল বেশি। এখন দেশে দেড়-দুই শ টাকা কেজিতে পুকুরে চাষের রুই পাওয়া যায়। তা ছিল ওই সময়ে মাছের উৎপাদনের মাত্র ১ শতাংশ। আশির দশকের শুরুর সময়টা পর্যন্ত এই অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি।
প্রশ্ন :
আপনি দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও কম দামি মাছের উন্নত জাত উদ্ভাবনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এর জন্য প্রস্তুতিটা কোথায় কীভাবে নিলেন?
গোলাম হোসেন: ১৯৮১ সালে আমরা পুকুরে উন্নত পদ্ধতিতে মাছ চাষের জন্য গবেষণা শুরু করি। কিন্তু ’৮২ সালে আমি সিরিয়া চলে যাই। সেখানে আমি গ্রাসকার্প ও তেলাপিয়া মাছ নিয়ে কাজ শুরু করি। ১৯৮৬ সালে দেশে ফিরে সদ্য প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটে প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দিই। সিরিয়ার অভিজ্ঞতা দেশে প্রয়োগ করার চেষ্টা করি। এর আগে উন্নত জাতের রুই মাছের চাষ শুরু করার প্রাথমিক কাজটি শুরু করে দেন ড. ইউসুফ আলী। তিনি কানাডা থেকে মাছের উন্নত জাত উদ্ভাবন নিয়ে পিএইচডি করে দেশে ফিরে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটে যোগ দেন। ওই সময়ে চীন ও ভারতে পুকুরে উন্নত রুই চাষ সফল হয়েছে। ড. ইউসুফ তা বাংলাদেশেও শুরু করে সফল হলেন। আমিসহ কয়েকজন বিজ্ঞানী তাঁর সহায়তায় কার্প ও তেলাপিয়ার উন্নত জাত চাষ করার কাজ শুরু করি। আমাদের সহায়তা নিয়ে যশোরে মহসীন আলী নামে এক মাছ চাষি সাহস করে পুকুরে রুই চাষ শুরু করেন। নদী থেকে না নিয়ে হ্যাচারিতে পোনা উৎপাদন সরকারিভাবে শুরু করি। হ্যাচারিতে পোনা আর চাষি পর্যায়ে মাছের বাড়তি উৎপাদনের ওই সাফল্য আমাদের সামনের দিনের স্বপ্ন দেখায়।
প্রশ্ন :
এখন তো দেশে মাছের উৎপাদন ৪৫ লাখ টন ছাড়িয়েছে। এই পরিবর্তনটা কীভাবে এল।
গোলাম হোসেন: দেশের মোট উৎপাদিত মাছের ৫০ শতাংশ মূলত ছয়টি জাতের মাছ থেকে আসে। রুই, পাঙাশ, তেলাপিয়া, কই ও শিং-মাগুর মাছের বিভিন্ন জাতের চাষ মূলত পুকুরে হয়ে থাকে। এর বাইরে প্রাকৃতিক মাছের মধ্যে একমাত্র ইলিশের অবদান প্রায় ১২ শতাংশ। বাকি মাছ নদী-বিল-হাওর ও সাগর থেকে আসে। এই যে ৪০ বছরে দেশে মাছের উৎপাদন ১০ গুণেরও বেশি বাড়ল তার পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে পুকুরে উন্নত পদ্ধতির মাছ চাষ। উৎপাদন বেশি হওয়ায় এবং খরচ কম হওয়ায় এসব মাছের দামও বেশ কম। ফলে দেশের বিপুলসংখ্যক গরিব মানুষের প্রোটিনের চাহিদা এসব মাছ থেকে পূরণ হচ্ছে। চাষের রুই, পাঙাশ, কই ও তেলাপিয়া দেড় শ থেকে দুই শ টাকা কেজি দরে পাওয়া যাচ্ছে। বিশ্বের কোনো দেশে এক কেজি মাছ ২ ডলার দামে পাওয়া যাবে না। দেশের বিপুলসংখ্যক গ্রামীণ ও শহরের দরিদ্র মানুষের পুষ্টির প্রধান চাহিদা পূরণ হচ্ছে এই মাছগুলো থেকে। আন্তর্জাতিক খাদ্যনীতি সংস্থা ইফপ্রি তো বলছে বাংলাদেশে পুকুরে মাছ চাষে নীল বিপ্লব ঘটে গেছে। বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবন মৎস্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে দেওয়া গেছে। প্রথমে ময়মনসিংহ-যশোর দিয়ে শুরু হয়ে এখন সিরাজগঞ্জ-বগুড়া ও সারা দেশেই পুকুরে মাছ চাষ গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর অন্যতম লাভজনক উদ্যোগ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। যে কারণে এই সাফল্য এসেছে।
প্রশ্ন :
পুকুরে মাছ চাষে বিপ্লব ঘটে যাওয়ার পথে চ্যালেঞ্জগুলো কী ছিল?
গোলাম হোসেন: পুকুরে মাছ চাষের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে চাহিদা অনুযায়ী পোনা সরবরাহ। সেটি প্রথমে সরকারিভাবে হয়েছে। এখন দেশে প্রায় এক হাজার হ্যাচারি আছে। যার বেশির ভাগই বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে উঠেছে। দেশের উৎপাদিত মাছের জন্য প্রয়োজনীয় পোনার ৯৮ শতাংশ এখন হ্যাচারিগুলো থেকে আসে। বাকিগুলো নদী ও উন্মুক্ত জলাশয় থেকে জেলেরা সংগ্রহ করে থাকেন। দ্বিতীয় মাছের খাবার সরবরাহ করার ক্ষেত্রে ফিশ ফিডমিলগুলো গড়ে উঠেছে। দেশের অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠান এ ক্ষেত্রে এগিয়ে এসেছে। এ ছাড়া মাছের রোগ-বালাই দূর করতে প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহ করার ক্ষেত্রে দেশে প্রচুর বিনিয়োগ হয়েছে। দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে এসেছে। আর সামগ্রিকভাবে মৎস্য অধিদপ্তরের মাঠপর্যায়ের কর্মী এবং গণমাধ্যমগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তেলাপিয়ার উন্নত জাত উদ্ভাবনে ওয়ার্ল্ড ফিশ আমাদের অনেক সহায়তা দিয়েছে।
এখন আমাদের মোট মাছের ১৩ শতাংশ তেলাপিয়া, পাঙাশ ১২ শতাংশ ও ১১ শতাংশ রুই মাছ। এর বাইরে শিং, মাগুর, শোল, রাজপুঁটি, পাবদা, টেংরার উন্নত জাতের চাষ দ্রুত বাড়ছে।
প্রশ্ন :
ইলিশেও তো সাফল্য ভালো।
গোলাম হোসেন: হ্যাঁ। ইলিশ মাছের উৎপাদন বাড়াতে সরকারের নীতিসহায়তা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। সরকার জাটকা ধরা বন্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কাজে লাগিয়েছে। দেশের ভেতরে একের পর এক ইলিশের অভয়াশ্রম চিহ্নিত করে সেখানে ইলিশের বেড়ে ওঠা নিশ্চিত করেছে। সর্বোপরি ইলিশ ধরার নিষিদ্ধ সময়ে সরকার জেলেদের সামাজিক নিরাপত্তার মাধ্যমে খাদ্য ও নগদ সহায়তা দিয়েছে। ফলে গত এক যুগে দেশে ইলিশের উৎপাদন দ্বিগুণ হয়েছে। চাঁদপুরের মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। যে কারণে আমাদের এখানে বিশ্বের বেশির ভাগ ইলিশ উৎপাদিত হচ্ছে।
প্রশ্ন :
কিন্তু চাষের মাছের ক্ষেত্রে বড় অভিযোগ হচ্ছে এগুলোর স্বাদু নদী বা বিলের মতো না।
গোলাম হোসেন: নদীর মাছের প্রধান খাবার হচ্ছে উদ্ভিদকণা ও প্রাণীকণা। যেগুলো প্রকৃতি থেকে আসে। ফলে প্রাকৃতিক জলাশয়ের মাছের স্বাদ কোনোভাবেই চাষের মাছের মতো হবে না। অনেক ক্ষেত্রে চাষিরা পুকুরের মাছে অতিরিক্ত ওষুধ ও নিম্নমানের ফিশফিড ব্যবহার করে। সে ক্ষেত্রে মাছের স্বাদে সমস্যা হয়। কিন্তু নিয়ম মেনে চাষ করলে পুকুরের মাছে পুষ্টিমানের কোনো তারতম্য হবে না। আমরা গবেষণা করে দেখেছি নদী ও পুকুরের চাষের মাছের পুষ্টিগুণ একই রকমের। তবে দেশের নদী ও উন্মুক্ত জলাশয়গুলোতে দূষণের কারণে প্রাকৃতিক উৎসের মাছ কমে যাচ্ছে। যা-ও পাওয়া যাচ্ছে তার মধ্যে প্লাস্টিককণার মতো মারাত্মক সব দূষিত বস্তুকণা পাওয়া যাচ্ছে। ফলে নদী ও জলাশয়ের মাছ মানেই যে ভালো তা কিন্তু বলা যাবে না।
প্রশ্ন :
আমাদের দেশে মাছের উৎপাদন হচ্ছে পুকুরে। যত বেশি পুকুর হবে তত বেশি কৃষি জমি কমবে। এর সমাধান কী?
গোলাম হোসেন: আমাদের দেশে পুকুরে যে পরিমাণ মাছ উৎপাদিত হচ্ছে, তা থেকে আর খুব বেশি বাড়ানো যাবে না। ইলিশের উৎপাদনও আর খুব বেশি বাড়বে না। এগুলোর উৎপাদন সর্বোচ্চ জায়গায় চলে গেছে। তাহলে আমাদের এখন অন্য খাতের দিকে এগোতে হবে। বঙ্গোপসাগরে আমরা বাংলাদেশের ভূখণ্ডের দ্বিগুণ এলাকা আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে জয় করেছি। কিন্তু সেখানে আমাদের প্রধান সম্পদ হচ্ছে মাছ। কিন্তু ওই মাছ আমরা কীভাবে আহরণ করব তা নিয়ে আরও বিস্তারিত পরিকল্পনা দরকার। অবকাঠামো ও প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে আমরা এখনো বেশ পিছিয়ে আছি। যেমন ধরেন বঙ্গোপসাগরে টুনা মাছ ধরার জন্য প্রয়োজনীয় জাল ও নৌযানের ঘাটতি আছে। সাগরের কোন এলাকায় কোন ধরনের মাছ কখন বেশি পাওয়া যায়, তার আরও বিস্তারিত জরিপ দরকার। আমাদের মাছ অন্য দেশের জেলেরা এসে নিয়ে যাচ্ছে কি না, তা দেখতে হবে।
প্রশ্ন :
দেশের মৎস্যসম্পদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কী?
গোলাম হোসেন: বাংলাদেশে যেসব জনপ্রিয় মাছ রয়েছে, তা রপ্তানি করার উদ্যোগ নিতে হবে। এ জন্য মাছ প্রক্রিয়াজাত কারখানা গড়ে তুলতে হবে। এ ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতকে এগিয়ে আসতে হবে। আর চাষের মাছ যাতে আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে চাষ করা যায়, তা নিশ্চিত করতে চাষিদের প্রশিক্ষণ এবং সচেতনতা বাড়াতে হবে। তবে এ বিষয়ে নিয়মিত তদারকি দরকার। সামগ্রিকভাবে বলতে হবে গরিবের প্রোটিনের সরবরাহ করতে এখন সাগরের দিকে নজর দিতে হবে।
প্রশ্ন :
আপনাকে ধন্যবাদ।
গোলাম হোসেন: আপনাকেও ধন্যবাদ।